কিশোরগঞ্জের
মধুপুর গ্রাম। গ্রামটি
খুব সুন্দর। গ্রামের
শেষ প্রান্তে একটি নদী বয়ে যায়। চারিদিকে ফল ফুলের গাছ গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য
বাড়িয়ে দিয়েছে মধুপুর গ্রামের লোকেরা একটা
বড় পরিবারের সদস্যের মত মিলেমিশে থাকে। গ্রামের মাঝখানে একটি সুন্দর মন্দির
স্থাপিত রয়েছে। সবাই মন্দিরটিকে ‘নীলমণি’ মন্দির বলে। নীলমণি মন্দিরে আশেপাশের
গ্রামের ভক্তরা আসা যাওয়া করে। নীলমণি মন্দিরে একটি সোনার নারায়ণের মূর্তি স্থাপিত
রয়েছে। মূর্তির মুকুটে একটি বহুমূল্য নীল রঙের রত্ন বসানো যার জন্য লোকেরা
মন্দিরটিকে নীলমণি মন্দির বলে। প্রতিদিন তিনবার পুজো হয়,দুপুরবেলা
ভোগ বিতরণ করা হয় এবং সন্ধ্যা বেলায় সন্ধ্যা আরতি হয়। প্রত্যেক দিন দুপুরে ও
সন্ধ্যা বেলা ভক্তরা আসেন এবং সকলে
একত্র হয়ে পুজো আরতি চলাকালীন ভজন কীর্তন করেন।
ভক্তদের সঙ্গে একটি চোর কয়েকদিন ধরে মন্দিরে
আসতে লাগল,সেও সবার মধ্যে বসে অন্যদের মতো ভজন কীর্তন
করার ভান করে আর সকলে কি করে দেখতে থাকে। মন্দিরের পুরোহিত শ্রী রামচন্দ্র
চক্রবর্তী বৃদ্ধ,তিনি বহু দিন ধরে এই মন্দিরে পুজো
অর্চনা করে চলেছেন। গ্রামের সকলে ওনাকে শ্রদ্ধা ভক্তি করে এবং ওনার কথাকে বেদ
বাক্য বলে মনে করা হয়। পুরোহিত যখন পুজো করেন তখন সেই চোর ভক্তদের মধ্যে বসে ভাবে
যদি এই সোনার নারায়ণের মূর্তিটি বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেদিই তাহলে আর অনেক দিন পর্যন্ত চুরি না করলেও চলবে। কিন্তু
মূর্তিটি চুরি করব কি করে, সে ওখানে বসে বসে ভাবতে লাগল। পুজো
শেষ হয়ে গেলে সকলে চলে যাওয়ার পর
চোরটাও চলে গেল। বাড়িতে গিয়ে সে চুরি করার
উপায় চিন্তা করতে করতে একটি উপায় তার
মাথায় এলো,তারপর চোরটা বাড়িতে একটি মাটির মূর্তি তৈরি
করতে লাগল,কয়েকদিনের মধ্যে নীলমণি মন্দিরের নারায়ণের
মূর্তির মতো একটি মূর্তি তৈরি করল। এরপর
বাজার থেকে সোনালি রং কিনে আনল, মাটির মূর্তিটিকে সোনালি রং
করে রোঁদে শুকিয়ে নিল । রং শুকিয়ে যাওয়ার পর মাটির মূর্তিটিকে দেখে নিজেই খুব অবাক ও খুশী হল, কারণ
মাটির মূর্তিটি দেখতে অবিকল
সোনার নারায়ণের মূর্তির মতো লাগছিল,দুটো
পাশাপাশি রাখলে বোঝা মুশকিল হবে কোনটি আসল আর কোনটি নকল ।
একদিন সুযোগ দেখে যখন মন্দিরের চারিপাশে কেউ
নেই,তখন চোরটা মন্দিরের ভীতরে প্রবেশ
করে ঠাকুরের সিংহাসন থেকে সোনার মূর্তিটি নামিয়ে সেখানে সোনালি রং করা মাটির
মূর্তিটি বসিয়ে দিল। তারপর মন্দির থেকে বেড়িয়ে ভাবল এটা সোনার মূর্তি নিয়ে যাওয়ার
