কাক ভোরে টেলিফোনটা হঠাৎ ক্রিং,ক্রিং,করে কর্কশ স্বরে বেজে
উঠলো। সৌমিত্র ঘুম ঘুম চোখে বিড়বিড় করে বলে উঠলো – এ আবার কোন আপদ, এই সাত সকালে ঘুমটা
ভাঙিয়ে দিল। ইচ্ছে করেই ফোনটা তুলল না। ফোনটাও যেন নাছোড়বান্দা আবার কর্কশ স্বরে
বেজে উঠলো। সৌমিত্র ভাবছে কে হবে এত ভোরে? ওর তো তিন কুলে এখন কেউই নেই।
অফিসের লোকজনেরা ফোন করলে মোবাইল-এ করে। তাও এত ভোরে তো করবে না। এসব ভাবতে ভাবতে
রিসিভার তুলেই ঘুমের চোখে বলল – ‘হ্যালো, কে বলছেন?
- সৌমিত্র, আমি সমীর বলছি। শোন তোর সাথে খুব একটা জরুরী কথা আছে।
তোর খুব এক ঘনিষ্ঠ জন গতকাল আত্মহত্যা করেছে। তাঁর শেষ ইচ্ছে ছিল যে তুই যেন তার
অন্তিম যাত্রায় অন্তত: আসিস। তাই আজ সকাল ১১টায় কাশীমিত্তির শশ্মান ঘাটে চলে আসিস।
দেরী করিস না কিন্তু’।
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই
ফোনটা কেটে দিল।
সৌমিত্র কিছুতেই বুঝতে পারছে না
কে হতে পারে তার এই ঘনিষ্ঠজন। সমীর ওর পুরনো বন্ধু, পাশের বাড়িতেই থাকতো। বহুদিন
কোনও যোগাযোগ নেই। বিশেষ করে ওর দাদা, অর্থাৎ সুভাষ-দার সাথে ওর
সম্পর্কটা তিক্ত হওয়ার পর থেকেই সৌমিত্র ওদের বাড়ী যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। এত বছর হয়ে
গেছে সমীর একবারও ওকে ফোন করে খবর নেয় নি। আজ এমন কি হল যে কাক ভোরেই তাকে ফোন
করতে হল। কে হতে পারে? তাহলে সুভাষ-দা বা সুভাষ-দার স্ত্রী-র কিছু হয়নি তো? এই প্রশ্নটা তাকে আর
বিছানায় শুয়ে থাকতে দিল না। প্রতিদিন সকাল সাড়ে সাতটায় সাবির মা এসে দরজায় কড়া
নেড়ে ঘুম ভাঙায়। তখন সে ওঠে। ছোটবেলায় একসময় ছিল যখন ভোর হলেই পাখির কলকাকলিতে তার
ঘুম ভেঙে যেত। সকালবেলা হলেই মা রেডিওতে প্রভাতি সংগীতের অনুষ্ঠান চালিয়ে দিতেন।
বলতেন – সকাল সকাল গানগুলো কত ভালো লাগে। সত্যি সত্যি তখন মনে কেমন সতেজ ভাব অনুভব
করত সে। বাবাও ভোরে পায়চারি করতে বেড়িয়ে পড়তেন। তখন কোলকাতার রাস্তায় ভোরে
গঙ্গাজলের পাইপগুলো দিয়ে রাস্তা ধোঁয়ানো, সবই যেন কেমন অজানা লাগে তার
কাছে এখন। কোথায় যেন সব হারিয়ে গেল। স্বাস্থ্য বই-এ পড়েছিল – ভোরে উঠেপড়া
সুস্বাস্থ্যর জন্য খুবই জরুরি, কিন্তু ধীরে ধীরে সব যেন কথার কথা হয়ে রয়ে গেল।
আজকাল বেঁচে থাকার অর্থটাও সে হারিয়ে ফেলেছে। স্বাস্থ্যর তোয়াক্কা সে করেনা। অনেক
রাত পর্যন্ত ঘরে বসে ল্যাপটপে অফিসের কাজ করতে করতে সময় কাটিয়ে দেয়। ওটাই এখন বড়
আপনজন বলে মনে হয়। ঘুম না এলে সঙ্গ দেয়। আর টিভির সিরিয়াল ও সিনেমাগুলোও অবাস্তব
কল্পনা মনে হয়। তাই আর দেখেনা। সাবির মা এসে ঘুম ভাঙানোর পর যখন ঘরের কাজ সেরে ওর
জন্য রান্না করতে থাকে তখন সৌমিত্র অফিস
যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নেয়। মা-মারা যাওয়ার পর থেকেই এই রুটিন চলে আসছে। সাবির মা
বহুদিন থেকেই কাজ করছে। মা যখন বেঁচেছিলেন, তখন থেকেই। সাবির মা-র বয়সও এখন
অনেক হয়েছে। প্রায়ই রান্না করতে করতে সৌমিত্রকে বলে – দাদাবাবু, আমারও তো অনেক বয়েস হল, কতদিন আর রান্না করে
তোমাকে খাওয়াবো। এবার একটি বৌ নিয়ে এসে গো।
সৌমিত্র-র এই কথাগুলো এখন
গা-সওয়া হয়ে গেছে। তাই কোন জবাব দেয় না। নিজের কাজ করতে থাকে।
বিছানায় বসে সৌমিত্র স্মৃতি
রোমন্থন করতে থাকে। তাহলে সুভাষ-দার কিছু হয়নি তো? নাকি সুপর্ণা বৌদির কিছু হল? ওর চোখের সামনে এক এক
করে দৃশ্যগুলো মনে পড়তে থাকে। ওরা তখন পাশাপাশি বাড়িতে থাকতো। ঐ পাড়াতে সোমা-রাও
থাকতো। সৌমিত্র তখন সম্পূর্ণ যুবক, কলেজে পড়ে আর সোমাও তখন পূর্ণ
যৌবনা এক অপরূপা। তার যৌবনে তখন বসন্তের দোলা লেগেছে। হরিণের মত চাহনি দিয়ে ও কথাবার্তা
দিয়েই যেন সে সকল কে বশ করতে শিখে ফেলেছে। তাঁর চলনে, বলনে এক অপূর্ব
আকর্ষণীয় ভঙ্গি সকলকে মোহিত করে। তাঁর কথার মধ্যে ও শরীর মধ্যে কোথাও যেন এক
মাদকতার ছোঁয়া লেগে আছে। এককথায় সে তখন আকর্ষণীয় এক সুন্দরী মন হরণকারী হরিণী।
বাগানে একটি সুন্দর ফুল ফুটলে যেমন সব ভোমরা এসে সেখানে ভিড় করে, ঠিক তেমনই, আশে পাশের সব যুবকদেরই
লক্ষ্য তখন সোমা। অনেকেই তাকে আদর করে ডাকতো ‘সুমি’। ওর ফেটে পড়া যৌবন অনায়াসেই
কাউকে কাত করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। তবে ওর শিশুসুলভ ব্যবহার, প্রাণবন্ত উচ্ছলতা
সকলের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একবার মনে আছে পাড়ার ছেলেদের
দু’দলের মধ্যে তুমুল মারামারি হল সোমাকে কেউ কুকথা বলেছে এই নিয়ে। অথচ সোমা
এব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্বিকার ছিল। সে কাউকেই পাত্তা দিত না। ওর চলার মধ্যে, বলার মধ্যে একটা মাদকতা
ছিল,
যা
সকলেই অনুভব করতো। অনেকেই উদগ্রীব হয়ে থাকতো ওর একটু কাছে আসতে, একটু উষ্ম-স্পর্শ ও
ভালবাসা পেতে, ওকে জীবনসঙ্গিনী বানাতে। সৌমিত্রও এর ব্যতিক্রম ছিল না। সেও মনে মনে
সোমাকে ভালবেসে ফেলেছিল, কিন্তু প্রকাশ করতে পারছিল না। ও চিরকালই একটু স্বতন্ত্র
ছিল,
অন্যদের
থেকে। একটু ভয়ও ছিল মনে, যদি সোমা প্রত্যাখ্যান করে ইত্যাদি ইত্যাদি ভেবে। এইসব
সাতপাঁচ ভেবে মনের কথা বলতে পারছিল না। সেও চাইতো সোমাকে কাছে টেনে নিতে, মনের সব কথা খুলে বলতে।
ওকে জীবনের সর্বস্ব উজাড় করে দিতে। সে সুযোগও একদিন পেয়ে গেল। দোকান থেকে বাড়ি
ফেরার পথে সোমা ওকে দেখে পেছন থেকে ডাকতে লাগল – সৌমিত্র দা, সৌমিত্র দা...
