অনিচ্ছাসত্ত্বেও বৃষ্টিকে অফিসের কাজে দিল্লী যেতে হোল। অনেক চেষ্টা
করে বসকে বলেও আটকাতে পারলোনা। যেহেতু সে দিল্লীর মেয়ে তাই জায়গাটাও তার পরিচিত
বলে অফিস থেকে তাকেই পাঠানো হয়েছে। দিল্লীর নেহেরু প্লেসের এক অফিসে কাজ আছে তাই
লাজপত নগরের বিক্রম হোটেলেই অফিস থেকে বুকিং করে দিয়েছে।
(১)
বৃষ্টির জন্ম ও পড়াশুনা দিল্লীতেই, তাই দিল্লীর
রাস্তা ঘাট ওর কাছে খুব পরিচিত। দিল্লীর লোকেদের নার্ভও ওর ভাল ভাবে জানা। মনে পরে
যায় সেই ছেলেবেলার কথা। বাবা, মা-র হাত ধরে
ছুটির দিনে ইণ্ডিয়া গেটের সামনে বেড়াতে যাওয়া, মনে পরে সেই
দিনগুলো যখন লোদী গার্ডেনের বা মোগল গার্ডেনের ফুলগুলো হাতছানি দিয়ে ডাকতো, মনটা চলে যেত সেই স্বপ্নপুরীর এক অচিন রাজ্যে। কলকাতায় এসে বৃষ্টি
একটা জিনিষ স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে যে উত্তর ভারতের লোকেরা কেন এত কাঠখোট্টা আর
কলকাতার লোকেরা কেন এত নরম ও কমনীয়। এটা সম্ভবত: মাটীরগুণ। সেখানকার মাটী শক্ত বলে
সেখানকার মানুষগুলো যেন খুব শক্ত, পোক্ত আর
বাংলার মাটি নরম বলেই হয়তো মানুষগুলোও নরম প্রকৃতির। অনেকটা সমুদ্রের মাছ আর
পুকুরের মাছের মত। সমুদ্রের মাছগুলো বাঁচার লড়াই-এ শক্ত,পোক্ত ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আর পুকুরের মাছগুলো হয় একটু নরম গোছের।
ঠিক এই কারণেই হয়তো ইন্দ্রজিতের মনটাও ছিল শক্ত ও কাঠখোট্টা আর তাই বৃষ্টিকে বুঝে
উঠতে চাইলো না বা পারলো না। না হলে ইন্দ্র কি একবার ও তাকে আটকাতে পারতো না? একটা অভিমানের বশে এতদিনের সব স্বপ্ন ছাড়খার হয়ে গেল। এই দুঃখেই সে আজ
মা, বাবাকে নিয়ে কলকাতায় শিফট করে গেছে। দিল্লী যেতে
মন চায় না। ঐ পুরানো স্মৃতিগুলো তাকে বড় কষ্ট দেয়। সেই পুরানো রাস্তা, লোদী গার্ডেন,
যেখানে সে ইন্দ্রজিতের
হাত ধরে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়িয়েছে সেগুলো যেন তাকে দেখে আজও বিদ্রূপ করে আর
প্রেমের বদনাম করে বেড়ায়। হঠাৎ একটা বড় ভূমিকম্পে মনে হল ওদের স্বপ্নের প্রাসাদটা
ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ইন্দ্র কি পারতো না তাকে ফিরিয়ে নিতে? ইন্দ্রর মনটা যে এত কঠোর তা বৃষ্টি বিয়ের আগে একবারও বোঝেনি, বরং সব বিপদে ইন্দ্র তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তাকে বাঁচানোর জন্য।
( ২ )
অফিসের কথামত বৃষ্টি দিল্লিতে মুলচান্দ-এর কাছে বিক্রম হোটেলে উঠেছে।
কোন অসুবিধেই হয় নি তার। অফিস থেকেই সব ব্যবস্থা করা ছিল, তাছাড়া দিল্লি তার চেনা শহর। প্রতিটি ইট, কাঠ,
পাথর মনে হয় তার চেনা।
তবে বহুদিন বাদে এলো বলে সব কিছুই যেন নতুন নতুন মনে হচ্ছে। কত নতুন নতুন ফ্লাইওভার
হয়েছে, হয়েছে মেট্রো রেল। লোকসংখ্যাও বেড়ে গেছে অনেক।
প্রথম কয়েকদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকাতে অন্যদিকে মন দিতে পারেনি।
সকাল থেকেই মিটিং,
প্রেযেন্টেশান, লাঞ্চ,
ডিনার এসবের মধ্যেই কেটে
গেছে কয়েকদিন। প্রতিদিন কলকাতা অফিসের বসকে প্রতিদিনকার রিপোর্ট-ও দিতে হয়েছে
নিয়মিত। যেদিন থেকে হোটেল ম্যানেজারের নামটা বৃষ্টির চোখে পড়েছে, সেদিন থেকেই একটা অঙ্ক কিছুতেই সে মিলিয়ে উঠতে পারছে না। কয়েকবার
ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে গিয়েও সফল হয়নি। তার কৌতূহলটা আরও বেড়ে গিয়েছিল। তার
ওপর তার নাম লেখা রুমালটা আজ হারিয়ে যাওয়াতে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেছে। কতদিন ধরে
