শ্যামলীর রাগে সারা শরীর
জ্বলছিল। কথায় তো ট্যাক্স লাগে না। তাই যা খুশী বললেই হল। তার পরিস্থিতি দেখবে না? কোন অসহায়
পরিস্থিতির মধ্যে সে কাজটা করতে বাধ্য হল! এসব কেউ খতিয়ে দেখে না। ঘায়ের ওপর নুন
ছেটাতে পারলে কিছু মানুষের খুব উল্লাস বোধ হয়।
মায়া বলছিল দাদাবাবু ভীষণ
রেগে গিয়েছিলেন। 'অনিরুদ্ধের রেগে যাওয়ারই
কথা। একেই মাতৃ-বিয়োগের শোক। তার ওপর যার দুটো ছেলেরই জীবন বিপন্ন,তার কি
মাথার ঠিক থাকে। তবু অনিরুদ্ধ বেচারী সব দিক সামলাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এদিকে
তাকে হস্পিটাল-বাড়ি করতে হচ্ছে তার ওপর মায়ের শ্রাদ্ধের কাজের জন্য কালীবাড়ীও
ছুটোছুটি করতে হচ্ছে। একাকী সে কতদিক সামলাবে? কোথায় এই
গুরুদশার সময় তার অনিরুদ্ধের পাশে থাকার কথা, তা নয়
তাকে হস্পিটালে থাকতে হচ্ছে। বিপদ যখন আসে এমনি ভাবেই বুঝি চারদিক দিয়ে ধেয়ে আসে।
ভরসা ছিল ঠাকুরপো খবর পেয়ে সঙ্গে-সঙ্গেই চলে আসবে। দুঃসময়ে আপন আত্মীয়-পরিজন পাশে
থাকলে অনেক বল-ভরসা পাওয়া যায়। কিন্তু ঠাকুরপো এসেই উচিত-অনুচিতের ছড়ি ঘোরাতে শুরু
করছে। অনিরুদ্ধের মানসিক অবস্থাটা শ্যামলী অনুমান করতে পারছে, কিন্তু
অরুণ- বরুণকে হস্পিটালে ফেলে রেখে বাড়ি যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। মায়ার মত
বিশ্বাসী ঝি পেয়েছিল বলেই বাড়ির সমস্ত ভার মায়ার ওপর ছেড়ে দিয়ে সে নিশ্চিন্ত হয়ে
হস্পিটালে আসতে পেরেছে। তার তো হবিধিষ্য করার কথা, কিন্তু
হস্পিটালে কী করে করবে? তাই মায়ার পাঠানো নিরামিষ
খাবারই খেতে হচ্ছে শ্যামলীকে। মায়ার কাছে ঠাকুরপোর কথা শুনে তার সারা শরীর রাগে
রী-রী করে।
ঠাকুরপোকে তার জিজ্ঞেস করতে
ইচ্ছে করে "উচিত-অনুচিত ও মায়ের প্রতি কর্তব্য তখন কোথায় ছিল যখন মাকে ছ'মাসও
নিজের কাছে রাখতে পারোনি! অসুস্থ মাকে মেজদার কাছে দিয়ে গিয়েছিলে। তারপর কবার চিঠি
দিয়ে কিংবা ফোন করে মায়ের খোঁজ-খবর নিয়েছো!"
