কলকাতায়
যতগুলো কালীপীঠ আছে তাদের মধ্যে কালীঘাট হলো সবচেয়ে প্রাচীন। সে কারণেই এ মন্দির
এক তীর্থে পরিণত হয়েছে। তাই কালীঘাটকে কলিতীর্থ বলা হয়। জানাযায় কালীঘাটের এই
মন্দিরটি ১৮০৯ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল। বড়িশার সাবর্ণ চৌধুরী বংশের সন্তোষ রায়
এবং তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র রাজীবলোচন রায়ের প্রচেষ্টা এবং বদান্যতায় তৈরি হয়েছিল
কালীঘাটের এই বর্তমান মন্দিরটি।
এই মন্দির আট কাঠা
জায়গার ওপর অবস্থিত। এর উচ্চতা হলো ষাট হাত। সে সময়ে, অর্থাৎ শতাধিক বছর
পূর্বে এই মন্দিরটি তৈরি করতে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা এবং তৈরি করতে
প্রায় সাত-আট বছর সময় লেগেছিল।
কালীঘাটকে বলা হয়
একান্ন পীঠের মধ্যে অন্যতম পীঠ। কথিত আছে , সতীর দক্ষিণ পায়ের
আঙুল পড়েছিল এই জায়গায়। আধুনিক তন্ত্র শাস্ত্র, যেমন — আচার
নির্ণয় তন্ত্র, মহালিঙ্গ বচন তন্ত্র , চূড়ামণি তন্ত্র প্রভৃতিতে কালীঘাটের বর্ণনা পাওয়া গেলেও কোন পুরাণে ও
কোন প্রাচীন তন্ত্রে কিন্তু কালীঘাটের উল্লেখ পাওয়া যায় না। কেবল মহানীল তন্ত্রে
কালীঘাটে গুহ্যকালী’-র উল্লেখ পাওয়া যায়। কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ১৫৫৪
খৃষ্টাব্দে রচিত চন্ডীকাব্যে গঙ্গাতীরের যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে অবশ্য কালীঘাটের
নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।
কালীঘাটের
উৎপত্তির পৌরাণিক কাহিনী হয়তো অনেকেরই অজানা নয়। কথিত আছে রাজর্ষি ‘দক্ষ’- র
যজ্ঞে তাঁর জামাই শিব ব্যতীত সকলেই নিমন্ত্রিত হয়ে ছিলেন এবং উক্ত সভায় দেব, যক্ষ
, রক্ষ , গন্ধর্ব , কিন্নর , মুনি ঋষি প্রভৃতি উপস্থিত নিমন্ত্রিতদের
সামনে বাবার মুখে স্বামীর সম্বন্ধে নিন্দাসূচক বাক্য সহ্য করতে না পেরে অভিমানে
মর্ম জ্বালায় সতী সেখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। খরব পেয়ে শিব সেখানে উপস্থিত হয়ে
ক্রোধে সতীর প্রাণহীন দেহ নিজের কাঁধের ওপর নিয়ে উন্মাদের মতো তান্ডব শুরু
করেছিলেন। বিভিন্ন দেবতাদের অনুরোধে তখন বিষ্ণু সুদর্শনচক্র দিয়ে সতীর দেহ খন্ড -
বিখন্ড করে বিভিন্ন স্থানে নিক্ষেপ করেছিলেন। সতীদেহের এই ছিন্নাংশ যেখানে যেখানে
পড়েছিল পরবর্তী কালে সেই সব জায়গা পীঠ বা শক্তিক্ষেত্র হিসাবে পরিগণিত হয়। সতীর
এই খন্ডিত দেহাংশ থেকেই একান্ন পীঠের উৎপত্তি। কিংবদন্তী অনুসারে কালীঘাটে সতীর
ডান পায়ের আঙুল পড়েছিল, তাই কালীঘাট অন্যতম পবিত্র
শক্তিপীঠ হিসাবে পরিচিত। হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের ‘কলিকাতা সেকালের ও একালের’
গ্রন্থে পাওয়া যায় — ‘এরূপ জনপ্রবাদ আছে যে, কালীঘাটের
দেবী মন্দিরে আজও সেই সতী অঙ্গ বিচ্ছিন্ন অঙ্গুলি বর্তমান। কালীর সেবায়েত,
হালদার মহাশয়গণের মধ্যে জ্যৈষ্ঠের বংশসদ্ভূত কোন ভারপ্রাপ্ত
ব্যক্তি প্রতি বছর স্নানযাত্রা, অম্বুবাচীর শেষ দিনে উক্ত
পদাঙ্গুলির বিধিপূর্বক স্নান ও অভিষেক কার্য সমাধা করিয়া থাকেন। বর্তমানকালের এই
পাশ্চাত্য শিক্ষার দিনে, অনেকে একথা অবিশ্বাস করিতে পারেন।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যে তাঁহারা সহস্র বৎসর পূর্ব রক্ষিত , মিশর দেশের ‘মমির’ কথা বিশ্বাস করিতে প্রস্তুত। অবিশ্বাসীদের সম্বন্ধে
