ধারাবাহিক উপন্যাস
শেষ পর্ব
( আট )
পরদিনই
ফ্লাইট ধরে ওরা ফিরে এল। অলকেশ এক কথাতেই ফিরে আসতে রাজি হয়ে যাবে মেয়েটি ভাবতে
পারে নি। তবে মেয়েটি স্বস্তি পেল। যা ঘটে গিয়েছে এরপর আর বেড়ানোর আনন্দ থাকে না।
অলকেশ যথারীতি অফিসে জয়েন করে গেল। অযথা ছুটিগুলো নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।
মেয়েটিও সংসারে মন দিয়েছে। বলতে গেলে নতুন
সংসার। একেবারে নিজের মত করে সাজাবে। তারই ফাঁকে অলকেশ বেরিয়ে গেলে নিজের পড়াশুনায়
মন দিতে হবে। কলেজেও যেতে হবে। আর কয়েক মাস মাত্র ক্লাস। তারপরই অনার্সের ফাইনাল
পরীক্ষা। সংসারটা একটু গুছিয়ে নিয়ে কলেজ
যাওয়া শুরু করবে।
সাত দিন যেতে না যেতেই মেয়েটির মনে ঘোর সন্দেহ দানা বাঁধতে লাগল। বড় প্রশ্ন অলকেশকে নিয়েই। তাকে কি সে চিনতে ভুল করল? এতদিন জেনে এসেছে, যে বাড়িতে থাকে সেটা অলকেশের নিজেদের বাড়ি। হঠাৎ পাশের ফ্ল্যাটের একজনের কাছে শুনল অলকেশ নাকি ভাড়া থাকে। আরো এক চাঞ্চল্যকর তথ্য শুনে মেয়েটির ঘুমের দফা রফা। এই চারতলা বিল্ডিংটাতে আটটা ফ্ল্যাট আছে। বারোশো স্কয়ার ফিট করে প্রতিটি ফ্ল্যাট। বেশিরভাগ উচ্চ পদস্থ অফিসার বা ব্যবসাদার থাকেন। বাড়িওয়ালা এখানে থাকেন না। মেয়েটি উপযাজক হয়ে আলাপ করতে গিয়েই সমস্যাটা জোড়ালো হয়েছে। আলাপ করার মূলত দুটি উদ্দেশ্য। প্রথমত যার সঙ্গে ঘর করছে, বেড়াতে গিয়ে তাকে নিয়েই একটা খটকা লাগছে। নিজের স্ত্রীর প্রতি যা ঘটল---কোনো স্বামী কী তা মেনে নিতে পারে? কিছুতেই স্বাভাবিক মনে করতে পারছে না। এ যেন অন্য অলকেশ। অলকেশের একমাত্র বোন ইলা। তার কোনো ট্রেস পাওয়া যাচ্ছে না। গেল কোথায় মেয়েটি? অলকেশকে জিজ্ঞেস করতেই বলল, স্বামীর কাছে চলে গিয়েছে। স্বামী ! ইলা বিবাহিত! তবে তাকে কেন গোপন করে গেল? ইলার ঠিকানা বা মোবাইল নাম্বার কিছুই জানাচ্ছে না, কেন? ইলার যে নাম্বারটা মেয়েটি এতদিন জানতো, সেটাতে বলছে, ডাজ নট এক্সিস্ট। আজ আবার একজনের কাছে শুনল, ইলা অলকেশের স্ত্রী। এ বিল্ডিঙের সবাই নাকি তাই জানে। কি করে সম্ভব!
রাতে
অলকেশ কে চেপে ধরল, " তুমি ইলার মোবাইল নাম্বার দাও, ঠিকানা দাও। আমি ইলার
সঙ্গে দেখা করবো।"
"
ইলাকে কোথায় পাবে? কোথায় পালিয়ে গেছে , কিছুই আমি জানি না।"
"
বাজে কথা বলবে না। তুমি সব জানো। তুমি কেমন দাদা? নিজের বোন পালিয়ে গেলে তার খোঁজ
করবে না? থানায় ডাইরি করেছ? "
"
যে নিজের ইচ্ছেতে পালিয়ে যায়, তাকে খোঁজ করতে যাবো কেন? থানা-পুলিশ করে লোক
হাসাহাসির কোনো মানে আছে?"
"
আমি তো অন্যরকম শুনছি। আশেপাশের ফ্ল্যাটের মানুষজন কি বলছে জানো?"
