Advt

Advt

madhurena-samapoyet-story-golpo-by-rekha-nath-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-মধুরেণ-সমাপয়েৎ-গল্প-রেখা-নাথ

madhurena-samapoyet-story-golpo-by-rekha-nath-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-মধুরেণ-সমাপয়েৎ-গল্প-রেখা-নাথ

সুবলদার বাড়ির গৃহপ্রবেশে আমাদের সকলকার নিমন্ত্রণ। আমরা সবাই যাব। সুবলদা যে বাড়ি করতে পারে আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল। তাই প্রচণ্ড আগ্রহ। কেমন বাড়ি করল সে।

ছোটখাটো বাড়ি। একতলা। দু-কামরার। ছোট্ট একটা রান্নাঘর। বাথরুম-পাখানা সবই করেছে। একফালি উঠোনও আছে।

বাড়ি দেখে বড়দা বলল-'যাহোক সুবল এতদিনে একটা কাজের মত কাজ করেছে। দিল্লির মত জায়গায় একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই তো করেছে।'

বউদি বলল-'মিতার মত বউ পেয়েছে বলে সুবল,এ জীবনে উতরে গেল। কী বলো?'

বড়দা হাসতে হাসতে বলল-'সে দিক দিয়ে আমাদের সুবল সৌভাগ্যবান।

যাক,এ যাত্রায় সব ঠিক-ঠাকই হয়েছে। ভূরিভোজ নাহোক কিন্তু সুবলটা ভালই খাইয়েছে। বাড়ি গিয়ে আর খেতে হবে না।'

আমি বউদিকে বললাম- 'বউদি, তোমার মনে আছে, সুবলদার বাড়িতে প্রথম নিমন্ত্রণের ঘটনা।'

'মনে আবার থাকবে না।' হাসতে হাসতে বউদি বলল।

মনে আছে একবার সুবলদার ব্যাচেলার ডেনে নিমন্ত্রণ খেতে গেছি আমি,বউদি ও ছোরদা। অবশ্য নিমন্ত্রণটা আমরা যেচে নিয়েছিলাম। চাকরি পাওয়ার পর সুবলদা আমাদের বাড়ি ছেড়ে ভাড়া বাড়িতে উঠে গেল। তখন সুবলদা দুবেলা ঢাবাতে খাচ্ছে আর পেটের রোগে ভুগছে।

বউদি সুবলদাকে প্রায়ই বলত-'সুবল রান্নাটা শিখে নাও। বাড়িতে নিজে রান্না-বান্না করে খেও, শরীর স্বাস্থ ভাল থাকবে।'

তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে সুবলদা বলত-'রান্না কী শিখতে লাগে নাকি!'

-'তাই বুঝি'!! শেষে বউদির জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে সুবলদা নিজের হাত পুড়িয়ে রান্না-বান্না শুরু করল তখন বউদি ও ছোরদার চাপে পড়ে একদিন সুবলদা আমাদের নিমন্ত্রণ করে বসল। বলল-'মাছের ঝোল-ভাত খাওয়াবে।'

আমরা বললাম-'তথাস্তু।' গিয়ে দেখি, সুবলদা মাছের ঝোল রাঁধছে। কড়া ভর্তি মাছের ঝোল। টগবগ করে ঝোল ফুটছে আর কড়ার চারদিকে ঝোল ছিটকে-ছিটকে পড়ছে। থালায় তুলে রাখা ভাছা মাছগুলি থেকে একটা-একটা করে মাছ কড়াতে ঢালছে আর আর্কমিডিজের সিধান্ত অনুযায়ী মাছের ভারের সমান ঝোল কড়া থেকে উপচে-উপচে পড়ছে। খাবার মেনু-'ডাল-ভাত, পাঁপড় ভাজা ও মাছের কোল। বাহ খাসা মেনু ছোরদা বলে উঠল।'

খেতে বসে ডাল দেখে ছোরদা বলল-'কোমরে গামছা বেঁধে ডালের পুকুরে নেমে যেতে ইচ্ছে করছে।' ডাল মেখে ভাতের এক গ্রাস মুখে দিতেই ওয়াক করে উঠল ছোরদা। 'একী। ডালে তো পোড়া গন্ধ। আর ভাতের চাল যেন থান ইট। ছুঁড়ে মারলে কপাল ফেটে যাবে।'