সৌমিত্র পেছন ফিরে তাকাতেই দেখল
সোমা ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। এসেই বলল – এই, সৌমিত্র দা, তুমি কি এখন ফ্রি আছো? আমাকে একটু অঙ্ক বুঝিয়ে
দিতে পারবে? যদি সময় থাকে তবে এসো না একটু বুঝিয়ে দেবে।
সৌমিত্র, সোমার দিকে তাকিয়ে কি
বলবে বুঝে ওঠার আগেই সোমা বলে উঠলো – কি দেখছ অমন করে? চলো আমার সাথে।
সৌমিত্রও তখন সম্মোহিত ব্যক্তির মত ওর সাথে সাথে এগিয়ে গেল। সেদিন সৌমিত্র বুঝতে
পেরেছিল যে ওর মধ্যে অদ্ভুত এক সম্মোহনী শক্তি আছে। সোমাদের বাড়ি পৌঁছে এবার আরও
অবাক হওয়ার পালা। দেখল ওর মা-বাবা কেউই বাড়ি নেই। সুমি বলে উঠলো – মা-বাবা দিদির
শ্বশুরবাড়ি গেছে। সন্ধের আগে ফিরবে না। আমাকে কয়েকটা অঙ্ক বুঝিয়ে দেবে?
সোমিত্র পাড়াতে কয়েকটা অঙ্কের
টিউশানি করে, তাই অঙ্কের অভিজ্ঞ শিক্ষক হিসেবে একটু নামডাকও আছে। সুমি অঙ্কের বই, খাতা নিয়ে বসে অঙ্ক
দেখাতে লাগলো। সৌমিত্র ও জুটে গেল অঙ্কের নেশায়। হঠাৎ এক উষ্ণ অনুভবে বুঝতে বাকী
রইলো না যে সুমি পাশে ঘেঁসে বসেছে, ওর নিঃশ্বাস গায়ে এসে লাগছে।
সুমি - এই, দ্যাখনা সৌমিত্র দা, একটা পিঁপড়ে বড়
কামড়াচ্ছে। একটু ফেলে দাও না। বলে পিঠটা
এগিয়ে দিল। একটু দেখ না প্লীজ।
সৌমিত্র - কই না তো। আমি তো কিছুই দেখছি
না।
- তুমি না খুব বোকা, বুঝলে মশাই, বলেই সৌমিত্রকে জড়িয়ে ধরে আদর
করতে শুরু করল। সৌমিত্রও যেন কোথায় হারিয়ে গেল। ওর সুপ্ত ইন্দ্রিয়গুলো হঠাৎ সজাগ
হয়ে উঠলো। এরপর যা হওয়ার তাই হল। একে অপরের মধ্যে কখন যে হারিয়ে গেল খেয়ালই করেনি।
সব কিছুই এত দ্রুত ঘটে গেল যে সৌমিত্র ভাবতেই পারেনি এমনটি হবে।
এই ঘটনার পর সৌমিত্র আরও বেশ
কয়েক বার সুমির সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছে, ওকে মন প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছে।
সুমিও কখনও বলেনি যে সে অন্য কাউকে বিয়ে করতে চায়, বরং বলেছে সৌমিত্রকে ছাড়া সে
বাঁচবে না। তাহলে সুমি এমন বদলে গেল কি করে? সুমির শরীরের সুগন্ধ, ওর দেহের আকর্ষণ এখনও
ওকে পীড়া দেয়। মাঝে মাঝে রাগও হয় সুমির ওপর, সৌমিত্র তখন কলেজের ছাত্র একথা
জেনেও সুমি ওর জন্য অপেক্ষা করতে পারলো না। নাকি ওর যৌবনের বাঁধটা তখন ভেঙে
গিয়েছিল,
কোনও
বাধাই মানতে চায়নি। শেষ পর্যন্ত সুমি নিজে থেকে ধোঁকা খেল, নাকি সুভাষ-দা ওকে
ধোঁকা দিল আজও বুঝে উঠতে পারেনি সৌমিত্র। যেদিন শুনল যে সুভাষ-দা ওকে বিয়ের