"
তুমি আবার এদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করেছ? একদম যাবে না। আমি পছন্দ করি না।"
"
না মিশলে জানবো কি করে তোমার কীর্তির কথা। আমার সঙ্গে এতবড় প্রতারণা কি করে করলে
তুমি? ঘরে স্ত্রী থাকতে আবার বিয়ে করলে কোন সাহসে? আমি কিন্তু নিজেই এবার থানায়
যাবো। তোমার গুণের কথা ফাঁস করে দেব। তোমাকে এত সহজে ছেড়ে দেব ভেবেছ? ইলা যে তোমার
স্ত্রী কেন গোপন করে গেলে?"
"
ছি ছি ! কি বাজে কথা বলছো? ইলা আমার নিজের
বোন। এতদিন ধরে মিশলে, ব্যবহারেও টের পেলে না?
ইলা যদি স্ত্রী হতো সে কি আমাদের বিয়েটা মেনে নিত? একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা
মেয়ের সর্বনাশ করে কেউ? এইটুকু বোধজ্ঞান যদি না থাকে আমার কিছু বলার নেই।"
"
এই বিল্ডিঙের সবাই বলেছে ইলা তোমার স্ত্রী। ওরা কেন মিথ্যে বলবে? ওরা কি তোমার
শত্রু?"
"
ও এই ব্যাপার! তাই বলো? বাড়িওয়ালা আন
ম্যারেডদের বাড়ি ভাড়া দেবে না বলে আমাদের একটু মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়েছিল। ওরা যা
বলে বলুক, ওদের কথায় কান দেবে না।"
"
তাহলে ইলার নাম্বারটা দিচ্ছ না কেন? বোন হলেও দাদার খোঁজ করার উচিত নয় কি?"
"
আরে ও একটা ছেলেকে ভালোবাসে। ছেলেটি বেকার, তাই আমি আপত্তি জানিয়েছিলাম। আমার কথা
শুনল না, পালিয়ে গেছে। কি করবো? "
মেয়েটি
ধাঁধাঁয় পড়ে গেছে। কার কথা সত্যি ! ইলাতো তাদের সম্পর্কের কথা জানতো। কখনো কি
বিমর্ষ দেখেছে? বরং বিপরীতটাই দেখেছে। তাদের ব্যাপারে উৎফুল্ল মনেই সহযোগিতা করেছে।
স্ত্রী হলে কি সম্ভব?
দোলাচলে
দিন কাটছে মেয়েটির। না পড়াশুনা, না সংসার, কোনোদিকেই মন নেই। ইলা স্ত্রী হোক বা
বোন --- এভাবে উধাও হয়ে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। নিশ্চয়ই এরমধ্যে কোনো
চালিয়াতি আছে। অলকেশের ব্যবহারেও রহস্যময় মনে হচ্ছে। পেটে মুখে রাতদিন তফাৎ।
অলকেশ
অফিস বেরিয়ে গেলে মেয়েটি স্নান খাওয়া করে কলেজে আসছে রোজই কিন্তু মস্তিস্ক কিছুই
নিতে পারছে না। একটাই ভাবনা মাথার মধ্যে শুধু ঘোরপাক খাচ্ছে। ব্রেইন অন্য দিকে
কাজই করছে না। পড়াশুনা লাটে উঠেছে। সেদিন
কলেজে বসেই মাথায় একটা বুদ্ধি এল। তৎক্ষণাৎ ছুটল কলেজের অফিসে। ভদ্রলোকের নাম
জীবন। তিনিই তাদের কলেজের ফিস ইত্যাদি জমা নেন। তাকেই বলল, " জীবনদা, আমার এক
বন্ধু ইলা, একসঙ্গেই পড়ি। শুনছি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অনেক দিন ধরে কলেজে আসছে
না। রেজিস্টার দেখে ওর বাড়ির ঠিকানাটা একটু দেবেন? তাহলে আমরা কয়েক বন্ধু মিলে
খোঁজ নিয়ে আসতে পারি।"
জীবনদা
বললেন," তুমি ঐ নির্মল বাবুর কাছে যাও। তিনি রেজিস্টার দেখে বলে দেবেন।"
নির্মল
বাবুকে বলতেই এক কথাতেই রেকর্ড দেখে ঠিকানা বলে দিলেন। প্রথমে ইলা বলে কাউকে পেলেন
না। পরে মনে হল ইলার কলেজের নাম সুলেখা। নামটা বলতেই অতটা খুঁজতে হল না। তবে
ঠিকানা দেখে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। অনেক দূর, সেই মেমারী। ট্রেনে ছাড়া উপায়
নেই। তবু সিদ্ধান্ত নিল, সে মেমারীতেই যাবে। সঠিক তথ্য না জানা পর্যন্ত স্বস্তি
নেই।
পরদিন
যথারীতি অলকেশ বেরিয়ে যাওয়ার দশ মিনিট পরে মেয়েটিও বেরিয়ে পড়ল। বাসে করে প্রথমে
গেল হাওড়া স্টেশন। তারপর মেমারীর রিটার্ন টিকিট কেটে মেইন লাইনের বর্ধমানের ট্রেনে
চেপে বসল। এদিকের ট্রেনে কখনো কোথাও গেছে কিনা মনে করতে পারছে না। তবে সব কেমন
চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কয়েকজন যাত্রীকেও কোথায় যেন দেখেছে। ভাবছে আর মনে মনে হাসছে।
সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? না হলে এই লাইনে
তার চেনা আসবে কোথা থেকে?
