প্রত্যেক জনগোষ্ঠী ও দেশের
সভ্যতা গড়ে ওঠে অনেক শতাব্দী ধরে এবং তাতে ইতিবাচক তত্ত্বের সাথে নেতিবাচকও কিছু
থাকে। ইতিহাস এই বিবরণ ও ধারাবাহিকতা বহন করে।
যেহেতু সাহিত্য সভ্যতার
বর্ণনা, তার বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন এবং উত্থান পতনের বিশ্লেষণ, সেই জন্য
সাহিত্য ও ইতিহাস রচনার এক গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক। অতএব অনুসিদ্ধান্তে বলা যায়
সাহিত্য পর্যালোচনাতেও ইতিহাস চেতনা আবশ্যক। ভাষার ব্যাপারে এর উপর স্পষ্ট উক্তি
রয়েছে শ্রী সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের "বাংলা ভাষার কুলজী" -তে:
আর্যামি নামের গোঁড়ামিতে। তাঁর মতে এটা স্বাধীন চিন্তার শত্রু, একে নিপাত
না করে যথাযথ ভাবে ভাষার চর্চা করা যাবে না। ইতিহাসের আলোচনা করা সম্ভব (পুরোকাইৎ
২০১৯)। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য।
বাংলা ভাষার উপর বিস্তারিত
আলোচনার প্রাসঙ্গিকতাতে দেখা গেছে যে ভারতে মানব বিবর্তনের বর্ণনাতে রয়েছে তিনটি
বহু প্রচারিত তত্ত্ব ১) ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাগোষ্ঠী থেকে প্রাচীন ভারতের ভাষার
উৎপত্তি বা ভারতীয় ভাষা এই ভাষাগোষ্ঠী দ্বারা প্রভাবিত, ২)
সংস্কৃত ভাষা আর্যরা নিয়ে এসেছে এবং ৩) আর্য আক্রমণ ও বিজয় তত্ত্ব। এই তিনটির
কোনটাকেই তথ্য সমর্থনে প্রমাণ করা যায়নি। অথচ এগুলিকেই সত্য বলে মেনে নেওয়ার দরুন
পর্যালোচনাতে কিছু তথ্য বাদ পড়েছে কিছু বিকৃত হয়েছে (অতুল সুর ১৯৮৮, দাস
২০২০)। এই তিন তত্ত্বকে ছেড়ে দিয়ে দেখা গেল বাংলার কথ্যভাষা লিখিত ভাষার রূপ
নিয়েছে ১৪০০ বছর অতীতে গুপ্তযুগের অবসানের পর বাংলার প্রথম স্বাধীন রাজা শশাঙ্কর
শাসন কালের প্রথম দশকে (মৈত্র, ১৯৮৩)।
বাংলা সাহিত্যের আরম্ভও তখন। কিন্তু সাহিত্য সমাজের কথা বলে, তাই
কবিদের এবং গল্প, উপন্যাস প্রবন্ধ লেখকদের
রচনাতে সমকালীন সমাজ ও রাজনীতি উঠে আসে স্বাভাবিক ভাবেই। ঐতিহাসিক ভারতে ও বাঙলাতে
বাইরের থেকে মনুষ্যগোষ্ঠী এসেছে, মাঝে মাঝে, যেমন
শুরুর দিকে অ্যাস্ট্র-এশিয়াটিক ও আর্য, বুদ্ধদেবের
আবির্ভাবের পরে গ্রীক-শক- হুণ-কুষাণ, মধ্যযুগে
তুর্কী-ইরানী-আফগান-মুঘল এবং আধুনিক কালে পর্তুগিজ, ফরাসী, ডাচ, আর্মেনিয়ান, ইংরেজ।
শাসনে, সমাজে, ধর্মে নতুনের অন্তর্ভুক্তি
করণের মধ্য দিয়ে পুরাতনের সাথে একত্রীকরণ ঘটেছে, যেমন
সিন্ধু-সরস্বতী ও আর্য সম্প্রদায়ের যৌথ প্রয়াসে ঘটেছিল বৈদিক যুগের শুরুতে বিশেষ
