আমাদের দেশে সারা বছরই নানান
জায়গায় নানারকম বড় ও ছোট আকারের মেলার আয়োজন করা হয়। বড় আকারের মেলাগুলির মধ্যে
পশ্চিমবাংলার কোচবিহারের রাসমেলা বিশেষ উল্লেখযোগ্য বা অন্যতম । যদিও নবদ্বীপেও
রাস উৎসব মেলা হয় তবে কোচবিহারের রাসমেলা ও নবদ্বীপের রাস মেলার মধ্যে একটা
পার্থক্য আছে । নবদ্বীপের রাসমেলায় রাধা কৃষ্ণের যুগল মূর্তির পূজা করা হয় কিন্তু
কোচবিহারের রাসমেলায় কৃষ্ণকে শ্রীশ্রী মদনমোহন রূপে পূজা করা হয়। তাছাড়া নিজের
বৈশিষ্ট্য ও স্বদেশীয় নিদর্শনের জন্য কোচবিহারে আয়োজিত রাসমেলা একটি বিশেষ স্থান
দখল করে আছে এবং এই মেলাকে বিখ্যাত করেছে। কার্ত্তিক মাসের রাস পূর্ণিমাতেই যে এই
মেলার শুরু তাতো মেলার নামকরণেই স্পষ্ট ।
ছোটবেলায় বাবার মুখে
রাসমেলার গল্প বারবার শুনেছি কিন্তু তখন যাওয়া হয়ে ওঠেনি। গল্প
শুনে কখনও যে মেলায় যাবার ইচ্ছা মনে জাগেনি তা বলাই বাহুল্য,তবে বাবার কাজের চাপেই হয়ত যাওয়া হয়নি। তারপর অনেক বছর কেটে গেছে,তিস্তা,তোরষা বা জলঢাকা নদীতে কত জোয়ার ভাঁটা এসেছে,বর্ষার ক্ষিপ্ত তিস্তা কতবার প্লাবনে জলপাইগুড়ি, কোচবিহারের মানুষকে দুঃখ দিয়েছে তার হিসেব নেই। ২০২১ সালের শেষের দিকে যখন কোবিদ মহামারির পর মানুষের মনের ভয় খানিকটা কমে গেল,কোভিড কালের বন্দী জীবন থেকে মন বেরিয়ে আসতে চাইছে,তখন আমরা সপরিবারে কোচবিহারে রাস মেলা দেখতে যাবার প্ল্যান করলাম । সেই মত যাত্রা শুরু করলাম,আমাদের বাড়ি থেকে টোটো করে ১০ মিনিটে স্টেশন,ট্রেনে করে প্রায় ৪ ঘণ্টার পথ শেষে নিউ কোচবিহার স্টেশনে নেমে অটোতে করে ২০ মিঃ গিয়ে বিশ্ব সিংহ রোডে,হোটেল ইলোরাতে উঠলাম ।পথে প্রায় এই সাড়ে চার ঘণ্টা সময় যে কিভাবে কেটে গেল তা ঠিক বুঝেই উঠতে পারিনি উত্তরবঙ্গের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছোঁয়ায় ।
চার তলার বিশাল আয়তনের
হোটেলটি শহরের প্রাণ কেন্দ্রতেই দাড়িয়ে এবং কোচবিহার শহরের সব আকর্ষণীয় ও দর্শনীয়
স্থানগুলো হোটেলের কাছাকাছি। আর মেলা-তো মাত্র চার পাঁচশ মিটারের দূরত্বে। আমরা
হোটেলে উঠে নিজেদের জিনিসপত্র গুছিয়ে দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম
করে প্রায় বিকেলে রাসমেলা প্রাঙ্গণে মদনমোহন মন্দিরে গিয়ে পৌঁছলাম । তখন সন্ধ্যা
আরতির প্রস্তুতি চলছিল । মন্দিরের পরিবেশ,সম্মুখে
বসানো শ্রীশ্রী মদন মোহনের বিগ্রহ আর শুদ্ধ দেশী বাজনার আওয়াজ হৃদয়ের কোন ছুঁয়ে
গেল গেল,মন আনন্দে ভরে উঠল। মন্দির চত্বরের রাস চক্রটি দেখে বারবার বাবার কথা মনে
পড়ছিল,মনে হচ্ছিল আজ যদি বাবার সঙ্গ পেতাম তাহলে উনিও এই আনন্দটা উপভোগ করতে
পারতেন।
মদনমোহন মন্দিরে সারা বছর
ধরেই লোক সমাগম হয় এবং পূজা পাঠ চলতে থাকে তবে এই রাসমেলার সময় মন্দিরের শোভা এক
আলাদাই মাত্রা পায় । লোক মুখে শোনা কোচবিহারের সতেরতম রাজা মহারাজ হরেন্দ্র
নারায়ণের শাসন কালে (১৭৮৩-১৮৩৯ সাল) এই রাস মেলার শুরু বলেই মনে করা হয় । প্রথম
যখন রাস মেলা শুরু হয় সেই সময় মেলার স্থান ছিল বৈরাগী দিঘির চারিপাশে রাস্তার দুই
ধারে । পরবর্তীতে মেলায় দর্শনার্থীদের ভির বেশী হওয়ায় ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে সেই মেলা মদনমোহন