প্রস্তাব দিয়েছে সেদিন থেকেই সুভাষ-দার ওপর রাগটা স্বাভাবিক ভাবেই বেড়ে গিয়েছিল।
সুভাষ-দা তখন গর্ভরমেন্ট অফিসে চাকরী করে, তাই হয়তো সুমিও রাজী হয়ে
গিয়েছিল। সৌমিত্রর জন্য অপেক্ষা করার মত সময় ওর কাছে ছিল না।
একদিন সুমি ওর বন্ধু সুপর্ণাকে
নিয়ে আসে সুভাষ-দার বাড়িতে। আর সেটিই হল সুমির সম্ভবত জীবনের বড় ভুল। সুপর্ণাও ছিল
রূপে গুণে অপরূপা এবং শান্ত ও লক্ষ্মীশ্রী যুক্ত, তাই সুপর্ণা সুভাষ-দার
বাবা-মায়েরও খুব পছন্দের হয়ে উঠলো। সুপর্ণার সাথে সুভাষ-দার অন্তরঙ্গতা ক্রমশ:
বাড়তে লাগল। একদিন সবাই জানলো, সুভাষ-দা সুপর্ণাকে বিয়ে করছে। এ ঘটনার পর থেকেই
সুমিকে খুব বেশি দেখা যেত না। সুভাষ-দার বিয়ের কয়েকদিন আগেই শোনা গেল সুমি
মা-বাবাসহ শান্তিপুরে মামাবাড়িতে চলে গেছে। সৌমিত্র শুনেছিল একদিন সে নাকি
সৌমিত্রকে খুঁজতে এসেছিল যাওয়ার আগে কিন্তু সৌমিত্র তখন বাড়ি ছিল না। পরে ফিরে
দেখেছে ওরা আর নেই। সৌমিত্র তারপর ওর মামাবাড়ির ঠিকানায় গিয়ে দেখেছে তালা বন্ধ। ওর
মামারা সাঁওতাল পরগনায় কোথায় শিফট করে চলে গেছে। কেউ ঠিকানা দিতে পারল না। সৌমিত্র
এদিক সেদিক পাগলের মত খুঁজেও ওর দেখা পায় নি। সেই থেকে রাগে, দুঃখে, অভিমানে সে আর কখনও
সুভাষ-দা-দের বাড়ি মুখো হয়নি। বাবা মারা যাওয়ার পর মাকে নিয়ে সে চলে এসেছিল
বাগবাজারের রাজবল্লভ পাড়ায়। এর পর মা মারা যাওয়ার পর এ বাড়িতেই কাটিয়ে দিল বহু
বছর। মায়ের স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই বাড়িতে বলে মনে হয় তার। অবশ্য লুকিয়ে চুড়িয়ে পুরনো
পাড়ায় কয়েকবার গেছে সুমির খোঁজ করতে কিন্তু কোন হদিস না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে এসেছে।
বরং সুমির ওপরই বেশী রাগ হয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হতো সুমিই তো তাকে ধোঁকা দিয়েছে, তাহলে ও সুমির জন্য ও
ভাবছে কেন? সব যেন কেমন তাল গোল পাকিয়ে গেছে ওর কাছে।
সৌমিত্র ফোনটা পাওয়ার পর থেকে
কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না যে কে এমন হতে পারে তার স্বজন। যার জন্য তাকে যেতে হবে
অন্তিম সময়ে। এক সময়ে তার সবাই ছিল, যখন মা-বাবা জীবিত ছিলেন তখন
অনেক আত্মীয় স্বজনের যাতায়াত ছিল। বহু বন্ধু-বান্ধব ছিল। আজ সে যেন কেমন নিঃসঙ্গ
হয়ে জীবন কাটাচ্ছে। এখন আপন বলতে কাজের লোক সাবির মা আর অফিসের বড় বড় ফাইলগুলো, কম্প্যুটার ইত্যাদি। মা
মারা যাবার পর থেকেই কেমন যেন নির্লিপ্ত হয়ে পড়েছে সে। মাঝে মাঝেই ভাবে একটা আস্ত