করে ঋকবেদে উপলব্ধ প্রজ্ঞার রচনা, সংকলন ও
সংরক্ষণ। কি ছিল সেই প্রক্রিয়া? সেটা ছিল
ইতিবাচক, সবাইকে দলে নিয়ে নেওয়া, শত্রুতা ও
ভেদাভেদ মিটিয়ে দেওয়া আপাত ভিন্ন দুই সম্প্রদায়ের সংমিশ্রণ ও সংশ্লেষণের মধ্য
দিয়ে। তথাপি উপরতলার মানুষরা চেষ্টা করেছে এবং চেষ্টা করেছে হিন্দুদেরকে
আভ্যন্তরীণ বিভাজনে বহু ভাগে পৃথক করে রাখতে। জন্মগত জাতিপ্রথা ও গোত্র ছিল ও আছে
শক্ত অস্ত্র হয়ে। তারা ভেঙ্গেছে বেদের নির্দেশ যে মানুষ এক জাতের এবং দুই
পরিচিতির- পুরুষ ও নারী। মানুষ জাতির মূল গোত্র হল মানবিকতা বা বৃহত্তর জনসংখ্যার
কল্যাণ, সামাজিক স্তরে উপগোত্র হল গোষ্ঠী (race) ও উপ-উপ
পরিচিতি হল পরিবার (family)। সব স্তরেই
পৃথকতা ও অসমতা গৃহীত ছিল কিন্তু জন্মগত নয়। যুগে যুগে ব্যতিক্রমী মানুষ যেমন
বুদ্ধ, চণ্ডীদাস, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ
নিজেদের জীবনে তুলে করেছেন অসমকে সাথে নিয়ে চলতে দয়াতে নয় দায়িত্বের দাবিতে, কিন্তু
মহানতা কৃত হয়নি কেননা অধিকাংশ শিষ্ট সমাজের মানুষদের, জন্মগত
জাতি প্রথা হতে উদ্ভূত ভেদাভেদ ও তার সাথে অসঙ্গত বিচার ও ব্যবহার, থেকে বিরত
করতে। এই সব ঘটনা অঘটনের প্রভাব বাংলা ভাষার উপর পড়েছে এবং সাহিত্যেও নানান ভাবে
প্রতিফলিত হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা- "সকলই নিয়মের ফল সাহিত্যেও নিয়মের ফল।
বিশেষ বিশেষ কারণ হইতে, বিশেষ বিশেষ নিয়মানুসারে
বিশেষ বিশেষ ফলোৎপত্তি হয়। সাহিত্য দেশের অবস্থা এবং জাতীয় চরিত্রের প্রতিবিম্ব
মাত্র (শুভদীপ সরকার ২০২০)।
অনেক আলোচকদের লেখা থেকে উঠে
এসেছে যেকোনও কালেই রাজনৈতিক সঞ্চরণ শুরু জো-সম্রাট-জমিদারের এবং ধর্মগুরু ও
সংস্থার কর্মসূচীতে সীমাবদ্ধ ছিল না,সমাজের
অন্য মানুষগুলির কথাবার্তাতে আশঙ্কা আশা বেরিয়ে আসতো, যা
বিচক্ষণ শাসক ও অন্য কর্মকর্তারা নিয়মিতভাবে সংগ্রহ করতেন এবং তার ভিত্তিতে
সিদ্ধান্ত নিতেন, সংশোধন করতেন। শুরুর
সাহিত্যিক কবিগণও রচনাতে তুলে ধরেছেন সমাজের ব্যভিচার ধর্মীয় সংলাপের উন্মত্তাতে
বা ব্যঙ্গাত্মক রচনাতে বা সহজ নির্ভীক দৃঢ় প্রত্যয়ের বক্তব্যতে। তাতে অনেক
মূল্যবান তথ্য রয়েছে। স্বাভাবিক ভাবে যুগোপযোগী পরিবর্তন হয়েছে এবং আজকের মেধা ও
শালীনতাতে পুষ্ট, শিষ্ট সাহিত্যতে এই বিশেষ
ধরণের আদি রচনারও অবদান আছে। এই রকম প্রতিক্রিয়াশীল রচনায় বিভিন্ন কালের বাংলা