মেমারী
স্টেশনে ট্রেন ঢুকল ঠিক বারোটা বেজে দশ মিনিটে। নেমেই এক চায়ের দোকানে ঠিকানাটি
দেখাতেই বললেন, আপনি ডান দিক দিয়ে নিচে নেমে যান। ওখানে টোটো পাবেন। আধ ঘন্টা
লাগবে।
টোটোর
ছেলেটি খুব ভদ্র। গ্রামের ভেতর দিয়ে অলি গলি পেরিয়ে বাড়ির সম্মুখে নামিয়ে দিল।
" ওই তো, ওই বাড়িটা সুলেখা দিদিমণির বাড়ি।"
মাটির
বাড়ি। মাথায় খড়ের ছাউনি। এক পলক দেখেই বোঝা যায় গরিবের আস্তানা। ছোট একটি
বারান্দার মত আছে। তাতে এক
বুড়ি বসে বসে এক মনে আনাজ কাটছে। মেয়েটি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল," এটা কি সুলেখাদের বাড়ি?"
বুড়ি
চশমার ফাঁক দিয়ে একবার দেখলেন। খুব বয়স্কা বলা যাবে না। বোধকরি ষাট বছরের নিচেই
হবে। সাদা থান পরেছেন বলে বেশি বয়স মনে
হচ্ছে। তিনি বললেন, কে মা তুমি? কোথা থেকে এসেছ?
মেয়েটি
বলল," আমি সুলেখার বন্ধু। আমরা এক সঙ্গে কলেজে পড়ি। অনেকদিন কলেজে যাচ্ছে না
বলে খবর নিতে এলাম। সুলেখা বাড়ি নেই?"
বুড়ি
বললেন," আছে। একটু পাশের বাড়ি গেছে। তুমি ওই মাদুরটায় বসো মা। এক্ষুনি এসে
পড়বে।"
মেয়েটি
বলল," সুলেখা কলেজে যাচ্ছে না কেন মাসিমা? আমি ভাবলাম বোধহয় শরীর খারাপ
করেছে।"
"
শরীর খারাপ করেনি মা। আমাদের মত মানুষদের লেখাপড়া করা যে কি কষ্ট কি বলব তোমাকে।
মাধ্যমিক পাশ করার পরই ওর বাবা মারা গেল। আমি কোনরকমে উচ্চমাধ্যমিকটা পাশ করিয়েছি।
তারপর আর পারলাম না মা। তবে মেয়ের জেদ, কলেজে ভর্তি হবেই। কিন্তু টাকা কোথায় বলো?
আমি দু'বাড়িতে রান্না করে কোনরকমে ঠেকা দিচ্ছি। মেয়ে কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ
করে কলকাতায় একটা চাকরি জোগাড় করল। সেই ভরসায় কলেজে ভর্তি হল। এখন শুনছি সেই
চাকরিও নাকি চলে গেছে। আর কি পড়া
হবে? ওই তো সুলেখা আসছে।"
ইলা
মেয়েটিকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠল," কি ব্যাপার? তুই এখানে? আমার ঠিকানা
পেলি কি করে?"
"
ঠিকানা পাওয়া কি এমন শক্ত কাজ? ইচ্ছে থাকলে অসম্ভব বলে কিছু আছে পৃথিবীতে?"