হস্পিটালে ছেলে দুটোর চিন্তা ছাড়া শ্যামলীর অন্য কিছু চিন্তা করার অবকাশই নেই, কিন্তু এই সব বেয়াড়া চিন্তাগুলি জোর করে তার মনের মধ্যে ঢুকে পড়ে।
(২)
অনিরুদ্ধ এক চাপা কষ্টে
ভেতরে-ভেতরে গুমরে মরে। ভাই তার ক্ষতস্থানটা খুঁচিয়ে দিয়েছে। তারও কি ইচ্ছা ছিল না
যে মায়ের শ্রাদ্ধ-শান্তিটা ঘটা করে হোক! পাত পেড়ে আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীকে
খাওয়ানো হোক, কিন্তু সে নিরুপায়।
নিউ-দিল্লী কালীবাড়িতেই নমো নমো করে মায়ের শ্রাদ্ধের কাজটা সারবে ঠিক করেছে। ভায়ের
ওপর তার এতটা রাগারাগী করা উচিত হয়নি,কিন্তু
সেদিন তার কী যে হয়েছিল। সে কখনো খুব একটা রাগারাগী কিংব চেঁচামেচি করতে পারেনা।
চিরকাল ঝগড়া-ঝাঁটি এড়িয়ে,চিৎকার-চেঁচামেচি নায় করে
শান্ত ভাবে সব সমস্যার সমাধান করে। অথচ তাকে সবাই ভুল বোঝে। তার শান্ত স্বভাবের
জন্য তাকে বিরূপতার মোকাবিলা করতে হয়। সে তো জানে ভাই ঠোঁটকাটা ছেলে। সময়-অসময়
দেখে না, উচিত-অনুচিত বোঝে না, যখন যা মনে আসে বলে দেয় ফট
করে। কিন্তু সেদিন তার কি যে হয়েছিল! অনিন্দ্য যখন বলে উঠল "মেজদা মায়ের
শ্রাদ্ধের কাজটা কালীবাড়ীতে কেন করছো? চার-
চারটে ছেলে থাকতে মায়ের শ্রাদ্ধের কাজ নমো-নমো করে কালীবাড়ীতে হবে। লোকে কি বলবে? মায়ের
শ্রাদ্ধের খরচ না হয় আমিই দিয়ে দিতাম।"
এই প্রথম, অনিরুদ্ধ
মেজাজ ঠিক রাখতে পারেনি। দপ করে জ্বলে উঠেছিল শোক-ক্ষোভ, দুঃখ-রাগ
ও অভিমান সব একসাথে বিস্ফোরণ ঘটে যায়।
"ইডিয়েট
কোথাকার! টাকার জন্য কি মায়ের কাজ কালীবাড়িতে করছি? বাড়ির
অবস্থা দেখতে পাচ্ছিস্ না? খুব টাকার গরম হয়েছে না? এসে থেকেই
এটা হয়নি ওটা হয়নি করে যাচ্ছিস্। বৌদি হবিষ্যি করছে না কেন? মায়ের
ট্রিটমেন্ট ঠিকমত হয়নি। প্রপার ট্রিটমেন্ট হলে মা এ যাত্রায় বেঁচে যেতেন। সবই
শুনছি অথ্য মাকে ছ'মাসও নিজের কাছে রাখতে
পারিনি। অসুস্থ মাকে আমার কাছে দিয়ে গিয়েছিলিস। মায়ের চলে যাওয়ার পর এখন তোর
কর্তব্য এক্কেবারে উথলে উঠছে না?"
রাগের মাথায় মুখে যা এসেছে বলে গেছে অনিরুদ্ধ। শ্যামলীও তো পাশে ছিল না যে,বাধা দিত। তার দুই ছেলেরই জীবন সংকটে। তার কি বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল যে, মায়ের শ্রাদ্ধের কাজ কালীবাড়িতে নমো-নমো করে হোক। কিন্তু সে নিরুপায়। এদিকে মা মৃত্যুখাটে, অন্যদিকে অরুণ-বরুণ দুজনেরই হঠাৎ করে প্রচও রক্ত আমাশা শুরু হয়ে গেছে। ওদের হস্পিটালে দিতে হয়। ছেলেদের নিয়ে শ্যামলী হস্পিটালে। ছোট ছেলে বরুণ তো মাত্র পাঁচ বছরের। ও তো মা ছাড়া হস্পিটালে এক সেকেন্ড থাকবে না। দাদা ও ভাই দুজনকেই অনিরুদ্ধ চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিল যে,মা মৃত্যু শয্যায়। তোমরা এসে একবার দেখে যাও। মৃত্যুর দিন পাড়ার একটি ছেলেকে দিয়ে ওদের টেলিগ্রামও করিয়ে দিয়েছিল অনিরুদ্ধ। অনিন্দ্য নাকি অফিস ট্যুরে ছিল তাই সময়মত আসতে পারেনি। শ্রাদ্ধের আগের দিন এসে পৌঁছেছে। দাদা হার্ট পেসেন্ট। দাদার ওপর অনিরুদ্ধের ভরসা ছিল না। সেজো তো কোনও যোগাযোগই রাখে না দীর্ঘকাল। বিদেশী মেয়ে বিয়ে করে বিদেশে রয়ে গেছে। খুব আশা ছিল অনিন্দ্যের ওপর। ও সময়মত এসে গেলেই বাড়িতেই মায়ের শ্রাদ্ধের কাজ, আত্মীয়-পরিজন ও শ্মশান বন্ধুদের খাওয়ানো- দাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে পারত। অনিন্দ্যের দেরীতে আসার জন্যই হল না। পাড়া- প্রতিবেশী তো বলবেই। তাই বলে নিজের আপনজন এরকম ভাবে অবুঝ হবে! অনিরুদ্ধের হৃদয় মুচড়ে একটা ব্যথা ওঠে ক্রমাগত। সে ভাবে, যে দুজনে হস্পিটালের খাটে জীবনের জন্য সংগ্রাম করছে তাদের জন্য কি করতে হবে তার চিন্তা নেই আর যে চলে গেছে তার আত্মার শান্তির জন্য কি কি করতে হবে তার জন্য এখন তুলকালাম। আশ্চর্য! বেঁচে থাকতে যার প্রতি কোনো কর্তব্য পালিত হয়নি!