সুবলদা বলল-'ডালটা একটু ধরে গিয়েছিল তাই জল ঢেলে দিয়েছি।' ট্যালট্যালে মাছের ঝোলের কথা নাই বা বললাম। সুবলদার কীর্তি-কলাপের সঙ্গে আমাদের বেশ ভাল রকম পরিচয় ছিল বলে তাই সেদিন বাড়ি থেকে আমরা প্রচুর রান্না-বান্না করে খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম তাই না খেয়ে বাড়ি ফিরতে হয়নি।

সবজান্তা সুবলদা আমাদের মেজ কাকার ছোট ছেলে। কাকারা বর্ধমানে থাকেন। সুবলদা বি.এস.সি. পাস করে চার বছর ধরে বাড়িতে বসে আছে। চাকরি-টাকরী কিছু পানি। আড্ডা মেরে দিনপাত করছে তাই কাকা ওকে দিল্লিতে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। বড়দা ব্যাঙ্কের ম্যানেজার সেই সুবাদে বড়দা যদি ওর কোনও হিল্লে করে দেয়। সুবলদা আপদমস্ততক ভাল ছেলে কোনও নেশা-টেশা নেই। কোনও কাজে না নেই। সহাস্য বদনে আপনার কাজ করে দেবে। তার কাজটা আপনার যদি মনঃপূত না হয় তাহলে দোষটা তো আর তার ওপর বর্তায় না। একদিন আমি,বৌদি ও বউদির বোন সিনেমা দেখতে গেছি বত্রাতে। সুবলদা টিকিট কেটে দিয়েছে আমাদের। হলে ঢুকতে যাব গেটম্যান আমাদের আটকে দিল,বলল-'একজনকে ফ্রন্ট স্টলে বসতে হবে। কারণ দুটো ব্যালকনির ও একটা ফ্রন্ট স্টলের টিকিট রয়েছে।' বউদি ক্ষেপে লাল। সে যাত্রায় আমাদের সিনেমা দেখা হয়নি। বাড়ি ফিরে সুবলদাকে খুব বকা দিয়েছিল বউদি। সুবলদার সাফ উত্তর-'ব্যালকনির মাত্র দুটো টিকিটই পেলাম এবং একদম সামনের দিকে টিকিট পাওয়া যাচ্ছিল বলে একটা নিয়ে নিলাম। সিনেমা দেখা তো যাবে।' ঘটনাটা আমরা বাড়িতে বলিনি কারণ বুমেরাং হয়ে আমাদেরই বিধত। যাওয়ার আগে টিকিটটা আমরা দেখিনি কেন?

সুবলদাকে মাঝে-মধ্যে মা বাজারে পাঠাতেন। তারপর দেখা গেল বাজারের যত ওঁছা জিনিস থলে ভর্তি করে নিয়ে আসছে সুবলদা। বেশিরভাগই ফেলাযেত। সেই থেকে তার বাজারের কাজটাও বন্ধ হয়ে গেল। সুবলদার কাজের বহর দেখে,আমরা কেউই ভয়ে সুবলদাকে কোনও কাজ বলতাম না। কেবল পুজো-আচ্চায় আমপাতা ও বেলপাতা এনে দেওয়ার কার্যভারটা ওর ওপর ন্যাস্ত হত। পুজোর একদিন আগেই বলা হত কারণ পুজোর দিন আনতে বললে,হয়ত দেখা যাবে পুজোর শেষে এনে উপস্থিত হচ্ছে। এই বেলপাতা-আমপাতা জোগাড় করতে গিয়ে সুবলদা কয়েক বারই কুকুরের কামড় খেয়েছে। সুবলদার সঙ্গে পাড়ার কুকুরের অটুট বৈরিতা। সুবলদাকে দেখলেই পাড়ার কুকুরগুলো ঘেউ-ঘেউ করে ওর দিকে তেড়ে যাবে আর সুবলদাও প্রাণপণে ছুটবে। সুবলদাকে নাকি সাতবার কুকুরে কামড়েছে। ছোড়দা বলে-'এই সুবল, তোর তো গিনিজবুকে রেকর্ড হয়ে গেছে। সাত-সাত বার কুকুরে কামড়েছে। তুই যেন ভুলেও কখনও কারোকে কামড়াস না। যাবজ্জীবন কারাবাস হয়ে যাবে কারণ তুই কামড়ালেই সে নির্ঘাৎ অক্কা পাবে।'