ইলা
বলল," চল, আমরা ওই গাছ তলায় গিয়ে বসি। মা, তুমি রান্নাটা চাপিয়ে দাও। আমি
বন্ধুর সঙ্গে একটু কথা বলি। অনেক দূর থেকে এসেছে। একটু চাল বেশি নিও। আমাদের এখানে
দুটো ডালভাত খেয়ে যাবে।"
মেয়েটি
বলল," না না, আমি খেয়েই বেরিয়েছি। বেশিক্ষণ বসব না। দুটো কথা বলেই চলে
যাব।"
বাড়ি
থেকে সামান্য তফাতে একটি আম গাছ আছে। খুব বেশি বড় না হলেও শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে
ছাতার মত সুন্দর আকার নিয়েছে। পাতাগুলো সতেজ এবং বেশ প্রাণবন্ত। ওরা গাছের নিচে
একটি কাঠের বেঞ্চ নিয়ে গিয়ে বসল।
ইলা
বলল," আগে বল, আমার ঠিকানা পেলি কি করে?
আমার ঠিকানা তো কারোর জানার কথা নয়?"
"
কলেজ থেকে নিয়েছি। বাদ দে ওসব কথা। আমি যার জন্য ছুটে এসেছি। জেনেশুনে আমার জীবনটা এভাবে নষ্ট করলি কেন?
"
"মানে?
আমি নষ্ট করেছি? কি বলতে চাইছিস তুই?"
"
নষ্ট করিস নি? অলকেশ ছেলেটি কেমন তুই জানিস। তোরা
স্বামী-স্ত্রীর মত থাকতিস তাও আমি জেনেছি। অথচ আমাকে ভাই-বোন
সম্পর্কের কথা শুনিয়েছিস। বন্ধু হয়ে আমার সঙ্গে কেন এমন প্রতারণা করলি?"
ইলার
মুখে কোনো কথা নেই। বেশ কয়েক মিনিট চুপ থাকার পর বলল," বলতে পারিস নিজেকে
বাঁচাতে। আত্মরক্ষার্থে এই পথ বেছে নিতে হয়েছে।"
"
ইলা ! তুই এমনটা করতে পারলি?"
"এছাড়া
কোনো উপায় ছিল না। তুই আমায় ভুল বুঝিস না। আমার সমস্ত ঘটনা শুনলে তুই অনুভব করতে
পারবি, কেন আমি এমনটা করলাম। বলব। তোকে সব বলব। আজ
নয়। অন্য একদিন। সারাদিন লেগে যাবে আমার কাহিনী শুনতে। শুধু এইটুকু তোকে জানাই, সবসময় ওর থেকে সতর্ক থাকবি। তোকে নিয়ে কিন্তু ব্যবসা করার পরিকল্পনা ওর। ওটা তুই কিছুতেই হতে দিবি না।
বিয়ে-ফিয়ে লোক দেখানো। জোর প্রতিবাদ
করবি। প্রয়োজনে গায়ের সর্ব শক্তি দিয়ে
গর্জে উঠবি। তবেই তোর প্রতি আগ্রহ হারাবে। আমি ওভাবেই সরে আসতে পেরেছি। জানে গরিব
মানুষ, থানা পুলিশ করার সাহস পাবে না। সেই ভাবেই মেয়ে পাকড়াও করার ধান্দায়
থাকে। তোর বাড়ির সমস্ত খবরাখবর নিয়েই
কিন্তু তোকে টার্গেট করেছে। জানে বাবা-মা নেই। কাকা-জ্যাঠাদের কাছে অবহেলায় মানুষ।
তার উপর লগ্নভ্রষ্ট। "
মেয়েটি
শুনে হতভম্ব ! একী শুনছে সে ! জীবনটা তার এই ভাবে বরবাদ হয়ে গেল ! না সে কিছুতেই
ছাড়বে না। মেয়েদের নিয়ে ব্যবসা ! করাচ্ছি ! কালই থানায় গিয়ে রিপোর্ট করে আসবে। পুলিশের সাহায্য ছাড়া
কোনোমতেই সম্ভব নয়।
ইলা
বলল," কি ভাবছিস? তুইই পারবি ওকে শাস্তি দিতে। তোকে দেখে যা বুঝেছি তোর সেই
ক্ষমতা আছে। আমি তোকে বাইরে থেকে সাহায্য করবো। আমার ফোন নাম্বারটা নিয়ে যা।
প্রয়োজনে ফোন করিস। যথাসাধ্য হেল্প করবো। আরেকটা কথা বলে রাখি, অলকেশ কিন্তু কোনও
চাকরি করে না। মেয়ে পাচার চক্রের সঙ্গে যুক্ত। সেই
ধান্দায় ঘুরে বেড়ায়।"
মেয়েটি