রুমালটাকে সে হাত ছাড়া করেনি। আজ তাই মনটা এমনিতেই খারাপ।
অফিসের কাজটাও গতকাল শেষ হয়ে যাওয়াতে আজই সে কলকাতার ট্রেন ধরবে
ভেবেছে। তৎকাল কোঠায় একটা টিকিটও জোগাড় হয়ে গেছে। এই হোটেলে প্রায় সব সুবিধাই আছে।
তারাই টিকিটটা কেটে দিতে সাহায্য করেছে। এই সব বড় বড় হোটেলে এই একটা সুবিধা আছে, এরা ট্রেন ও প্লেনের টিকিট থেকে শুরু করে প্রাইভেট গাড়িরও ব্যবস্থা
করে দেয়। মহিলা হয়েও বৃষ্টির কোন অসুবিধাতেই পড়তে হয় নি। তাই হোটেল থেকে বাইরে
আসার সময় ও ম্যানেজার কে একটা ধন্যবাদ দিতে গিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল অবশ্য অন্য। এই
অজুহাতে ম্যানেজারকে একবার দেখে আসা। না, কিন্তু দেখা
হল না। তাই কৌতূহলটা রয়েই গেল। বাইরে আসার সময় বেয়ারাটাকে ম্যানেজারকে দেবার জন্য
একটা চিঠি লিখে এসেছে। তার এত প্রিয় নাম লেখা রুমালটা হারিয়ে যাওয়াতে মনটা একটু
খারাপ হয়ে আছে। এত তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পেল না সে।
হোটেলের বাইরের দরজার বাইরে এসে গাড়ীর অপেক্ষা করতে লাগলো। সামনেই
একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ নজরে পড়ল। গাছটা ফুলে ফুলে ঢেকে গেছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু
হয়েছে। বৃষ্টির জল পেয়ে ফুলগুলো যেন আরও সতেজ, সুন্দর
দেখাচ্ছে। ফুলের লাল আভা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে ফুলগুলো যেন বলছে – আজ
আমাদের রূপ, সৌন্দর্য না দেখে তোমার উপায় নেই। প্রস্ফুটিত
ফুলগুলি তার মনকে ছুঁয়ে ফেলেছে। তার হৃদয়ে যেন বিদ্যুতের তরঙ্গ বইতে শুরু
করেছে।
- আচ্ছা আমার জীবনটাও তো এরকম
হতে পারতো?
এক এক করে চোখের সামনে সেই পুরানো দৃশ্যগুলো ফুটে উঠতে লাগলো।
ইন্দ্রজিৎ চাইলে তো তাকে হাত ধরে টেনে আটকাতে পারতো। নিজের করে নিতে পারতো। তাহলে
বৃষ্টির জীবনটাও আজ কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলির মত প্রস্ফুটিত হতে পারতো। মনে পড়ে তার
প্রথম রাতে ইন্দ্র যখন তাকে নিজের করে নিতে চেয়েছিল, তখন বৃষ্টিও তার সর্বস্ব তাকে সঁপে দিয়ে দু’জনে এক আনন্দ জোয়ারে
হারিয়ে গিয়েছিল। ইন্দ্র যখন তাকে দু’বাহুর মধ্যে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল তখন ইন্দ্র-র
বাহুবন্ধনে বড় নিরাপদ লেগেছিল। ওর আঙ্গুলগুলো প্রথমে ঠোঁট ছুঁয়ে ক্রমশ: দেহের
অলিতে গলিতে ঘুরতে ঘুরতে নীচে নেমে আসছিল। বৃষ্টি বলে উঠেছিল - আজ কি না হলেই নয়? অনেক সময় তো পরে আছে। কিন্তু ইন্দ্র সেদিন কোন বাধাই মানেনি। ইন্দ্রর
মাথায় তখন এক অন্য উত্তেজনা। বৃষ্টিও আর পারেনি, নিজের
সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছিল ইন্দ্রকে খুশী করতে। ইন্দ্রর সর্বাঙ্গে তখন বিদ্যুতের
তরঙ্গ যেন বৃষ্টিকে আরও আনন্দ দিচ্ছিল।
ইন্দ্র সেদিন তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে বলেছিল - বৃষ্টি, আমি তোমাকে
ছাড়া বাঁচবো না। তোমাকে কখনও নিজের কাছ থেকে দূরে হতে দেব না। আরও কত কি। সেদিন
বৃষ্টিও তার কাছে সর্বস্ব সমর্পণ করে এক পরিতৃপ্তির আনন্দ পেয়েছিল। তারপর ইন্দ্রর মাথা বুকে রেখে গভীর প্রেম সাগরে
হাবুডুবু খেতে খেতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়াল নেই। ঘুম ভেঙে দেখে তখনও ইন্দ্র তার
হাতটাকে বুকে জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে। অথচ বৃষ্টির চাকরী করাটা ইন্দ্র কিছুতেই মেনে নিতে