(৩)
'দাদা,আমি
শ্রাদ্ধের পরের দিনই বাড়ি চলে যাব। আর এখানে থাকব না। যেভাবে মেজদা আমায় বকাবকি
করল বউ-বাচ্চাদের সামনে,আমার এখানে এক সেকেন্ডও
থাকতে ইচ্ছা করছে না। মানছি,টাকার কথাটা তোলা আমার
অন্যায় হয়ে গেছে,তাই বলে যা খুশী বলবে! আমি
মাকে ছ'মাস নিজের কাছে রাখিনি? অজন্তা ও
মায়ের নিত্য দিন ঝগড়া লেগে থাকত। আমার কথা কেউ শুনত না তাই মাকে মেজদার কাছে রেখে
গিয়েছিলাম। অনিন্দ্য জানে, দাদাকে বলা,না বলা সব
সমান তবু এক রাশ অভিমান তার হৃদয় থেকে ঝরে পড়ে। অনিন্দ্য ভাবে দাদা বেশ আছে। হার্ট
পেসেন্ট। এই অজুহাতে নিজের দায়-দায়িত্ব থেকে বেশ নিষ্কৃতি পেয়ে গেছে।
(৪)
সারা রাত ঘুমাতে পারেনি
অনিরুদ্ধ। ভোর রাতে কখন বুঝি ঘুম এসে গিয়েছিল চোখে। স্বপ্ন দেখছিল। মমতায়,স্নেহে
ভরা হাত দুখানি দিয়ে মা অনিরুদ্ধের বুকে, মাথায় হাত
বুলিয়ে দিচ্ছেন আর বলছেন- 'খোকা,তুই দুঃখ
পাস্ না। ভাই তো চিরকালই অবুঝ। তুই যা ব্যবস্থা করেছিস তাতেই আমি খুশী। মানুষের
জীবন থেকে মানুষের নির্মিত নিয়ম তো আর বড় নয়! লোক দেখানো আচার-আচরণ ও আড়ম্বর থেকে
মানুষের কর্তব্য চিরকালই শ্রেষ্ঠ। তুই তো নিজের কর্তব্যে কোনো ত্রুটি রাখিসনি। তবে
কেন মিছি মিছি কষ্ট পাচ্ছিস'।
(৫)
সকাল বেলা মায়া এসে দেখে যে, দাদাবাবু
বাচ্চাছেলের মত গভীরভাবে ঘুমোচ্ছেন। মায়ার ডাকতে মায়া হল।
লেখিকার পরিচিতিঃ
যদিও জন্ম পলাশীপাড়া, নদিয়া জেলা, পশ্চিমবঙ্গ, কিন্তু তাঁর শৈশব, বেড়ে ওঠা, শিক্ষা-দীক্ষা সব এলাহাবাদেই। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থশাস্ত্রে এম.এ.। ১৯৮১ সালে এলাহাবাদ থেকে একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা "তূণীর" প্রকাশ করতেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় (দেশে ও বিদেশে) লেখা প্রকাশিত হয়। হিন্দী ও ইংরাজিতেও লেখা প্রকাশিত হয়েছে। পানামার কবি, রোখেলিও সিনান এর দশটি স্প্যানিশ কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেছেন। 'অনুশীলন পত্রিকা'সুইডেন থেকে রাইটার্স অ্যাওয়ার্ড ২০১৩ সালে পেয়েছেন। ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছে "ঈশ্বর ও মানুষ" ( অণু গল্প ও ছোট গল্প সংকলন)। লেখিকার অভিজ্ঞতাজাত কোভিড সংক্রান্ত বই "কোভিড-১৯ আমার জীবন আমার লড়াই" গাঙচিল থেকে প্রকাশিত হয়েছে, ডিসেম্বর ২০২২ সালে।