বাংলা সঙ্গীতের মধ্য বাঙালির মর্মকথার
প্রকাশ পেয়েছে। তাদের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ, বিরহ-মিলন, হাসি-কান্না, জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ, সংগ্রাম-আন্দোলন-বিদ্রোহ, পূজা-সাধন-ভজন ইত্যাদি
মূর্ত হয়ে উঠেছে বাংলা সঙ্গীতের মধ্যে। শ্যামা-সঙ্গীত বাংলা সঙ্গীতের অন্যতম একটি
শাখা। এটিকে বাংলার মাটির সম্পদ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।।
আঠারো শতকে বাংলা সাহিত্যের সব বিভাগেই
বৈষ্ণব গীতিকবিতা তথা বৈষ্ণব পদাবলীর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। সেই যুগেই শাক্ত
অখ্যান মূলক কাব্যগুলো খনজগীতির প্রভাবের ফলে এদের বিষয়বস্তুর কোন কোন অংশ নিয়ে
যুগোপযোগী কতকগুলো খণ্ড গীতিকবিতা রচিত হয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সেগুলো শাক্ত পদাবলী নামে পরিচিতি লাভ করে। শাক্ত পদাবলীর দুটি ধারা - একটিতে দেবী
চণ্ডী তথা দুর্গা কন্যারূপিনী উমা এবং অপরটিতে মাতৃরূপিনী কালিকা (কালী) তথা
শ্যামাতে পরিণতি লাভ করেছেন। শাক্ত পদাবলীর প্রথম ধারাটি আগমনী ও বিজয়া গান এবং
দ্বিতীয় ধারাটি শ্যামাসংগীত নামে সুপরিচিত। আগমনী ও বিজয়া গান তথা সঙ্গীত হচ্ছে
শিব-দুর্গার পারিবারিক জীবনাশ্রিত। অন্যদিকে শ্যামাসংগীত হচ্ছে দেবী কালিকার
মাতৃরূপের ভজন-পূজন বিষয়ক অধ্যাত্ম সঙ্গীত।
মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩) -এর
সমসাময়িক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ স্বয়ং কালী তথা কালিকার মূর্তি গলে তাঁর পূজা
করতেন। তাঁকে কালী তথা শ্যামা মায়ের পূজার প্রবর্তক মনে করা হয়। সমকালীন বাংলায়
বৈষ্ণব মতের প্রাধান্য থাকায় কালীপূজার তেমন প্রসার ঘটেনি। তবে পরবর্তী কালে
আঠেরো শতকে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র রায় (১৭১০-১৭৮২) কালীপূজাকে জনপ্রিয়
করে তোলেন।
কালী এমন এক দেবী যিনি বাঙালির
চিন্তা-চেতনায়, স্মরণে-মননে নিবিড় ভাবে মিশে রয়েছেন।
মা কালীকে নিয়ে বাংলায় যে বিশেষ উৎসবটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে সেটি হচ্ছে
দীপাবলি উৎসব। অবশ্য, দীপাবলি তথা কার্তিকী অমাবস্যায় মা
কালীর পূজা বিশেষভাবে অনুষ্ঠিত হলেও সারা বছর ধরেই তিনি বাঙালির ঘরে ঘরে পূজিত
হয়ে থাকেন। বাঙালির কাব্য-সাহিত্য-সংগীতাদিতেও মা কালী বিপুল প্রভাব বিস্তার করে
রয়েছেন। বিভিন্ন যুগে মা কালীকে নিয়ে গান অর্থাৎ শ্যামাসংগীত রচনা করেছেন বাঙালি
সাধক কবিরা। আগমনী ও বিজয়ার গানের মতো শ্যামাসংগীতেরও পথিকৃৎ হচ্ছেন সাধক
রামপ্রসাদ সেন (আনুমানিক ১৭২০-১৭৮১)। তাঁকে অনুসরণ করে পরবর্তীতে সাধক কমলাকান্ত
