রাজস্থানের উদয়পুর থেকে প্রায় ২০ কিমি উত্তরে আরাবল্লী
পর্বতের কৈলাসপুর গ্রামে অবস্থিত এই একলিঙ্গজির মন্দির রাজস্থান তথা ভারতের অন্যতম
প্রাচীন ও পবিত্র মন্দির। এর ইতিহাসও বহু প্রাচীন। মেবারের রাণাদের পরিবারের
আরাধ্য দেবতা এই একলিঙ্গজি শিব। বর্তমান মন্দিরটি ১৫০০ শতাব্দীতে নতুন করে সংস্কার
করা হলেও এর অস্তিত্বর সন্ধান পাওয়া যায় ১৪০০ বছর আগে।
প্রাচীন ইতিহাস মতে, এই মন্দিরের
নির্মাতা মেবারের গেহলট বংশের রাজা বাপ্পা রাওয়াল। এক যুদ্ধে বাপ্পা রাওয়ালের
পরাজয়ের পর তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় হরিত রাশি নামে এক সাধুর। এরপর মেবার রাজ্যের
প্রতিষ্ঠাতা বাপ্পা রাওয়াল সন্ত হরিত রাশিকে গুরু হিসেবে মেনে নেন এবং তাঁর কাছ
থেকেই শৈব ধর্মের পাঠ নেন। এই গুরুর পরামর্শ মতোই বাপ্পা রাওয়াল ৭৩৪ খ্রিষ্টাব্দে
একটি কাঠের এবং সুরক্ষিত মন্দির নির্মাণ করেন।
বাপ্পা রাওয়াল এরপর ঘন অরণ্যের মাছে এই মন্দির নির্মাণ
করেছিলেন। গুরু হরিতরাশি বাপ্পা রাওয়ালকে একলিঙ্গজির মন্দিরের একাধারে রক্ষক, নির্মাতা,
উত্তরাধিকারী এবং মেবারের রাণা হিসেবে ঘোষণা করেন। আজও সেই প্রথা
চলছে। এখনও মেবারের বর্তমান রাণারা পুজো দিতে যান এই মন্দিরে। ১৯৪৭ সালে, স্বাধীন ভারতের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত মেবারের রাণা,
মহারাণারা এই একলিঙ্গজির নামেই জয়ধ্বনি দিয়ে তাঁদের রাজত্ব চালাতেন।
এই সময় পর্যন্ত মেবারের রাণারা মনে করতেন তাঁরা শুধুমাত্র ভগবান একলিঙ্গজির
অনুশাসন মেনেই, তাঁর প্রতিনিধি হিসেবেই রাজত্ব চালাচ্ছেন।
এই মন্দিরের উপর বিভিন্ন কারণে বারবার আক্রমণ হয়েছে।
শত্রুপক্ষ একাধিকবার মন্দির বিনষ্ট করেছে। আবার একইভাবে বারবার মন্দির পুনর্গঠন বা
সংস্কারও করা হয়েছে।
বর্তমানে যে মন্দিরটি রয়েছে সেটি সংস্কার করেন মহারাণা
মকাল (১৪২১-১৪৩৩) মহারাণা রায়মলের (১৪৭৩-১৫০৯) রাজত্বকালে এই মন্দিরের
শিবলিঙ্গটিকে কিছু পরিবর্তন করে ৫ ফুট উচ্চতার চারটি মুখ যুক্ত শিবলিঙ্গে পরিণত
করা হয়। এই চারটি মুখের মধ্যে দিয়ে চার দেবতাকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
পশ্চিমের মুখটি ব্রহ্মা,পূর্বদিকে মুখটি
সূর্যদেব, উত্তরের মুখটি বিষ্ণুদেবের এবং দক্ষিণের মুখটি
রুদ্ররূপী শিবের দ্যোতক। এই চারটি মুখাবয়বের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এসেছে কষ্টি পাথরের
দীর্ঘ শিবলিঙ্গ।
মন্দিরের উচ্চতা ৫০ ফুট, পুজোর স্থানের
সবচেয়ে গভীর ও পবিত্র অংশ এবং সভা মণ্ডপের মাছে রুপোর পাত দিয়ে একটি সুন্দর কারুকার্যখচিত
ঘেরা জায়গা তৈরি করেন মহারাণা ভাগবত সিং (১৯৫৫-১৯৮৪)। মন্দিরের দরজাটিও রুপোর।
এছাড়াও মন্দিরে আছে পার্বতী, দশানন, কালী,
গণেশ সহ বিভিন্ন বিগ্রহ।
এখনও বংশ পরম্পরায় মেবারের মহারাণারা প্রত্যেক সোমবার এই মন্দিরে আসেন দেব দর্শনে। মন্দির খোলা থাকে ভোর ৪টে থেকে সকাল সাড়ে ৬টা। বেলা সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর দেড়টা এবং বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে সন্ধ্যা পৌনে সাতটা পর্যন্ত। একলিঙ্গজি আসলে ৭০টি শিবলিঙ্গ, ১০টি গণেশ এবং ১০টি বিষ্ণুমূর্তির একটি শ্বেতপাথরের তৈরি মন্দির কমপ্লেক্স। এবং পিরামিড আকৃতির কারুকার্য মন্দিত ছাদটি। বাপ্পা রাওয়ালের প্রতিষ্ঠিত রাণাদের গৃহদেবতা কষ্টিপাথরের নির্মিত চতুর্মুখী একলিঙ্গজি বা শিবলিঙ্গের মন্দির। বাপ্পা রাওয়াল যে মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন সেটির উচ্চতা ছিল ৫০ ফুট। মন্দিরটির শিল্পশৈলীও অসাধারণ। মন্দিরটিকে পরবর্তীকালে সংস্কার করেন দ্বিতীয় মহারাণা রায়মল (১৪৭৩-১৫০৯)। তবে মন্দিরে পুজো, দর্শন বাইরে থেকে করাই নিয়ম।
আবু রোড আর মারোয়াড় হয়ে বাস চলছে উদয়পুর। আবার আবু রোড
থেকে ট্রেনও যাচ্ছে উদয়পুর। উদয়পুর থেকে বাস, ট্যাক্সিতে আসা যায় ২৫ কিমি দূরে
একলিঙ্গজি মন্দিরে। আবার উদয়পুর থেকে প্যাকেজ ট্যুরেও ঘুরে নেওয়া যায় এই মন্দির।
উদয়পুরে থাকার জন্য রয়েছে বিভিন্ন মানের ও নানা ভাড়ার হোটেল। এখানে হোটেলের প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারেন কলকাতায় আরটিটিডিসি'-র অফিসে।
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক পরিচিতি -
জন্ম কলকাতায়। দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতা করেন। সাপ্তাহিক বর্তমানে ভ্রমণ নিয়ে নিয়মিত লেখেন। বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে এবং তথ্য সংগ্রহে আনন্দ পান ।
ছবি - সংশ্লিস্ট সংস্থার সৌজন্যে