রেমুণার ক্ষীরচোরা গোপীনাথ
(বালাসোর, ওড়িশা)
পশ্চিমবঙ্গের একদম প্রতিবেশী রাজ্য ওড়িশার বালাসোর জেলার
অন্যতম 'বৈষ্ণবতীর্থ' এই রেমুণার ক্ষীরচোরা গোপীনাথ মন্দির।
কেউ কেউ বলেন, প্রায় ৮০০ বছর আগে এখানে বাস করতেন
শ্রীকৃষ্ণের অবতার গোপীনাথ। বর্তমান মন্দিরটি নাকি প্রায় দেড় শতাধিক বছরের
প্রাচীন।
প্রকৃতপক্ষে 'রেমুণা' কথাটি
এসেছে 'রমণীয়' বা মনোরম কথা থেকে।
রেমুণা হল বালাসোর জেলার এক ছোট্ট, সুন্দর গ্রাম। মূলত এই
ক্ষীরচোরা গোপীনাথ মন্দিরের জন্যই এই গ্রামের এত খ্যাতি। বলা হয় ভারতের প্রাচীন
কৃষ্ণ বিগ্রহগুলির মধ্যে অন্যতম এই গোপীনাথ। বালাসোর জেলার কেন্দ্রস্থল থেকে প্রায়
৬ কিমি দূরে এর অবস্থান।
একসময় পুরীধাম যাওয়ার রাস্তাতেই পড়ত এই অঞ্চল।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু পুরী গিয়েছিলেন এই পথ ধরেই। এই কারণেই এই রাস্তার নামকরণ হয়
গৌরদাণ্ড।
শুধু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুই নন, শ্রীল
মাধবেন্দ্র পুরী, রসিকানন্দ প্রভু, শ্রী
শ্যামানন্দ প্রভুরও পদধূলিধন্য রেমুণার এই মন্দির।
বর্তমানে শ্যামানন্দ গাদি দ্বারা এই মন্দিরের সেবা ও
পূজা অর্চনাদি সম্পন্ন হয়। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী বনবাসে থাকাকালীন একদিন
সীতাদেবীকে নিয়ে রামচন্দ্র চিত্রকূটের কামোদগিরি পর্বতে বসেছিলেন। সেই সময় হঠাৎই
ঝড় শুরু হলে আশপাশের জঙ্গলে যে সমস্ত গরুগুলি ঘাস খাচ্ছিল তারা প্রাণ বাঁচাতে
চিত্রকূট পর্বতে যে সমস্ত তপস্বীরা আশ্রম করেছিলেন, যেখানে নিজ নিজ
গোশালায় সেই গাভীরা থাকত, সেই অভিমুখে ছুটতে থাকে। তাদের
সঙ্গে সঙ্গে তাদের চড়াতে যাওয়া রাখালরাও নিজ নিজ গোশালার উদ্দেশে ছুটে যেতে চায়।
এই গাভী এবং রাখালদের এভাবে ছুটে আসতে দেখে শ্রীরামচন্দ্র স্মিত হেসে ওঠেন। মা
সীতা শ্রীরামচন্দ্রের এই স্মিতভাবে হেসে ওঠার কারণ জানতে চাইলে শ্রীরামচন্দ্র
তাঁকে বলেন, গাভী এবং রাখাল বালকদের এইভাবে ছুটে আসতে দেখে
তাঁর দ্বাপর যুগের বিভিন্ন বিষয়, বিভিন্ন কথা স্মরণে আসছে,
তাই তিনি এভাবে হেসে উঠেছেন। তখন সীতাদেবী শ্রীরামচন্দ্রকে অনুরোধ
করলেন তাঁকে দ্বাপর যুগের লীলা দর্শন করানোর জন্য।
পরবর্তী সময়ে শ্রীরামচন্দ্র একটি বড় পাথরের বুকে তির
দিয়ে দ্বাপর যুগের শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন লীলা, গোপিনী, গাভী
প্রভৃতি আঁকতে লাগলেন। যথারীতি এই সব কাজে বেশ কয়েকদিন কেটে গেল। আর ধৈর্য্য ধরতে
না পেরে তখন সীতাদেবী শ্রীরামকে দ্বাপর যুগের সেই মূর্তি দেখানোর জন্য কাতর আর্জি