বলল," আজ আমি উঠছি বুঝলি। সব বুঝে গিয়েছি। এবার দেখবি আমার মত খারাপ মেয়ে
পৃথিবীতে আর একটিও পাবি না। তুই শুধু দেখে
যা আমি কি করতে পারি। চললাম। পরে ফোন করবো।"
* * *
* *
সেদিন
রাতেই ঘটনাটি ঘটল। মেয়েটি মেমারী থেকে
ফিরে এসেই পরিকল্পনা করতে লাগল। কি কি পদক্ষেপ নেবে। আপাতত নিজেকে স্বাভাবিক রাখার
চেষ্টা করল। পরদিন সকাল হলেই অলকেশ বেরিয়ে গেলে প্রথম কাজ থানায় গিয়ে রিপোর্ট করে আসবে। থানার ফোন
নাম্বারও নিয়ে আসবে। তারপর এক এক করে ভাবনাগুলো প্রয়োগ করবে।
অলকেশের
বাড়ি ফেরার কোনও নির্দিষ্ট টাইম নেই। কোনো কোনো দিন একটু রাত করে ফেরে আবার সন্ধে
নাগাদও চলে আসে। সেদিন ফিরল রাত দশটায়। সঙ্গে এক বন্ধুকে নিয়ে ঢুকল। মেয়েটি রাতের খাবার তৈরি করে এবং রুটি বানিয়ে
হট পটে রেখে কলেজের বইপত্র নিয়ে বসেছিল। পড়ায়
মন বসানো শক্ত। যার জীবনটাই টলোমলো সে পড়ায় মনোনিবেশ করে কী করে? ওদিকে অলকেশ অন্য ঘরে বন্ধুকে নিয়ে মদের আসর বসিয়েছে। রাত এগারোটা নাগাদ
মেয়েটি রাতের খাবার খেয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। শীতের রাত। অলকেশের খাওয়ার জন্য
আর কতক্ষন অপেক্ষা করবে?
রাত
তখন পৌনে একটা। অলকেশ দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। মেয়েটির নানা ভাবনার মধ্যেও চোখ দুটো
সবে লেগে এসেছিল। সারাদিন
ধকল তো কম যায় নি। অগত্যা ধড়মড় করে উঠে
দরজা খুলল। খুলতেই বন্ধুকে নিয়ে ঢুকে পড়ল। দুজনেই বিছানায় সটান। মেয়েটি কি করতে
পারে? চলে গেল পাশের ঘরে। তখনই বন্ধুটি জাপটে ধরল, কোথায়
যাচ্ছ ডার্লিং। এসো, এখানেই শুয়ে পড়ি।
সারাদিন
ধরেই মেয়েটি ফুঁসছে। টেবিলের উপর ছিল একটি স্টিলের বড় গ্লাস। কোনরকমে নিজেকে
ছাড়িয়ে নিয়ে গ্লাসটা গায়ের জোরে ছুঁড়ে মারল বন্ধুটির দিকে। লেগেছে একেবারে কপালে।
মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল মেঝেতে। অলকেশ চিৎকার করে উঠল," এত বড় সাহস। বন্ধুর
গায়ে হাত তুলিস।" বলেই হাত ধরে টেনে বিছানায় ঠেলে দিল।
মেয়েটির
তখন রাগে ব্রম্ম তালু পর্যন্ত জ্বলছে। ছুটে গিয়ে রান্না ঘর থেকে আনাজ কাটার ধারালো
বড় ছুরিটা নিয়ে এসে অলকেশকে এলোপাথাড়ি মারতে লাগল। সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তবু মেয়েটি থামছে
না। গায়ের জোরে ছুরি চালাতে লাগল। অলকেশ মাটিতে পড়ে গিয়ে কাটা পাঠার মত ছটফট করছে।
এক সময় নিস্তেজ হয়ে যায়। তখনই মেয়েটির হুশ ফেরে। একী করল সে? নাকের কাছে হাত দিয়ে
দেখল নিশ্বাস পড়ছে না। স্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। অর্থাৎ অলকেশকে নিজেই মেরে
ফেলল। মেয়েটি দিশেহারা। কি করবে এখন? বন্ধুটি কখন পালিয়েছে টেরই পায় নি। থানায়
গিয়ে সারেন্ডার করা ছাড়া আর কী উপায় আছে তার !........