হঠাৎ একদিন দেখি ডীপ-ফ্রিজে অনেকগুলি ওষুধের শিশি রাখা। কে রেখেছে? কে রেখেছে? জানা গেল সুবলদা রেখেছে। সুবলদাকে যথারীতি কুকুরে কামড়েছে। চোদ্দটা ইঞ্জেকশান লাগবে। তাই সুবলদা চোদ্দটা ইঞ্জেকশানের ওষুধ একসঙ্গে কিনে এনেছে। ওর জানাশোনা কোনও কম্পাউন্ডার আছে সে সুবলদাকে বিনে পয়সায় ইঞ্জেকশান লাগিয়ে দেবে। তাই চোদ্দটা ওষুধের শিশি সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থানে গুছিয়ে রেখেছে!!!

বকবকে পন্ডিত সুবলদা একবার মুখ খুললে আর থামতে চায় না আর তার সম্মুখে তখন হাইতোলা ছাড়া মুখ খোলার সুযোগ পাওয়া যায় না। একমাত্র বড়দার ধমক ছাড়া তার মুখ বন্ধ হয় না। কোনও কাজ-কর্ম নেই অতএব সুবলদার দিন-রাত আড্ডা মেরেই দিন কাটছে। শেষমেষ অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে বড়দা তাকে একটা ফ্যাক্টারীতে ঢুকিয়ে দিয়েছে। দু-বছর হয়ে গেল চাকরি করছে সুবলদা। কিন্তু আড্ডা মারাটা তার অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে কাকা ইহলোক ত্যাগ করেছেন। কাকিমা আমাদের কাছে এসে রয়েছেন। ইচ্ছে ছোটছেলের বিয়ে দেবেন। কারণ কাকার অবর্তমানে এখন সুবলদাকে সংসারী করার দায়িত্ব তাঁরই। এবং স্বাভাবিকভাবেই পাত্রী খোঁজার ভারটা বউদির ওপরেই ন্যস্ত হয়েছে। কাগজে ম্যাট্রিমোনিয়াল কলামে সুবলদার জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। জানাশোনা সকলকে বলা হয়েছে। জোরকদমে চলছে পাত্রী খোঁজা। পাত্রীপক্ষ থেকেও যোগাযোগ করছে।

এইবার একদিন সুবলদার খোঁজ-খবর নিতে এক পাত্রীর বাবা এলেন আমাদের বাড়িতে। সুবলদা তো আহ্লাদে আটখানা।। জামাই হওয়ার অভীলাসায় পাট-ভাঙা পাজামা,পাঞ্জাবী পরে মাঞ্জা দেওয়া চেহারা নিয়ে সুবলদা ভদ্রলোক,মি.রায়ের সম্মুখে উপস্থিত হল। আলাপ-পরিচয়ের প্রাথমিক পর্ব সাঙ্গ হলে মিস্টার রায় সুবলদাকে জিজ্ঞেস করলেন-'কোথায় চাকরি করেন? কী পোস্টে কাজ করেন?' ইত্যাদি, ইত্যাদি।

সুবলদা অতি উৎসাহের সঙ্গে বলতে শুরু করল-'ট্যালব্রস কোম্পানিতে কাজ করি। অফিসে আমাকে সবাই এক ডাকে চেনে। অফিসে আমি বাঙালি দাদা বলে ফেমাস। বস তো আমার কাজে এত খুশি যে,এ বছরে আমাকেই শুধু প্রমোশন দিয়েছে। আগে এ্যাসিসটেন্ট কেমিস্ট ছিলাম এখন এ্যাটেন্ডেন্ট টু চিফ কেমিস্ট হয়েছি।'

বউদির কটমট চোখের দিকে তাকাবার ফুরসৎই নেই সুবলদার। বেজে যাচ্ছে তার আত্মপ্রশংসার ঢক্কানিনাদ!!

আমি মনে-মনে হাসছি আর ভাবছি-'সুবলদার প্রমোশন নয় ডিমোশন হয়েছে সেটাও কি সে বোঝেনি। অথচ সবাইকে বড় গলা করে বলে বেড়াচ্ছে যে তার প্রমোশন হয়েছে।'

ওঁদের কথোপকথনের মাঝে আমাদের কাজের মেয়ে বাসন্তী, মিষ্টি,সিঙারা ও চা নিয়ে এসে সেন্টার টেবিলে রাখে। বউদি মি.রায়কে জিজ্ঞেস করলেন-'আপনার চায়ে কতটা চিনি দেব? এক চামচ?'