সঠিক সময় নয়, তাই এখানে কোথাও লুকিয়ে রেখে দিই। একদিন সঠিক
সময় দেখে নিয়ে যাব, এখন নিয়ে গেলে যদি ধরা পড়ে যাই,তাই সে মূর্তিটি নিয়ে মন্দিরের উঠোনের শেষ প্রান্তে মূর্তিটিকে
রেখে তার উপর এক ঝুরি মাটি চাপা
দিয়ে ডেকে রাখল যাতে কেউ দেখতে না পায় । এরপর কয়েকদিন কেটে গেল, চোরটা
প্রতিদিন আসে এবং দূর থেকে মাটির ঢিবিটা
আছে দেখে চলে যায় । একদিন দুপুরে সকলের সঙ্গে চোরটিও মন্দিরের বারান্দায় বসে
কীর্তন করছিল,এমন সময় হঠাৎ বৃষ্টি পরতে লাগল । মন্দিরের উপরে
টিনের চালের উপর বৃষ্টি পড়লে টিনের ছিদ্র দিয়ে মন্দিরের সিংহাসনের ওপরে বসানো মাটির মূর্তিটির উপর বৃষ্টির জল পরতে লাগল ।
বৃষ্টির জল মূর্তির উপর পড়লে সোনালি রং ধুয়ে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে ভেতরের বদ রঙ্গা
মাটি বেড়িয়ে এলো । তা দেখে সকলে অবাক হয়ে গেল ভাবতে লাগলো
যে এটা কিকরে হল।
মন্দিরের সোনার বিগ্রহটি কোথায় গেল? পুরোহিত মশাই দেখে ভয়ে থর
থর করে কাঁপতে লাগলেন। চারিদিকে হৈ হৈ পড়ে
গেল,
সোনার বিগ্রহটি কোথায় গেল? চিৎকার
চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল ।
এবার পুরোহিত মহাশয় বাইরে এসে সবাইকে শান্ত হোন,শান্ত
হোন বলে অনুরোধ করলেন, কারণ এটা কি করে সম্ভব তা উনি
নিজেও বুঝতে পারছিলেন না । তবে সবাই ওনার কথা শুনে চুপ করল । যখন উনি সবার
উদ্দেশ্য কিছু বলবেন ঠিক সেই সময় ওনার ও বারান্দার কিছু লোকের উঠানে কি যেন সোনার
মত চকচক করছে দেখতে পেলেন, কারণ বৃষ্টির জল মাটির ঢিবির ওপর পড়াতে নারায়ণের উপর যে মাটি চাপা ছিল তা
ধুয়ে গিয়েছিল । পুরোহিত রামচন্দ্র
চক্রবর্তী মহাশয় ও কয়েকজন লোক তাড়াতাড়ি করে সেখানে গিয়ে দেখলেন যে, সেখানে
সোনার নারায়ণের মূর্তিটি পড়ে রয়েছে । তখন বিগ্রহটি তুলে নিয়ে এসে বারান্দায় জলের
পাত্র থেকে ধুয়ে মূর্তিটিকে পরিষ্কার করে নিলেন
এবং মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করে সিংহাসন থেকে বদ রঙ্গা মাটির মূর্তিটি নামিয়ে আবার
নীলমণিকে পুনঃ স্থাপিত করে ফুল-চন্দন, ধুপ-দীপ, ফল-বাতাসা
দিয়ে পুজো করতে শুরু করলেন,ভক্তরা
আনন্দে শাঁখ-কাঁসর বাজাতে লাগল এবং নাচ গান করতে করতে বলতে লাগল জয় নীলমণির জয়, জয়
নীলমণির জয় ।
লেখিকার পরিচিতি ঃ-
জন্ম বিহারের কিশানগঞ্জ । প্রা্থমিক থেকে স্নাতকোত্তর কিষান গঞ্জেই । আঞ্চলিক
বার্ষিক পত্রিকা, উত্তরবঙ্গ সংবাদে অনুগল্প, ছোট গল্প লেখালেখি করেন। সঙ্গীত, বই পড়া, ভ্রমণ ও আধ্যাত্মিকতায় রুচিশীল এবং কুসংস্কার বিরোধী ।