আমাদের কোন বক্তব্যই নাই। যাঁহারা বিশ্বাসী হিন্দু তাঁহারা শুনিয়া রাখুন — দেবী
ভাগবতের মতে, সতীর ছিন্ন দেহের অঙ্গ - প্রত্যঙ্গসমূহ ভূমিতে
পতিত হইবা মাত্রই পাষাণত্বপ্রাপ্ত হইয়া ছিল।'
এই জায়গার নাম
কালীঘাট কীভাবে হলো এবং কালীমূর্তির প্রথম কে আবিষ্কার করেন, এ নিয়ে নানান
কিংবদন্তী গল্প প্রচলিত আছে। অবশ্য সেগুলো পরস্পর বিরোধী। তবু এর মধ্যে যেটি
সবচেয়ে প্রচলিত তা থেকে জানা যায়, একবার মহারাজা
কৃষ্ণচন্দ্ৰ নাকি নবাব আলিবর্দি খাঁ - কে নিজের জমিদারির অবস্থা দেখানোর জন্য
নৌকাবিহারে যাত্রা করে কলিকাতা পর্যন্ত নিয়ে এসেছিলেন। এরপর মহারাজা নবাবকে
গঙ্গাতীরে উপনীত হওয়ার পর সবিস্ময়ে দেখিলেন, সেই জঙ্গলের
মধ্যে এক নির্জন মৃৎ - কুঠীরে জনৈক সন্নাসী এক কালীমূর্তির পূজা করছেন।
কৃষ্ণচন্দ্র দেবীমূর্তিকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে ব্রাহ্মণকে নমস্কার করলেন।
ব্রাহ্মণের সাথে কথাবলে তিনি জানতে পারলেন যে এই জায়গাতেই সুদর্শন চক্রদ্বারা
ছিন্ন হয়ে সতীদেহের এক অংশ সেখানে পড়েছে এবং এর ফলে এই জায়গাটা পবিত্র পীঠস্থানে পরিণত হয়েছে। আর এই কালী থেকেই এই জায়গার নাম কালীঘাট
হয়েছে।
অন্য
একটি কিংবদন্তী অনুযায়ী - দশনামী শৈব - সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ভুক্ত জঙ্গলগিরি নামক
এক সন্ন্যাসী শিষ্যসহ গঙ্গাসাগরে যাচ্ছিলেন। তিনি আদি - গঙ্গা তীরে কালীর প্রস্তর
খোদিত মুখ - মণ্ডল পান এবং সেখানে কুটির তৈরি করে পূজা শুরু করেন। কিছুদিন সেখানে
থাকার পর তিনি এক প্রিয় শিষ্যের হাতে সেই কালীমূর্তির সেবার ভার দিয়ে গঙ্গাসাগরে
চলে যান। কিংবদন্তী ছাড়া কোন দেবদেবী মূর্তিরই আবিষ্কার দেখা যায় না।
চৌরঙ্গী সন্ন্যাসী
দ্বারা কালী মূর্তি আবিষ্কারের মূলেও একটি অদ্ভূত কিংবদন্তী জড়িত। সেই আখ্যানটি
এরকম, চৌরঙ্গী সন্ন্যাসী একদিন দেখলেন বনের মধ্যে একটি গাভী এক
জায়গায় দাঁড়িয়ে মাটির ওপর অজস্র দুগ্ধধারা বির্জ্জন করছে। সন্ন্যাসী এই অদ্ভুত
ব্যাপার দেখে কৌতূহলবশত সেই জায়গায় মাটি খুঁড়তে শুরু করেন এবং কিছুক্ষণ পর সেই
মাটির ভেতর থেকে মা কালীর প্রস্তরময় মুখমণ্ডল পান। সেই মুখই এখন কালী মূর্তি রূপে
মন্দিরে বিরাজমান।
নবাবী আমলের অবসানে
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর দেওয়ান খিদিরপুর ভূ - কৈলাস রাজবংশের পূর্বপুরুষ
গোকুলচন্দ্র ঘোষাল কালী বিগ্রহের সর্বপ্রথম চারটি রূপার হাত তৈরি করিয়ে দেন। পরে কালীচরণ মল্লিক
সোনার তৈরি হাত তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন। এচজাড়া চড়কডাঙ্গার রামজয় বন্দ্যোপাধ্যায় সোনার কঙ্কণ , বেলেঘাটার রামনারায়ণ
সরকার সোনার মুকুট, পাইকপাড়ার ইন্দ্রচন্দ্র সিংহবাহাদুর
সোনার জিহ্বা এবং নেপাল রাজ্যের প্রধান সেনাপতি কালী বিগ্রহের মাথার ওপরের সোনার
ছাতাটি তৈরি করে দেন।
সেকালের খ্যাতনামা
সংবাদপত্র ‘সংবাদ কৌমুদী'-র ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৮২২ থেকে আরও জানা যায় — গত ৫
ফেব্রুয়ারি মহারাজা গোপীমোহনবাবু দেব ( শোভাবাজার ) কালীঘাটে শ্রীকালী ঠাকুরাণীর