* * *
* * *
সকাল
নটা। লকাপের মধ্যে মেয়েটি সারারাত বসেই কাটিয়ে দিয়েছে। এক বিন্দু ঘুমোয়নি। শুধু
ভাবছিল, তার কী শাস্তি হতে পারে। ফাঁসি? না যাবজ্জীবন? ফাঁসি হলেই মুক্তি।
বড়বাবুকে বলবে তার যেন ফাঁসি হয়, সেই ভাবেই যেন কেস সাজায়। সারারাত জেগে থেকে
সকালের দিকে চোখটা লেগে এসেছিল। ঘুম ঠিক
নয়, তন্দ্রা মত। তখনই একজন পুলিশ এসে লকাপ খুলল,
" চলুন, আপনাকে বড়বাবু ডাকছেন।"
বড়বাবু
এখন একা আছেন। এই সুযোগে তার মনের কথাগুলো বলে ফেলতে হবে। না হলে আর সুযোগ পাবে
না। মৃত্যুর আগে অন্তত একজনকে বলে যেতে পারল, এটাই বড় স্বান্তনা।
বড়বাবু
বললেন, " বসুন চেয়ারটায়।" একজন খুনিকে এইভাবে কেউ আদর করে বসতে বলেন,
মেয়েটির জানা নেই। কোমরে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যায় বলেই তার ধারণা।
বড়বাবু
বললেন," আপনি তো সাংঘাতিক মেয়ে। এই
ভাবে কেউ কাউকে মারে?"
"
কি কারণে কি পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে এমন ভাবে মেরেছি আপনাকে স্যার বলে যেতে চাই।
না হলে আর সুযোগ পাবো না। জানি আমার শাস্তি, মৃত্যুদন্ড। তার আগে একান্তে আমার জবানবন্দি দিয়ে যেতে চাই। আমার এই শেষ
অনুরোধটা রাখুন স্যার।"
"
ঠিক আছে। আমি আপনার সব কথা শুনবো। তার আগে
বলি, আপনার স্বামীর একটা মেজর অপারেশন করতে হয়েছে। হসপিটালে
আছে। এখন জ্ঞান ফিরেছে। আপনি কি একবার দেখা করতে চান?"
মেয়েটি
থমকে গেল। হতবাক ! অলকেশ বেঁচে গেল ! কি করে সম্ভব! আরো জটিলতা যে বাড়তে চলেছে
ভেবেই মেয়েটি মুষড়ে পড়ল। বলল," না স্যার। ওই শয়তানটার মুখ দর্শন করতে চাই না।
ওর থেকে আমি মুক্তি চাই।"
"ঠিক
আছে। আপনি এখন যান।আপনার কথা একটু পরে শুনছি।... যাও একে নিয়ে যাও।
সমাপ্ত
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক পরিচিতি -
নিত্যরঞ্জন দেবনাথ পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়ার পানুহাটে ১৯৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন।কাটোয়া কলেজ থেকে বাণিজ্যে স্নাতক। বর্তমানে থাকেন হুগলির চুঁচুড়ায়। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী ছিলেন।অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল-এর অধীন ডিভিশনাল অ্যাকাউন্টস অফিসার পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম গল্প " চেতনা " ছোটদের পত্রিকা শুকতারায় ১৯৯৬ - এর এপ্রিলে প্রকাশিত হয়। এরপর দেশ, শিলাদিত্য, কালি ও কলম,মাতৃশক্তি, তথ্যকেন্দ্র, কলেজস্ট্রিট, কথাসাহিত্য, দৈনিক স্টেটসম্যান, যুগশঙ্খ, একদিন,,সুখবর ইত্যাদি এবং বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে নিয়মিত তাঁর সাহিত্যকীর্তি অব্যাহত। ইতিমধ্যে পাঁচটি গল্প সংকলন ও চারটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক "শতানীক " পত্রিকাটি দীর্ঘদিন ধরে সম্পাদনা করে আসছেন।