জানালে শ্রীরামচন্দ্র তাঁকে সেই অসম্পূর্ণ বিগ্রহই দর্শন করালেন। সেই অসম্পূর্ণ
বিগ্রহে চক্ষুদান করলেন সীতাদেবী। তাঁর স্পর্শে সেই বিগ্রহে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হল।
আর এরপরেই ঘটল এক চমকপ্রদ ঘটনা। অসম্পূর্ণ বিগ্রহের কাজ শেষ করতে শ্রীরামচন্দ্র
তিরের ফলা দিয়ে বিগ্রহের অঙ্গ স্পর্শ করতেই মূর্তি থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হল। বিগ্রহে
প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে বুঝতে পেরে তখন সীতাদেবী বিগ্রহের অভিষেক করালেন এবং
সেবাপূজা শুরু করলেন।
এর কিছুকাল পর থেকেই রাক্ষসদের উপদ্রব থেকে রক্ষা পাওয়ার
জন্য শ্রীরামচন্দ্র সীতাদেবী এবং অনুজ লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে অত্রি মুনির আশ্রমে
চলে গেলেন। তখন স্বয়ং ব্রহ্মা চিত্রকূট পর্বতে এসে সেই স্বয়ম্ভূ বিগ্রহের সেবা করা
শুরু করলেন।
এখনও কামোদগিরি পাহাড় লক্ষ্মণ পাহাড় নামেই পরিচিত। এখনও
এই পাহাড়ে রাম,
সীতা, লক্ষ্মণ ও গোপীনাথের বিগ্রহ রয়েছে।
এর বহু পরে কলিযুগে ওড়িশার গঙ্গা বংশীয় রাজা প্রথম
লাঙ্গুলা নরসিংহদেব তীর্থ দর্শনে বেরিয়ে এই মনোহর গোপীনাথ বিগ্রহকে নীলাচলে নিয়ে
গিয়ে তার সেবা করার বাসনা প্রকাশ করেন। এদিকে ঘটে গেল আর এক অলৌকিক ঘটনা। একদিন
রাতে সেই বিগ্রহ রাজাকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে জানালেন, 'আমার নাম মদন
গোপাল। আমি দীর্ঘদিন ধরে এই কামোদগিরি পাহাড়ে অবস্থান করছি। এখন আমার অভিলাষ কোনও
রমনীয় স্থানে গিয়ে অবস্থান করব। তুমি সেই ব্যবস্থা করো।'
স্বপ্নাদেশ পেয়ে আপ্লুত রাজা বিগ্রহকে নিজ রাজ্যে নিয়ে
যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। যাওয়ার পথেই লোকমুখে মদনগোপালের নাম হয়ে গেল জয়গোপাল।
নীলাচলে যাওয়ার পথেই পড়ল রেমুণা গ্রাম। সেখানে আসতেই ঘোষপল্লিতে মদনগোপাল থেকে
যাওয়ার অভিলাষ জানালেন রাজাকে। রাজার সঙ্গে থাকা ও গ্রামবাসী ভক্তকুল দুধ, দই, ক্ষীর দিয়ে বিগ্রহের সেবা করালেন। রানি তাঁকে সম্বোধন করলেন গোপীনাথ নামে
এবং তাঁর জন্য পুজো-ভোগ ইত্যাদির ব্যবস্থা করলেন। এই রানিই মদনগোপালকে গোপীনাথের
জন্য প্রত্যহ ১২ ভাঁড় ক্ষীর ভোগের ব্যবস্থা করেন।
এর অনেক পরে ১৫৬৮ খ্রিষ্টাব্দে কালাপাহাড়ের আক্রমণ হয়
এখানে। কালাপাহাড়ের আক্রমণের ভয়ে মন্দিরের সেবকরা অনন্তসাগর পুষ্করিণীর জলে
গোপীনাথের বিগ্রহকে লুকিয়ে রাখেন এবং তার পরিবর্তে মন্দিরে বাসুদেব বিগ্রহ রেখে