মি.রায় সলজ্জ হেসে বললেন-'আমি চায়ে একটু বেশী মিষ্টি খাই। দু-চামচ দেবেন।'

হঠাৎ বিজ্ঞের মত সুবলদা বলে উঠল-'আমাদের অফিসেও লেবার ক্লাসের লোকগুলি চায়ে বেশি মিষ্টি খায়!'

মি.রায়ের চলে যাওয়ার পর সুবলদাকে বউদির আল্টিমেটাম- 'এরপর যদি কোনওদিন পাত্রীপক্ষের সামনে অযাচিতভাবে মুখ খোল তাহলে তোমার বিয়ের ব্যাপারে আমি নেই। যেটুকু জিজ্ঞস করা হবে শুধু সেটুকুরই উত্তর দেবে।'

এর বেশ কয়েক মাস পর আর এক পাত্রীর বাবা,মি. চৌধুরী, পেশায় উকিল এলেন আমাদের বাড়িতে। যথারীতি সুবলদা ফুলবাবু সেজে উপস্থিত। বড়দা ছিল না অফিস ট্যুরে গেছে বাইরে। প্রাথমিক আলাপ-পরিচয় শেষ হয়েছে। চা,মিষ্টি ও ডালমুট খাওয়া হয়ে গেছে। মি. চৌধুরী বেশ জমিয়ে গল্প করছেন বউদির সঙ্গে কিন্তু সুবলদাকে কিছু জিজ্ঞেস করছেন না দেখে সুবলদা ক্রমাগত উসখুশ করছে। এমন জমাটি গল্পের আসরে কিছু না বলতে পারায় সুবলদার পেট আইঢাই করছে কিন্তু বউদির ভয়ে সুবোধ বালকের মত চুপচাপ বসে আছে।

কথায়- কথায় জানা গেল যে বউদির ছোটবেলার এক বান্ধবীকে মি. চৌধুরী চেনেন।

বউদি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল-'আচ্ছা, মঞ্জুষাদের আপনি চেনেন?'

-'হ্যাঁ খুব ভাল করে। ওদের সব নাড়ি-নক্ষত্র আমার জানা।'

এতক্ষণ সুবলদা অতি কষ্টে নিজেকে সংযত রেখেছিল। বউদির ভয়ে 'স্পিকটি নট' হয়ে বসেছিল। নিজের জ্ঞান জাহির করার এমন সুযোগ হাতছাড়া করা যায়।

ফসকরে সুবলদা বলে উঠল-'আচ্ছা,আপনি তাহলে ডাক্তার!'

সুবলদার এরকম হাজারো কীর্তি-কলাপ রয়েছে। লিখলে আর একটা মহাভারত হয়ে যাবে। এই অল্প পরিসরে সম্ভব নয়। সর্বোপরি সুবলদা বিয়ে করে সুখে সংসার করছে। দুটি সন্তানের জনক। এটাই সবচেয়ে আনন্দের কথা!

লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।

 লেখিকার পরিচিতিঃ 

যদিও জন্ম পলাশীপাড়ানদিয়া জেলাপশ্চিমবঙ্গকিন্তু তাঁর শৈশববেড়ে ওঠাশিক্ষা-দীক্ষা সব এলাহাবাদেই। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থশাস্ত্রে এম.এ.। ১৯৮১ সালে এলাহাবাদ থেকে একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা "তূণীর" প্রকাশ করতেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় (দেশে ও বিদেশে) লেখা প্রকাশিত হয়। হিন্দী ও ইংরাজিতেও লেখা প্রকাশিত হয়েছে। পানামার কবিরোখেলিও সিনান এর দশটি স্প্যানিশ কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেছেন। 'অনুশীলন পত্রিকা'সুইডেন থেকে রাইটার্স অ্যাওয়ার্ড ২০১৩ সালে পেয়েছেন। ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছে "ঈশ্বর ও মানুষ" ( অণু গল্প ও ছোট গল্প সংকলন)। লেখিকার অভিজ্ঞতাজাত কোভিড  সংক্রান্ত বই "কোভিড-১৯ আমার জীবন আমার লড়াই" গাঙচিল থেকে প্রকাশিত হয়েছেডিসেম্বর ২০২২ সালে।