পাথরে পরিণত হয়ে যাচ্ছে না তো সে? অফিসের অনেকেই তাকে বাঘ-সিংহের মত ভয় পায়। ওর
অলক্ষ্যে ওর কঠোর মনের জন্য নিন্দাও করে বলে শুনতে পায়। কিন্তু ও আজ কেন এমন হল তা
তো কেউ জানে না বা সে খবরে অবশ্য কারোর প্রয়োজনও নেই। তবে যারা সেই ঘটনা জানে তারা
তাকে সহানুভূতির চোখে দেখে। তখন আরও অভিমান হয়। কোন সহানুভূতি সে চায় না। জীবনে
একটু ভালবাসা চেয়েছিল কিন্তু সেটুকুও সে পেল না। খালি পেয়েছে ধোঁকা, বঞ্চনা। মাঝে মাঝে তার
মনে প্রশ্ন জাগে নারী কি সত্যিই ছলনাময়ী? কিন্তু এ কথারও যুক্তি সে খুঁজে
পায়নি,
কারণ
তার মা-ও তো একজন নারী। সে মাকে তো কখনও এরকম দেখেনি। পৃথিবীতে বহু নারীর বিরহ
গাঁথা এবং বীরত্বের ঘটনাও তো তার অজানা নয়। তাহলে সে কি বিশ্বাস করবে? অঙ্কের মাস্টার হওয়া
সত্ত্বেও এই অঙ্কটা আজও সে মেলাতে পারেনি। আজও তার মনে প্রশ্ন জাগে, সুমি হঠাৎ কোথায় উধাও
হয়ে গেল। অন্তত: তাকে তো একবার চিঠি লিখে হলেও জানাতে পারতো আসল ঘটনাটা কি। সবই
যেন কেমন ধোঁয়াশা হয়ে আছে। ধোঁয়ার আস্তরণে সব ঢেকে আছে। এখনও পুরনো বন্ধু-বান্ধব
বা পরিচিতদের সাতে দেখা হলে আনন্দ পায়, ভাল লাগে। পুরনো দিনের
স্মৃতিগুলো সব চোখের সামনে ভেসে ওঠে, ভাবে ঐ দিনগুলো আর কখনো ফিরে
আসবে না। কিছুদিন আগে অফিস থেকে ফেরার পথে বাসস্টপ থেকে যখন হেঁটে বাড়ি ফিরছিল, তখন হঠাৎই কোলাহল শুনে
পেছন ফিরে দেখল অন্য ফুটপাতের দিকে একটা গাড়ি এক ভদ্রলোককে ধাক্কা দিয়ে চলে যাওয়ায়, বহুলোক ছুটে গেল
ভদ্রলোককে সাহায্য করতে কিন্তু সৌমিত্র সেদিন অনায়াসে পাশ কাটিয়ে চলে এসেছিল।
তাহলে সত্যিই কি সে পাথরের মত নিষ্প্রাণ হয়ে যাচ্ছে। নিজের মনে মনেই ভাবতে থাকে, সে তো এমন ছিল না আগে।
একসময় পাড়াতে পরোপকারী বলে নাম ডাকও ছিল। মনে আছে একবার পাড়ার হারু বাগদীর বাবা
যখন টি.বি.-তে মারা গেল, তখন সেই বৃষ্টির রাতেও বন্ধুদের একত্রকরে পকেটের পয়সা
খরচা করে তার সৎকার করে এসেছিল। পাশের বাড়ির রবিনবাবুর কারখানা যখন বন্ধ হয়েছিল, তখন নিজের হাত খরচের
টাকা লুকিয়ে রবীনবাবুকে দিয়ে আসতো। কিন্তু আজ সে এত বদলে গেছে এটাও মেনে নিতে অবাক
লাগে।
এসব কথা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ
দরজায় টোকা পড়ল –
- দাদাবাবু, দরজাটা খুলে দাও।
বুঝতে বাকি রইল না সবির মা এসে
গেছে। দরজা খুলে দিতেই সবির মা ঢুকেই বলল –
- কি ব্যাপার গো দাদাবাবু? আজ তো একবার ডাকতেই দরজা খুলে
দিলে। কাল রাতে ঘুমোওনি নাকি?