দেন। কালাপাহাড় সেই সময় গোপীনাথ মন্দির ধ্বংস করেন এবং বিগ্রহ বিনষ্ট করে ফেলেন।
পরবর্তী সময় শ্রী শ্যামানন্দ প্রভু মূল গোপীনাথ বিগ্রহ
উদ্ধার করেন এবং মন্দিরে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।
আবার কেউ কেউ বলেন, বর্তমান মন্দিরটি রসিকানন্দ
প্রভুর শিষ্য ময়ূরভঞ্জের রাজা শ্রী বৈদ্যনাথ ভঞ্জদেব নির্মাণ করেন। মন্দির
প্রাঙ্গণের বামদিকে মূলমন্দিরের অবস্থান। সামনে ছোট একটি রাস মণ্ডপ ও নাট মন্দির
রয়েছে। মন্দিরের গর্ভগৃহে শ্রী গোবিন্দ, মদনমোহন অধিষ্ঠিত।
এই দুই বিগ্রহের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে ক্ষীরচোরা গোপীনাথের বিগ্রহ।
শ্রীশ্রী শ্যামানন্দ গাদির তৃতীয় মহন্ত শ্রী নয়নানন্দদেব
গোস্বামীর মধ্যস্থতায় তিহড়ির সামন্ত রাজা শ্রী মদনমোহন ও শ্রী গোবিন্দজিউ-এর
প্রস্তর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। আবার মতান্তরে শ্রী রসিকানন্দ প্রভু এই বিগ্রহের
প্রতিষ্ঠা করেন।
মন্দির চত্বরে নাট মন্দিরের পিছনে রসিকানন্দ প্রভুর
বাসগৃহ এবং তার পাশেই তাঁর সমাধি মন্দির আছে। এখানে রসিকানন্দ প্রভুর বাসভবনে তিনি
থাকতেন। এখানেই রক্ষিত আছে তাঁর পাদুকা।
রাস মণ্ডপের পিছনে এক মণ্ডপে রয়েছে শ্রী ভক্তিসিদ্ধান্ত
সরস্বতী ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পাদপদ্মের প্রতিকৃতি।
প্রতিদিনই এই মন্দিরে অসংখ্য ভক্ত পুজো দিতে আসেন। তাঁরা
মনে করেন, এই মন্দিরে প্রার্থনা করলে মনোস্কামনা পূর্ণ হয়।
মন্দিরটির ইতিহাস নিয়েও মতপার্থক্য আছে। কারও কারও মতে, প্রায় ৫০০ বছর
আগে যখন মাধবেন্দ্র পুরী তাঁর বৃন্দাবনস্থিত গোপালের জন্য কিছু চন্দনকাঠ নিয়ে পুরীধামের
উদ্দেশে যাত্রা করছিলেন তখন তিনি তাঁর চলার পথে এই রেমুণা গ্রামে এসে গোপীনাথকে
দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়েন এবং এখানেই গোপীনাথ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করবেন ঠিক করেন।
মন্দির নির্মাণের পর এখানকার মন্দির সংলগ্ন চত্বরেই
মাধবেন্দ্রপুরী কীর্তন ও নৃত্য করেন। তখন এক পুরোহিত ব্রাহ্মণ তাঁকে কিছু প্রশ্ন
করলে মাধবেন্দ্র পুরী নিজেই সকলকে অবহিত করেন যে, কীভাবে,
কী প্রসাদে এখানে ভগবান গোপীনাথকে দিতে হবে। শোনা যায়, সেই ব্রাহ্মণ পুরোহিত তখন তাঁকে জানান যে, বর্তমান
সময়ে গোপীনাথকে বারোটি আধারে মিষ্টান্ন দিয়ে পুজো করা হয়েছে, যার নাম অমৃত কেলি। আজও শুধু এই মন্দিরে নয়, বিভিন্ন
স্থানে এই প্রসাদ দেওয়া হয় যার নাম গোপীনাথ ক্ষীর।