স্বর্ণের চারি হস্ত ও জড়াও ( জড়োয়া ) গৈছা ৪ ছড়া ও জড়াও বিজটা দুই খান ও
জড়াও বাজু দুই খান ও জড়াও বাউটি চারিগাছ ও স্বর্ণমুণ্ড ও এক রৌপ্য খাঁড়া প্রদান
করিয়াছেন । পূর্বে স্বর্গীয় মহারাজ নবকৃষ্ণ
বাহাদুর স্বর্ণের মুণ্ডমালা ... দিয়েছিলেন । শুধু এই নয় , এছাড়া অন্যান্য অনেক
ব্যক্তিও বিভিন্ন সময়ে কালী মূর্তির বিভিন্ন অলঙ্কার দান করেছেন। ১৮৭৮ সালে একটি
বড় রকমের চুরিতে অবশ্য অনেক অলঙ্কার খোয়া যায় । পরবর্তী সময়েও অনেক অলঙ্কার
চুরি ও মেরামতের নামে অনেক সোনা চুরির ঘটনা ঘটে।
বিভিন্ন দাতারা যেমন
বিগ্রহের নানা অঙ্গ এবং সাজসজ্জা প্রদান করেছেন তেমনি মন্দির স্থপতির ভিন্ন ভিন্ন
অংশও বিভিন্ন দাতারা নির্মাণ করিয়ে দিয়েছেন। মন্দির তৈরির সময়েই পাঞ্জাবী শিখ
হুজুরীমল সিং মন্দির থেকে সোজা আদি গঙ্গার পূর্ব তীরের ঘাট (সাবিত্রী ঘাট) ও
সংলগ্ন মন্দিরটি তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন। প্রথম দুটি ভোগঘর ও তোরণদ্বার - নহবতখানা
করিয়ে দিয়ে ছিলেন ১৮১২ সালে গোরক্ষপুরের টীকা রায়। আন্দুলরাজ কাশীনাথ রায় ১৮৩৫
সালে নাটমন্দির ও বাওয়ালীর উদয় নারায়ণ মন্ডল ১৮৪৩ সালে শ্যাম রায়ের পৃথক
মন্দিরটি নির্মাণ করিয়ে দেন । শ্যাম রায়ের দোলমঞ্চটি ( ১৮৫৮ ) করে দেন সাহানগরের
মদন কোলে । কালীর ভৈরব নকুলেশ্বর শিবের নানা কারুকার্যময় পাথরের মন্দিরটি কালী
মন্দিরের অদূরে নির্মাণ করিয়ে দেন শিখ ব্যবসায়ী তারা সিং ১৮৫৪ সালে । এছাড়া
অনেক ভক্ত পরবর্তীকালে যাত্রীদের থাকার জন্য ঘর , বিশ্রমাগার ইত্যাদি
করিয়ে দিয়েছেন ।
মা কালীর
সেবায়েতগণের মধ্যে প্রথমেই পাওয়া যায় ভুবনেশ্বর চক্রবর্তী কুলব্রহ্মচারীর নাম।
যশোরের রাজা বসন্ত রায় ভুবনেশ্বর চক্রবর্তীর শিষ্য ছিলেন । ভুবনেশ্বরের একমাত্র
মেয়ে ছাড়া আর কোন পুত্র - সন্তান না থাকায় জামাই ভবানীদাস চক্রবর্তী কালীঘাটে
তাঁর কাছে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং বিগ্রহের সেবায়েত নিযুক্ত হয়েছিলেন। তারপর
বংশ পরস্পরায় তাঁর বংশধরেরা সেবায়েতের কাজে বহাল হন । পরবর্তীর কোনো সময়
‘হালদার ’ উপাধি প্রাপ্ত হওয়ায় চক্রবর্তীর স্থলে হালদার পদবী ব্যবহৃত হতে থাকে।
কালী মন্দিরের
পূর্বাংশে একটি ছোট পুকুর আছে । সেটি 'কালীকুন্ড’ হ্রদ নামে খ্যাত।
কিংবদন্তী অনুসারে এই হ্রদের তীরে সতীর প্রস্তরময় ছিন্ন পদাঙ্গুলি পাওয়া গিয়েছিল
এবং এই হ্রদের তীরেই মা কালীর পাষাণ মূর্তি প্রথম পাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে
বিড়লা সংস্থার দ্বারা এই হ্রদটির সংস্কার সাধিত হয় ।
কালীঘাটের উন্নতির
মূলে সাবর্ণ জমিদাররা বহুলাংশে জড়িত। তাঁদের আগে অর্থাৎ ভুবনেশ্বরের সময়, কালীঘাট অতি সামান্য
অবস্থায় ছিল । প্রাচীন গ্রন্থে পাওয়া যায় 'রাজা বসন্ত
রায় কালীর পর্ণ কুটীর ভেঙ্গে একটি মন্দির নির্মাণ করে দেন এবং বর্তমান মন্দিরের
প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় । বর্তমান মন্দির বড়িশার জমিদার সম্ভোষ রায়ের আমলে আরম্ভ হয় ।
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
তথ্য
সূত্র - বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও জনশ্রুতি