- না, আজ ঘুমটা তাড়াতাড়ি ভেঙে গেছে একটা ফোন আসাতে।
- আর বোলো না, আজকাল এই ফোন হয়েছে এক যন্ত্রণা বাপু। কোনও কাজ করার
উপায় নেই গো। রাত দিন বেজেই চলেছে। আজকাল সবির বাপ ও ঐ একটা যন্তর কিনেছে। কিনে
হয়েছে আর এক বিপদ। রাত নেই দিন নেই বেজেই চলেছে। কে যে এত ফোন করে, আর কি যে এত ফোনে কথা
হয় কিছুই বুঝিনা বাপু। আমাদের সময়ে আমরা এই যন্তর ছাড়া বেশ শান্তিতে ছিলুম বাবা।
- পিসী, (সবির মাকে আগে থেকেই পিসী বলে ডাকে), তোমার আজ ছুটি। আমি
একটু জরুরী কাজে আজ এখুনি কোথাও যাবো।
- আজ তাহলে বাইরে থেকেই কিছু খেয়ে নিও গো। না খেয়ে থেকোনা। আজ তোমার মা
থাকলে তুমি কি না খেয়ে যেতে পারতে? আমি তাহলে চললুম, বলে সবির মা চলে যায়।
মা-র মৃত্যুর পর সবির মা-র
স্নেহ,
মমতা
মাঝে মাঝেই মায়ের কথা মনে করিয়ে দেয় তাকে।
সৌমিত্র অফিসে ফোনে জানিয়ে দেয়
আজ সে অফিসে যাবে না। স্নান সেরে বেড়িয়েপরে কাশী মিত্তির ঘাটের উদ্দেশে। হাঁটতে
হাঁটতে ভাবতে থাকে, একসময় যখন কলেজে পড়তো তখন বিকেলে বন্ধুদের সাথে বেড়াতে
বেড়াতে কতবার এই কাশীমিত্তির শশ্মান ঘাটের পাশদিয়ে গেছে কিন্তু তখন ভুলেও উঁকি
দিয়ে ভেতরে তাকাত না পাছে কোনও বিকৃত কোন দৃশ্য মনকে নাড়া দেয় এই আশঙ্কায়। পরে
অবশ্য বাবা এবং মা-কে দাহ করার পর মনথেকে সেই ভীতিটা কোথায় যেন বিলীন হয়ে গেছে।
তবুও শশ্মান ও হাসপাতাল এই দু’টো জায়গা এখনও সে এড়িয়ে চলে। ওখানে গেলেই মনটা কেমন
উদাস হয়ে যায়।
শশ্মানঘাটের যত কাছাকাছি
এগোচ্ছে,
ততই
ওর হৃৎস্পন্দন যেন আরও দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। মাঝে মাঝে ভাবছে কার আকর্ষণে সে
এগিয়ে যাচ্ছে? সমীর ভোরবেলা ল্যান্ড লাইনে ফোন করে এমন ভাবে ফোনটা রেখে দিল যে সব
কথা জানাই হল না। ওর নম্বরটাও হারিয়ে ফেলেছে অনেকদিন হল। মোবাইলে ফোন করলে রিং
ব্যাক করা যেত। তাহলে কি সুপর্ণা বৌদি বা সুভাষ-দার কিছু হল? না হলে সমীরই বা ফোন
করল কেন?