ভট্টাচাৰ্য্য (১৭৭২-১৮২১) এই ধারার গানে যথেষ্ট কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।
রামপ্রসাদ এবং কমলাকান্ত ছাড়াও অনেক সাধক-কবি আঠারো শতকের শেষ দিকে, উনিশ শতকে এমনকি বিশ শতকেও মা কালীকে ঘরের মা ভেবে নিয়ে অসংখ্য
শ্যামাসংগীত রচনা করেন,তাঁদের মধ্যে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র,তাঁর
পুত্রগণ (নরচন্দ্র, শম্ভুচন্দ্র প্রমুখ)
দেওয়ান নন্দকিশোর, তাঁর ভ্রাতা দেওয়ান রঘুনাথ (১৭৫০-১৮৩৬), মহারাজ মহতার চাঁদ, দেওয়ান রামদুলাল
নন্দী, রাম বসু (১৭৮৬-?) মহারাজ নন্দকুমার, মহারাজ রামকৃষ্ণ, দাশরথি (দাণ্ড) রায়
(১৮০৬-১৮৫৭), নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়, রামদুলাল, প্রেমিক মহেন্দ্রনাথ
ভট্টাচার্য (১৮৪৩-?), গোবিন্দ চৌধুরী, রামলাল দাস, রঘুনাথ রায়, কালিদাস চট্টোপাধ্যায়
(কালী মির্জা), অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, মৃজা হোসেন, সাধক ভবা পাগলা, কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়।
বৈষ্ণব পদাবলীর মতো শাক্ত পদাবলী বিশেষ
করে শ্যামাসংগীত বৈকুণ্ঠের গান নয়। তার সাথে ধুলি ও ধরণীর নিবিড় যোগ আছে বলে
আধ্যাত্মিকতা বাদ দিয়েও তার কাব্যরস উপলব্ধি করা যায় যে কাব্যরস বাস্তব জীবনকে
কেন্দ্র করে আবর্তিত। শ্যামাসংগীতের পথিকৃৎ সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের গানগুলো উদার
আমাদের মতো বিশাল, সরল সুরের হাওয়ায় মনের সমস্ত
জ্বালা-যন্ত্রণা, বিক্ষোভ-বিদ্বেষ দূর করে দেয়।
রামপ্রসাদের শ্যামাসংগীতের কিছু অমর পঙক্তি আজও প্রবাদ-প্রবচনের মতো মানুষের মুখে
মুখে উচ্চারিত হয়। যেমন-
মন রে কৃষিকাজ জান না
এখন মানব জমিন রইলো পতিত,
আবাদ করলে ফলতো সোনা।”
বিষা- মা আমায় ঘুরাবে কত,
কলুর চোখ ঢাকা বলদের মত? ইত্যাদি।
দেবী কালিকা তথা কালীর স্বরূপ এবং কবির
নিজস্ব ধ্যান-ধারণা-সংক্রান্ত সাধক কবি কমলাকান্তের কিছু শ্যামাসংগীত রামপ্রসাদের
চেয়ে কোন অংশে কম নয়। যেমন-
“সদানন্দময়ী কালী মহাকালের মনোমোহিনী গো
মা,
তুমি আপন সুখে আপনি নাচ আপনি দাও মা
করতালি।।”
কিংশ- “ মজিল মন ভ্রমরা কালীপদ নীলকমলে।
যত বিষয়মধু তুচ্ছ হৈল কালাদি কুসুম
সকলে।।” ইত্যাদি।
এখানে কয়েকজন পদ নির্মাতার শাক্ত পদাবলী
তথা শ্যামাসংগীতের অংশবিশেষ প্রদত্ত
হলো-
(১) “মনেরি বাসনা শ্যামা, শবাসনা শোন মা বলি।
অন্তিমকালে জিহ্বা যেন বলতে পায় মা কালী
কালী।।"
দাশরথি রায় (দাশু রায়)
(২) “নৃত্য কর প্রেমে যেতে, সদর কালী বলে।।”- প্রেমিক মহেন্দ্রনাথ
ভট্টাচার্য
(৩) “তারা, কোন অপরাধে, এ দীর্ঘ মেয়াদে, সংসারে-গারদে থাকি বল?
