হিমাচলপ্রদেশ ভ্রমণের এক অবশ্য গন্তব্য পর্যটনকেন্দ্র
শৈলশহর মানালি। এই মানালিরই খুব কাছের এক পবিত্র মন্দির 'হিড়িম্বা মন্দির'। হিমাচলপ্রদেশের কুলু জেলায় অরণ্যের মধ্যে রয়েছে এই প্রায় অর্ধ সহস্র
বছরের সুপ্রাচীন মন্দির।
না। শুধু দেব-দেবীই নন। একজন রাক্ষসীও যে দেবীরূপে পুজো
পেতে পারেন,তা এই হিড়িম্বা মন্দিরে না এলে বিশ্বাস করা কঠিন। এক রাক্ষসীকে কেন্দ্র
করেই গড়ে উঠেছে এই মন্দির।
প্রচলিত বিশ্বাস,বারণাবতে জতুগৃহকান্ডর পর
পঞ্চপাণ্ডব এসে পৌঁছন এক গহন অরণ্যে। এই অরণ্য ছিল রাক্ষস হিড়িম্বর দখলে।
পাণ্ডবদের এই অরণ্যে থাকার খবর পেয়ে হিড়িম্বারাক্ষস তখন পাণ্ডবদের ধরে আনার জন্য
পাঠান তার সহোদরা হিড়িম্বাকে। কিন্তু হিড়িম্বা সেই মুহূর্তে প্রেমে পড়ে যান ভীমের।
অগত্যা প্রবল যুদ্ধ বাধে হিড়িম্ব এবং ভীমের মধ্যে। ভয়ানক যুদ্ধের শেষে প্রাণ হারান
রাক্ষস হিড়িম্ব। এদিকে ভীমের প্রেমে তখন আপ্রাণ মজে আছেন রাক্ষসী হিড়িম্বা। কিন্তু
ভীম তাঁকে বা তাঁর প্রেম স্বীকার করতে নারাজ। অবশেষে কুন্তিদেবীর মধ্যস্থতায় ভীম
রাজি হন হিড়িম্বাকে বিয়ে করতে। এখানেই তাঁদের বিয়ে হয় এবং ভীম ও হিড়িম্বার পুত্র
হয় ঘটোৎকচ। ধূলাগিরি বনবিহার নামেই পরিচিত এই অরণ্য। রয়েছে ভীম এবং ঘটোৎকচের
মন্দিরও। এই হিড়িম্বাদেবীর মন্দিরে হিড়িম্বা দেবীর পায়ের ছাপ রয়েছে বলে অনেক ভক্ত
মনে করেন। প্রচলিত বিশ্বাস, রাক্ষসী থেকে দেবীত্বে উত্তীর্ণ
হয়েছিলেন হিড়িম্বা। যেমন পুরাণ মতে ক্ষত্রিয় থেকে ব্রাহ্মণের গুণ অর্জন করেছিলেন
বিশ্বামিত্র। তিনি এই গুণ অর্জন করেন প্রচণ্ড সাধনার বলে। দেব-ঋষি-রাক্ষসের
কাহিনির বাইরে গিয়েও লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য সাধনার কথা বলে এইসব আখ্যান। তাই এই
হিডিম্বা মন্দিরের দেবী হলেন সকলের কাছে 'মা'। তাঁকে বলা হয় 'মানালির মা'।
মন্দিরটিকে কেন্দ্র করে আরও কিছু চমকপ্রদ কাহিনি শোনা যায়।
শোনা যায় যে যে নিম্নী এই মন্দির তৈরি করেছিলেন তিনি যাতে অনুরূপ আর কোনও মন্দির
নির্মাণ করতে না পারেন, তার জন্য তাঁর ডানহাতটি কেটে নেওয়া হয়। কিন্তু অদম্য
মনোবলে এবং শৈল্পিক দক্ষতায় সেই শিল্পী এক হাতেই গড়ে তোলেন চাম্বায় ত্রিলোকনাথের
মন্দির।
প্যাগোডা আকৃতির মন্দিরটি নির্মিত হয় ১৫৫৩ সালে। ২৩
মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট তিনচালা কাঠের থামের মন্দিরটির শিল্পশৈলী দেখার মতো। এর