আবার
এও ভাবছে ওরা আপনজন হল কি ভাবে? আর বাকী রইল সুমি, ওর খোঁজ তো আজ কেউই জানেনা।
তাহলে কে এমন হতে পারে। বারে বারে এই প্রশ্নগুলো ওর মাথাতে খালি তোলপাড় হচ্ছিল।
এসব এলো পাথারি চিন্তা করতে
করতে সে কখন শশ্মানের কাছে পৌঁছে গেছে বুঝতেই পারেনি। সম্বিত ফিরল যখন নজরে পড়ল
শশ্মানের বাইরে সুপর্ণা বৌদি দাঁড়িয়ে আছে উদ্ভ্রান্তের মত। তাহলে সুপর্ণা বৌদি বা
সুভাষ-দার কিছু হয়নি একথা বুঝতে বাকী রইল না। তাহলে কে হতে পারে?
সুপর্ণা বৌদি ধীরে ধীরে এগিয়ে
এসে সৌমিত্র-র হাতটা চেপে ধরে ভেতরে নিয়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে একটা চিঠি বের করে
সৌমিত্রকে দিয়ে বলল - ঠাকুরপো, আমি সুমিকে কথা
দিয়েছিলাম, আসল কথাটা কাউকে বলবো না। তাই শেষ সময়ে সুমি নিজেই তোমাকে সব লিখে
আমাকে মুক্ত করে গেছে। ওকে তুমি ভুল বুঝনো প্লীজ। গত পরশু ও আমাদের বাড়িতে হঠাৎই
এসে হাজির হয়। আজ তুমি না এলে সুমির আত্মা যেমন শান্তি পেত না, তেমনি আমিও আমার বন্ধুর
কাছে এবং তোমাদের সকলের কাছে অপরাধী থেকে যেতাম।
সৌমিত্র এসব কথা শুনতে শুনতে
কেমন যেন কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে যাচ্ছিল, চোখটা ছিল সুমির সুন্দর গোলাপের
মত মুখটার ওপর। দেখে মনেই হচ্ছিল না যে ও আত্মহত্যা করেছে। সুন্দর গোলাপের মত
রক্তিম মুখটা দেখে মনে হচ্ছিল ও যেন সৌমিত্রর দিকে তাকিয়ে হাসছে আর বলছে - ধরতে
পারলে না তো? ফাঁকি দিয়ে চলে গেলাম।
সৌমিত্র চিঠিটা খুলে পড়তে লাগল
–
সুপ্রিয় সমু,
আমি জানি তুমি আমার ওপর খুব
রেগে আছো। তাই এই চিঠিটা লিখছি। তোমার হাতে এই চিঠিটা না পৌঁছালে আমি মরেও শান্তি
পাবো না। তাই এই চিঠিটা সুপর্ণাকে দিয়ে গেলাম। আমার মৃত্যুর পরে এটা তোমাকে যে
কোনও উপায়ে যেন পৌঁছে দেয়। সুভাষদাকে বিয়ে করতে আমি একদম রাজি ছিলাম না। তাই সুপর্ণাকে
এনে আমি নিজে থেকেই দূরে সরে যাই। একথা সুপর্ণা ছাড়া আর কেউই জানেনা। কারণ আমি যে
ভালবাসা তোমাকে দিয়েছি তা ভাগকরা যায় না। ওদের বিয়ে ঠিক হওয়ার পর ভেবেছিলাম হয়তো
তোমাকে ফিরে পাবো। তাই তোমার খোঁজে তোমার বাড়ি গিয়ে যখন শুনলাম তুমি আমার ওপর রাগ
করে অন্য কোথাও চলে গেছো, তখন বুঝেছিলাম তুমি আমাকে ভুল বুঝে বহুদূরে সরিয়ে দিয়েছ।
তাই বাবা, মা-কে নিয়ে মামা বাড়ি চলে যাই। সেখানে মা-বাবা মারা যাওয়ার পর মামির
গঞ্জনা,
লাঞ্ছনা
সহ্য করতে না পেরে বাড়ি ছেড়ে সাঁওতাল আদিবাসীদের একটা গ্রামে চলে গিয়ে স্কুলের
শিক্ষকতা শুরু করি। পুরানো অতীতকে ভুলতে চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারলাম না। তোমার