মসিল হয়, তসিল করে কত, দারা-সূত পায়ের
শৃঙ্খল।।"- নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়
(৪) শ্মশান ভালবাসি বলে
শ্মশান করেছি হৃদি
বন-বাসিনী শ্যামা নাচবি বলে নিরবধি।” - রামলাল দাসদত্ত
(৫) “এ কি রূপ নয়নে কবি নিরীক্ষা-
কে পারে স্বরূপ রূপ করিতে বর্ণন।'- মহারাজ মহতাব চাঁদ
(৬) ভজন-পূজন জানি না মা
জেতেতে ফিরিঙ্গি।
যদি দয়া কোরে তর মোরে এ ভাবে মাতঙ্গী।।” - অ্যান্টন ফিরিঙ্গি
(৭) কালো মেয়ের পায়ের
তলায়
দেখে যা আলোর নাচন।'- কাজী নজরুল ইসলাম
পরিশেষে বলা যায় -শাক্ত পদাবলী তথা
শ্যামাসংগীত বৈষ্ণব পদাবলীর মতো অবগুণে ততটা অলঙ্কৃত না হলেও বিশেষ করে আঠারো
শতকের বাঙালির নৈতিক অধঃপতনের দিনে এর ভাব, ভাষা ও ভক্তি শুভ
আদর্শ বলে বিবেচিত হয়েছিল। সমকালীন হতাশ বাঙালির প্রাণে এই গানগুলো দুঃখের
সান্ত্বনা স্বরূপ, মৃত্যুর মধ্যেও অমৃতের স্বাদ বহনকারী
হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল। বৈষ্ণব পদের মতো শ্যামা-সঙ্গীতে সূক্ষ্ম রূপ নাও থাকতে
পারে, কিন্তু আছে আতপ্ত জীবনের স্পর্শ। আর এই
জীবনের স্পর্শের মাঝেই বাঙালি সাধক কবিরা বিশ্ব-ব্রক্ষ্মান্ডের অধীশ্বরীকে ঘরের মা
অর্থাৎ নিজের মা-তে পরিণত করেছিলেন।
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
লেখক পরিচিতি –
ড.বাসুদেব রায়ের জন্ম ১৯৬২ সালে। কবিতার
মাধ্যমে সাহিত্যের জগতে আত্মপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশিত বই মানব' (কাব্যগ্রন্থ), দ্বিতীয় বই রক্তের বাঁধন (উপন্যাস)। সাহিত্যের
বিভিন্ন শাখায় পদচারণা করলেও প্রবন্ধ সাহিত্যের দিকে তার ঝোঁক বেশি। তদুপরি
গবেষণামূলক প্রবন্ধ তথা বই লিখতে তিনি অধিকতর উৎসাহী। গবেষণামূলক বইয়ের পাশাপাশি
সাধু-মহাপুরুষদের জীবনী-গ্রন্থ, একাঙ্কিকা ইত্যাদি
সম্পাদনাও করেছেন তিনি।
ড.বাসুদেব রায়ের বেশ কয়েকটি বই
প্রকাশিত হয়েছে। হার উল্লেখযোগ্য গবেষণা গুলোর মধ্যে রয়েছে মনসামঙ্গল কাব্যে
দেবদেবীর স্বরূপ', চণ্ডীমঙ্গল ও অন্নদামঙ্গল কাব্যে
দেবদেবীর স্বরূপ, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে সমাজ-চিত্র
ইত্যাদি। তাঁর যৌথ রচনা ও উপেক্ষণীয় নয়।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বাসুদেব রায়
নিরলস ভাবে লিখে চলেছেন। এছাড়াও নতুন করে
তিনি একক ও যৌথভাবে বেশ কয়েকটি
গবেষণামূলক কাজে হাত দিয়েছেন।