যাই হোক, ক্ষীর দিয়ে গোপীনাথকে পুজোর দেওয়ার সময়
মাধবেন্দ্র পুরী ওই পুজোর প্রসাদের জন্য নিবেদন করা পরমান্নর সামান্য অংশ নিজের
জন্য চাইলেন এবং সেই প্রসাদ গোপীনাথের পছন্দ হবে কি না তা নিয়ে কৌতূহল ব্যক্ত
করলেন।
পুরোহিতরা মাধবেন্দ্রপুরীকে একটু পরমান্ন দিলে তিনি তা
ভক্ষণ করেন এবং বুঝতে পারেন, এভাবে গোপীনাথের উদ্দেশে নিবেদন করার
আগে তাঁর এভাবে পরমান্নর স্বাদ ভক্ষণ করা রীতিমতো অপরাধ হয়েছে। তখন তিনি নিজেকে
অপরাধী ভেবে নিয়ে একস্থানে গিয়ে বিষণ্ণ মনে চুপচাপ বসে থাকেন।
এদিকে পুজোর পরে যখন পুরোহিত বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, তখন তিনি এক
স্বপ্নে দেখতে পান, গোপীনাথ তাঁকে স্বপ্নে নির্দেশ দিচ্ছেন
যে একপাত্র ক্ষীর বা পরমান্ন যেন মাধবেন্দ্রপুরীকে নিবেদন করা হয়।
সেইমতো পুরোহিত এক পাত্র ক্ষীর এনে তাঁর শয্যার কাছে
লুকিয়ে রেখে দেন এবং পরে ঘুম ভাঙলে সেই পাত্রটি মাধবেন্দ্রপুরীকে দিয়ে বলেন, 'স্বয়ং গোপীনাথ
আপনার জন্য এই ক্ষীর চুরি করে রেখেছেন। আপনিই একমাত্র সেই পুণ্যবান মানুষ যাঁর
জন্য স্বয়ং গোপীনাথ ক্ষীর চুরি করলেন।'
সেই থেকেই নাম ক্ষীরচোরা গোপীনাথ। আবার কারও কারও মতে এই
মন্দির প্রায় ৬০০ বছরের প্রাচীন।
আবার কেউ কেউ মনে করেন এই মন্দির প্রায় দেড়শো বছরের কিছু
বেশি সময় আগে নির্মিত। কেউ কেউ বলেন, বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করেন
রসিকানন্দ প্রভুর শিষ্য ময়ূরভঞ্জের রাজা শ্রী বৈদ্যধর ভক্তদেও।
রেমুণার ক্ষীরচোরা গোপীনাথ মন্দির যাওয়ার জন্য সবচেয়ে
ভালো হাওড়া থেকে যেকোনও ট্রেন (পুরী, ভুবনেশ্বর, কটকগামী
যে কোনও ট্রেনই যাচ্ছে বালাসোর স্টেশন দিয়ে) ধরে সরাসরি বালাসোর এসে নামা। বালাসোর
থেকে মাত্র ৬ কিমি পথ রেমুণা। যাওয়া যায় অটো, গাড়ি নিয়ে।
রেমুণার এই ক্ষীরচোরা গোপীনাথ দর্শন করা যায় বালাসোর এবং
নিকটবর্তী জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র চাঁদিপুর সি বিচ থেকেও।
বালাসোর এবং চাঁদিপুর দু'জায়গাতেই আছে
ওড়িশা পর্যটন উন্নয়ন নিগমের ট্যুরিস্ট লজ। এছাড়াও দুই স্থানেই আছে বেশ কিছু
বেসরকারি হোটেল।
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক পরিচিতি -
জন্ম কলকাতায়। দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতা করেন। সাপ্তাহিক বর্তমানে ভ্রমণ নিয়ে নিয়মিত লেখেন। বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে এবং তথ্য সংগ্রহে আনন্দ পান ।
ছবি - সংশ্লিস্ট সংস্থার সৌজন্যে