সাহিত্য সমৃদ্ধ। তথাপি চিন্তাবিদগণ এবং সাহিত্যিকরা এদিকে আলোকপাত করেননি কারণ
অধিকাংশই শির সমাজগুলির অংশ তাদের বিরাগভাজন হতে চাননি। সেই কারণেই এই আলেখ্যে
নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সাহিত্যের বিবরণে রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় ও
সামাজিক ধুসর দিকটার তাৎপর্য তুলে ধরার প্রয়োজন আছে। তাছাড়া তাদের অনেকটা এত বছর
পরেও এত পরিবর্তন সত্যেও বর্তমান কালের জনজীবনে প্রাসঙ্গিক। এইসব সমীক্ষণের
ভিত্তিতে মনে হয় সময় এসেছে এক ঐতিহাসিক আলেখ্য শাসক ও শাসনের রদবদলের কয়েকটা সময়
পরিসরে ভাগ করে বাংলা সাহিত্যের ধারাবাহিকতায় ক্রমিক বিকাশ বা বিস্তার তথ্য
সমর্থনে আলোচনা করার।
তথ্য সূত্র:
১) অতুল সুর: ভারতের
নৃতাত্ত্বিক পরিচয়। প্রবন্ধ-ভারতের আবায়বিক নৃতত্ত্ব, ভাষার
যাদুঘর, গ্রামীণ সমাজ ও জীবন-চর্যা
এবং প্রাগৈতিহাসিক প্রেক্ষাপট সাহিত্যালোক, কলকাতা, ১৯৮৮
২) উত্তম পুরোকাইত।
তারাশঙ্করের অরণ্য বহি শালপাতার আগুন। আজকের এযা, বইমেলা
সংখ্যা, কলকাতা,২০১৯ পৃঃ
১২-১১৫।
৩) বি.এস.মৈত্র: অক্ষয় কুমার
মৈত্র: গৌড়ের কথা, ১৯৮৩।
৪) শুভদীপ সরকার। মধ্যযুগের
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মনসামঙ্গল কাব্য। আজকের এযা, যাখ্যাসিক, বইমেলা
সংখ্যা, কলকাতা, ২০২০, পৃঃ
১৩৫-১৩৮।
৫) D.C. Das
Man's Tryst with Destiny in World and India-Part-A: Food to Religion. BUUKS
Publishing. Chennai, 2020.
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক পরিচিতি –
স্কুল-কলেজ পেরিয়ে উচ্চশিক্ষা পান আই টি খরগপুর, নেডারল্যান্ডস্ ও জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ইউ এস এ -তে । কর্মক্ষেত্র উত্তর প্রদেশ-এর তরাই অঞ্চলের গ্রাম, ভারত সরকার-এর অধীনে অরুণাচল-এ, (শিলং-এ থেকে), উটি (তামিলনাড়ু), দেরাদুন-এ (উত্তরাখণ্ড) , কৃষি এবং পরিবেশ মন্ত্রালয়, দিল্লি-তে।
দিল্লির ৩৪ পল্লীর কালীবাড়ির সাথে যুক্ত আছেন বিগত ৩০ বছর ধরে। ১৯৪৮ সাল থেকেই লেখেন কিন্তু প্রথম প্রকাশন ২০১৫-তে। কবিতা , গল্প, ভ্রমণ কাহিনী ও প্রবন্ধ ছাপতে থাকে দিল্লির পত্র-পত্রিকাগুলোতে। কলকাতা এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রথম বই ' অনুভূতি বহুরূপে'। অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে দিল্লিথেকে প্রকাশিত ম্যাগাজিন ' কলমের সাথ রঙ' পত্রিকার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত এবং উচ্চপদে আছেন।