পারলো না । এই তুচ্ছ একটা কারণে বৃষ্টি যখন বাড়ী থেকে বেড়িয়ে এলো, তখন ইন্দ্র কি পারতো না তার হাত দুটো ধরে আটকে দিতে? কেন ইন্দ্র তাকে ফেরালো না। তাহলে হয়তো তারও জীবনটা ঐ ফুলগুলোর মতো
জীবন্ত প্রস্ফুটিত হতে পারতো।
গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি গায়ে পরতেই বৃষ্টিতে সম্বিত ফিরে এলো। বৃষ্টির জল
পেয়ে কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলোকে আরও সতেজ ও জীবন্ত মনে হতে লাগলো। আচমকা কার গলার আওয়াজে
পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে স্যুট, বুট-পড়া, মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি মুখে
এক ভদ্রলোক বৃষ্টির হারানো রুমালটা এগিয়ে দিয়ে বলল – হোটেলের এই রূমালটা ফ্লোরে
কুড়িয়ে পেয়ে বেয়ারা আমার কাছে জমা দিয়ে যায় আর সঙ্গে এই চিঠিটাও দিয়ে যায়। বৃষ্টি
কয়েক মূহুর্ত্তের জন্য বোবা হয়ে গেল। ভদ্রলোককে খুব চেনা মনে হচ্ছে। হ্যাঁ সেই
গলার আওয়াজ। তবে কি ও বৃষ্টিকে চিনতে পারেনি। ভদ্রলোক বৃষ্টির সুটকেসটা তুলে নিয়ে
বলল – এবার আমার সাথে চল।
বৃষ্টি কি বলবে বা কি করবে বোঝার আগেই ইন্দ্র ওর হাত ধরে হোটেলে ফেরত
যেতে লাগলো। আকাশে তখনও বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টির বেগ আরও বেড়ে গেছে। ওরা
দু’-জনেই ভিজতে ভিজতে হোটেলের দিকে পা- বাড়াল। ট্যাক্সি ড্রাইভার কোন অলক্ষ্যে এসে
দাঁড়িয়েছে বৃষ্টি তা লক্ষ্যই করেনি। ট্যাক্সি ড্রাইভারের হর্ন শুনে বৃষ্টি ভাবছে
সে ভুল করছে না তো। একবার ট্যাক্সির দিকে তাকিয়ে তাঁকে ইশারায় যেতে বলে দিল। তার
মনে তখন বসন্তের হিন্দোল শুরু হয়েছে। কৃষ্ণচূড়া গাছটা যেন আরও সুন্দর দেখাচ্ছে।
বৃষ্টিতে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। রামধনুর সাত রঙ
তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে।
সমাপ্ত
লেখক পরিচিতি –
কালীপদ চক্রবর্ত্তী দিল্লি থেকে প্রায় ১৮ বছর ‘মাতৃমন্দির সংবাদ’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন এবং ‘সৃষ্টি সাহিত্য আসর’ পরিচালনা করেছেন।
দিল্লি, কলকাতা এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখেন। কলকাতার আনন্দমেলা, আনন্দবাজার পত্রিকা, সাপ্তাহিক বর্তমান, দৈনিক বর্তমান, নবকল্লোল, শুকতারা, শিলাদিত্য, সুখবর, গৃহশোভা, কিশোর ভারতী, চিরসবুজ লেখা (শিশু কিশোর আকাদেমী, পশ্চিমবঙ্গ সরকার), সন্দেশ, প্রসাদ, ছোটদের প্রসাদ, কলেজস্ট্রীট, উল্টোরথ, তথ্যকেন্দ্র, জাগ্রত বিবেক (দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির থেকে প্রকাশিত) , স্টেটসম্যান , কিশোর বার্তা অন্যান্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রকাশিত বই-এর সংখ্যা ১০ টি এবং প্রকাশের পথে ৩টি বই।
‘ভারত বাংলাদেশ সাহিত্য সংহতি সম্মান’, পূর্বোত্তর আকাদেমির পুরস্কার, ‘বরুণা অসি’-র গল্প প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভ, আরত্রিক সম্মান, তুষকুটি পত্রিকা সম্মান, কাশীরাম দাস সম্মান, সতীনাথ ভাদুড়ী সম্মান লাভ করেন। ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে 'আজীবন সম্মাননা' লাভ করেন। এ ছাড়া আরও কিছু পুরস্কার লাভ করেছেন।
বর্তমানে দিল্লি থেকে প্রকাশিত 'কলমের সাত রঙ' ও www.tatkhanik.com এর সম্পাদক এবং দিল্লিতে প্রতিমাসে একটি সাহিত্য সভা পরিচালনা করেন।