ঠাকুরবাড়ি প্যারেড গ্রাউন্ডের মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়,সেই থেকেই
রাস মেলা এই মাঠেই হয়ে চলেছে,এখন যাকে
‘রাসমেলা মাঠ’ বলা হয় ।
রাসমেলা রাস পূর্ণিমার দিন
থেকে শুরু হয় এবং ১৫ দিন ধরে চলে । মন্দির কর্তৃপক্ষের কথায় রাসমেলার রাস চক্র
বানানোর অনেক নিয়ম আছে । লক্ষ্মী পূজার দিন থেকে চক্রটি বানানো শুরু করতে হয় এবং
যারা এটি বানায় তাঁরা সেই দিন থেকে নিরামিষ খায়। যারা এই রাস চক্রটি তৈরি করে
তাঁরা মূলত ইসলাম ধর্মী । কথিত আছে সম্প্রীতির বার্তা দিতে মহারাজা তাঁদের এই
গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছিলেন এবং তারাও সে দায়িত্ব সেই থেকে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন
করে আসছে। মন্দির প্রাঙ্গণে যে রাস চক্রটি ঘোরে তার মধ্যে বিভিন্ন দেবদেবীর ফটো
আটকানো থাকে। চক্রটির সৌন্দর্য এবং আকারও বিশেষভাবে মানুষকে আকর্ষণ করে ।মন্দিরে
পুজো দেওয়া ছাড়াও রাস চক্রকে ছুঁয়ে ওটাকে ঘোরানো ও পূতনাকে দেখার জন্য প্রচুর ভক্ত
সমাগম হয়। রাসমেলাতে সম্পূর্ণ বাংলা ও পাশাপাশি রাজ্যের লোকজন ছাড়াও নেপাল,ভুটান ও
বাংলাদেশ থেকেও প্রচুর মানুষের সমাগম হয়ে থাকে । এদের মধ্যে ক্রেতা ও বিক্রেতারা
উভয়েই মেলায় ভীরের বিশেষ কারণ । দেশের ও বিদেশের বিক্রেতারা বিভিন্ন উৎপাদের
সামগ্রীতে দোকান সাজিয়ে যেমন মেলার শ্রীবৃদ্ধি করে এবং বিক্রি করে তেমনি ক্রেতারাও
এখানে এসে নিজের চাহিদামত সামগ্রী ক্রয় করতে পারে । কারণ এই মেলায় নানান রকমারি
খাওয়া দাওয়ার দোকান,হাতের তৈরি নানা সামগ্রী, বাসনের
দোকান, কাপড়ের দোকান, খেলনার দোকান,আসবাব,ইলেকট্রনিক,আরও অনেক
রকমারি দোকান ছাড়াও বড় বা ছোটদের জন্য নাগরদোলা,চরকি,পুতুল নাচ
সহ অন্যান্য আনন্দদায়ক খেলার সমাবেশ হয়।
তাছাড়া মেলায় নানা রকম
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনও হয়ে থাকে। সেই সব কারণে এই রাসমেলা বিশেষ আকর্ষণীয়।
তাই এই রাসমেলা প্রাচীন মেলা হবার সঙ্গে সঙ্গে ভক্তপ্রান মানুষের মিলন মেলা হয়ে
উঠছে ।সব মিলিয়ে দুটি দিনের রাসমেলা ভ্রমণ আমার এবং আমার পরিবারের প্রাণ আনন্দে
ভরে গেল ।
কোচবিহারে এসে রাজবাড়ী
প্যালেস বা কোচবিহার রাজবাড়ী দেখতে যাব না, তা কি করে
সম্ভব! তাই অতি নিকটেই ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা নিপেন্দ্রনারায়ণ কর্তৃক তৈরি
মনোরম রাজপ্রাসাদ ও সেখানে সংরক্ষিত রাজাদের নানান বস্তু ঘুরে দেখা হয়ে গেল । হাতে
সময় কম থাকার দরুন কাছাকাছিতে দেখার মতো অনেক কিছুই যেমন বানেশ্বর শিব মন্দির, সিদ্ধেশ্বরী
কালীবাড়ি,সাগরদিঘী,তিন বিঘা
করিডোর,গসানিমারি রাজপথ ইত্যাদি এবার ছেড়ে দিলাম আগামী দিনে ভ্রমণের জন্য ।
লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
লেখিকার
পরিচিতি -
জন্ম বিহারের
কিশানগঞ্জ । প্রা্থমিক থেকে স্নাতকোত্তর কিষান গঞ্জেই। আঞ্চলিক বার্ষিক পত্রিকা,উত্তরবঙ্গ সংবাদে অনুগল্প,ছোট গল্প লেখালেখি করেন। সঙ্গীত,বই পড়া,ভ্রমণ ও আধ্যাত্মিকতায় রুচিশীল এবং কুসংস্কার বিরোধী ।