ছবিটা আমার মনের গভীরে বসে গিয়েছিল। কিছুতেই ভুলতে পারতাম না। বহু দিন এবং রাত্রি
তোমার বিরহে কেঁদেছি। দূরে না গেলে হয়তো তোমার প্রতি এই ভালবাসাটা ভালকরে বুঝতে
পারতাম না। ভগবানও হয়তো আমাকে মাপ করলো না তাই দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে
আক্রান্ত হলাম। যখন ডাক্তার বলে দিল যে
আমার জীবনের আর মাত্র কয়েকদিন বাকী আছে তখন চলে এলাম বন্ধু সুপর্ণার কাছে
তোমার খবর পাবো এই আশায়। সুপর্ণাকেও জানাইনি যে আমার ক্যান্সার হয়েছে। কিন্তু রাতে
যন্ত্রণা এত বেড়ে গেল যে ওদের কাউকে অসুবিধেয় ফেলতে না চেয়ে নিজের জীবনকে
আত্মাহুতি দিচ্ছি। তুমি পারলে আমাকে ক্ষমা
কোরো। তোমাকে ভালবাসাই যখন দিতে পারলাম না তখন এই দুরারোগ্য ব্যাধির ভার কি করে
দিই বলো?
আমি
আজও তোমারই আছি এবং থাকবো। এ জন্মে নাই বা হল পরজন্মে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে
থাকবো। আমাকে ভুল বুঝনো লক্ষ্মীটি।
ইতি – তোমার সুমি
পুনঃ- আর একটা অনুরোধ রইল, আমার মুখাগ্নি করার
দায়িত্বটা তোমাকে দিয়ে গেলাম। তোমার হাতের
আগুণ পেলে আমার আত্মার শান্তি হবে ও
জানবো তুমি আমায় ক্ষমা করেছো।
চিঠিটা পড়তে পড়তে সৌমিত্র-র
পাষাণ বুকও ফেটে চৌচির হয়ে গেল। চোখের জলের বাঁধটাকে আর কিছুতেই আটকে রাখতে পারছিল
না। চোখ ঝাপসা হয়ে চিঠির লেখাগুলো অস্পষ্ট হয়ে এলো। অব্যক্ত এক বেদনায় সাজানো
চিতার পাশে বসে পরে সুমির হাতটা চেপে ধরল।............
লেখক পরিচিতি –
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
কালীপদ চক্রবর্ত্তী দিল্লি থেকে প্রায় ১৮ বছর ‘মাতৃমন্দির সংবাদ’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন এবং ‘সৃষ্টি সাহিত্য আসর’ পরিচালনা করেছেন । বর্তমানে 'কলমের সাত রঙ' এবং 'www.tatkhanik.com' পত্রিকার সম্পাদক।
দিল্লি,কলকাতা এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখেন। কলকাতার আনন্দমেলা, আনন্দবাজার পত্রিকা,সাপ্তাহিক বর্তমান,দৈনিক বর্তমান,নবকল্লোল,শুকতারা, শিলাদিত্য,সুখবর, গৃহশোভা, কিশোর ভারতী, চিরসবুজ লেখা (শিশু কিশোর আকাদেমী,পশ্চিমবঙ্গ সরকার), সন্দেশ, প্রসাদ, ছোটদের প্রসাদ, কলেজস্ট্রীট, উল্টোরথ,তথ্যকেন্দ্র, জাগ্রত বিবেক (দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির থেকে প্রকাশিত) , স্টেটসম্যান, কিশোর বার্তা অন্যান্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রকাশিত বই-এর সংখ্যা ১০ টি এবং প্রকাশের পথে ২টি বই।