দেওয়াল পাথরের। আর দরজা কাঠের। এই কাঠের দরজায় রয়েছে নানা কারুকার্য। ১৫৫৩-তে
মহারাজ বাহাদুর সিংহ এই মন্দিরের নির্মাতা।
হিন্দু মন্দিরে বৌদ্ধ প্যালেসের শিল্পশৈলী দিয়ে সম্পূর্ণ
মন্দিরটি সাজানো হয়েছে বিভিন্ন পশুর শিং দিয়ে। মন্দিরের চারদিকে পাইন,ফার আর দেবদারুর
জঙ্গল।
হিড়িম্বা দেবীর মন্দির থেকে একটু দূরেই আর এক ছোট মন্দির
ঘটোৎকচের মন্দির। হিড়িম্বা মন্দিরের অভ্যন্তরে রয়েছে এক বিশাল কালো রঙের পাথর।
ভক্তদের বিশ্বাস,ওই কালো পাথরের নীচেই ধ্যানে বসতেন হিড়িম্বা দেবী। গোটা মন্দিরজুড়েই কাঠের
অসাধারণ শিল্পকর্ম।
প্রতিদিনই এই মন্দিরে পুজো হয়। তবে নবরাত্রির সময় এখানে
বিশেষ পুজো এবং সেই পুজো ও উৎসব উপলক্ষ্যে লক্ষ লক্ষ ভক্তর সমাগম ঘটে। আবার কুলুর,চালপুর ময়দানে
ধুমধাম করে পালিত হওয়া দশেরা উৎসবের সঙ্গেও ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে এই মন্দির।
হিড়িম্বা মন্দির যাওয়ার জন্য প্রথমে আসতে হবে মানালি।
মানালি থেকে হিড়িম্বা মন্দিরের দূরত্ব মাত্র ২ কিমি। সিমলা, চণ্ডীগড়,
দিল্লি, পাঠানকোট, কুলু
সব জায়গা থেকেই বাস আসছে মানালি।
প্রথমে হাওড়া-কালকা মেলে কালকা পৌঁছে সেখান থেকে ন্যারো
গেজের ট্রেনে,বাসে অথবা গাড়িতে পৌঁছতে হবে সিমলা। সিমলা থেকে বাস যাচ্ছে মানালি। দূরত্ব
যথাক্রমে সিমলা ২৬০ কিমি,চণ্ডীগড় ৩২৩ কিমি,দিল্লি ৫৭৫ কিমি,পাঠানকোট ৩১৮ কিমি এবং কুলু মাত্র
৪০ কিমি। এইচ পি টি ডি সি-র ট্রান্সপোর্ট উইংয়ের বাসও চলছে দিল্লি এবং সিমলা থেকে
মানালি।
মানালিতে থাকার জন্য রয়েছে এইচ পি টি ডি সি-র বেশ কয়েকটি
হোটেল। দ্য লগ হাউস (২৫৩২২৫-২৬ ইমেল manali@hptdc.in,দ্য অরচার্ড
হাউস (২৫৩২২৫-২৬,ইমেল manali@hptdc.in), দ্য কুনজুম
(২৫৩১৯৭-৯৮,ইমেল manali@hptdc.in), দ্য কুনজুম
(২৫৩১৯৭-৯৮,ইমেল manali@ hptdc.in), দ্য হামতা হাউস,হিড়িম্বা কটেজ (২৫২৩৩৪,ইমেল manali@ hptdc.in)প্রভৃতি। এছাড়াও
মানালিতে রয়েছে অসংখ্য বেসরকারি হোটেল।
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক পরিচিতি -
জন্ম কলকাতায়। দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতা করেন। সাপ্তাহিক বর্তমানে ভ্রমণ নিয়ে নিয়মিত লেখেন। বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে এবং তথ্য সংগ্রহে আনন্দ পান ।
ছবি - সংশ্লিস্ট সংস্থার সৌজন্যে