আজ অনেক দিন হয়ে গেছে ভোলার কাজ নেই। গ্রামে সেরকম কোন কাজ নেই যে ভোলা করবে। তাই সে ঠিক করল শহরে গিয়ে কোন কাজ করবে। কারণ চড়ক পাড়া গ্রামের অনেকেই কাজের জন্য শহরে চলে গেছে। তাই এবার হাতে কিছু টাকা নিয়ে সে কিশোরগঞ্জ চলে গেল।
কিশোরগঞ্জে এসে দুই দিন নানা জায়গায় কাজের জন্য ঘোরাঘুরি করেও সে কোন কাজ পায়নি। শহরের এই জায়গাটা ওর জন্য নতুন, কেউ তাকে চেনে না জানেনা। কয়েকজনের কাছে গিয়ে কাজের কথা বললেও, কেউ কোন কাজ দেয়নি। এরই মধ্যে হাতের টাকা অর্ধেক শেষ হয়ে গেছে। কাজ না পেলে গ্রামে গিয়েই বা কি করবে, এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে রাস্তার পাশ ধরে হাটতে হাটতে একটা পোস্ট অফিসের কাছে গিয়ে পৌঁছল। তারই খানিকটা দূরে একটা চায়ের দোকান দেখে এগিয়ে গেল, দেখল একজন বয়স্ক লোক বসে আছে। ভোলা দোকানের বেঞ্চটাতে বসতে বসতে ওনাকে বলল আমাকে একটা চা দিন। দোকানদার ভোলাকে চা দিলে, ভোলা ধীরে ধীরে চা খেতে লাগল এবং দেখল দু’একজন করে লোক পোস্ট অফিসে আসা যাওয়া করছে এবং তাদেরই মধ্যে কেউ কেউ দোকানে চা খেতে আসছে আবার কেউ চা বানিয়ে নিয়েও ভীতরে যাচ্ছে। চা খাওয়ার পরও কতক্ষণ যে ভোলা এসব দেখল ঠিক বুঝতেই পারেনি। এক সময় সে নিজের থাকার জায়গায় ফিরে গেল ।
পরের দিন আবার কোথাও কাজ না পেয়ে সে চায়ের
দোকানে এলো এবং একটা চা দিতে বলল। দোকানদার চা দিয়ে বলল, কালকেও
তোমাকে এখানে দেখেছি, অনেক অপেক্ষাও করছিলে, তোমার
কি পোস্ট অফিসে কোন কাজ আছে? এমনি জিজ্ঞেস করলাম, আজ
আবার এসেছ! ভোলা বলল যে, না আমি এই শহরে কাজের খোঁজে এসেছি, কয়েক
দিন হয়ে গেল কিন্তু এখনও কোন কাজ পাইনি, তাই এদিক
ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছি কিন্তু কেউ কোন কাজ দিচ্ছে না। দোকানদার বলল এখনে তোমার কি কেউ
পরিচিত লোক আছে? থাকলে কাজ পেতে তোমার সুবিধা হতো।
ভোলা বলল, না। কিশোরগঞ্জ এই তার প্রথম আসা। দোকানদার বলল
কাজ তো অনেক আছে তবে কেউ যদি তোমাকে
বিশ্বাস করে কাজ দিলে দিতেই পারে, চেষ্টা
চালিয়ে যাও। ভোলা দোকানদার কে চায়ের দাম দিয়ে চলে গেল।
পরের দিন ভোলা আবার এদিক সেদিক ঘুরে আগের দিনের
চাইতে আরও কিছুটা আগেই চায়ের দোকানে পৌঁছে দেখল বেশ কয়েকজন লোক চায়ের জন্য অপেক্ষা
করছে আর দোকানদার জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে কোনভাবে চা বানাচ্ছে। ওদের চা দেওয়া হয়ে
গেলে দোকানদার বেঞ্চে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ভোলা কাছে গিয়ে গায়ে হাত দিয়ে দেখল, দোকানদারের
গায়ে ভীষণ জ্বর, জ্বরে সে কাঁপছে। ভোলা দোকানদারকে
বলল কাকু আপনার তো শরীর খারাপ! আমি কি আপনাকে বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে আসব? দোকানদার
বলল,
এখানে আশে-পাশে আর কোন চায়ের দোকান নেই, এই
লোকগুলো কোথায় যাবে চা খেতে যদি আমি এখন দোকান বন্ধ করে দিই। কিন্তু এত জ্বরে আপনি
কি করে চা বানাবেন। উনি বললেন দুপুর শেষে বাড়ি যাব। ভোলা দোকানদারের পাসে বসে
রইল,
সেই সময় দুই তিনজন দোকানের দিকে এগিয়ে এলো এবং দোকানদারকে
শুতে দেখে জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার আজ কি চা পাব না, কি
হল তোমার?
- ওনার শরীরটা খারাপ,খুব
জ্বর। লোকগুলো ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নিতেই ভোলা দোকানদার কে বলল, কাকু
আপনি যদি বলেন তাহলে আমি আজ ওনাদের চা বানিয়ে দিই! দোকানদার বলল তুমি চা বানাতে
পার?
ভোলা বলল হ্যাঁ পারি। দোকানদার বলল ঠিক আছে তাহলে দাও। ভোলা
লোকদের বলল,আপনারা একটু দাঁড়ান,আমি
এক্ষণই চা বানিয়ে দিচ্ছি। ভোলা চা বানিয়ে দিলে সবাই চা খেয়ে বলল বেশ ভালো চা
বানিয়েছ। তারা চায়ের দাম দিয়ে যে যার মত চলে গেল। এর পর অনেক ক্ষণ ভোলা যত গ্রাহক
এলো,
তাদের চা বানিয়ে খাইয়েছে এবং তারা সবাই তার চায়ের প্রশংসা
করলো। বেলা বাড়তেই গ্রাহক না থাকায় ভোলা দোকান বন্ধ করে দোকানদারকে বাড়িতে পৌঁছে
দিতে গেলে বাড়ির গিন্নি ভোলাকে দেখে বলল, এই
ছেলেটিকে আগে কক্ষনো দেখিনি তো?
দোকানদার
তখন তার স্ত্রীকে বলল, আমার শরীরটা খারাপ হয়ে গেছে, ওকে
আজকে এখানে থাকতে বল আর খাওয়া দাওয়া ব্যবস্থা কর। কাকুর কথা অনুযায়ী ভোলা ওই
বাড়িতে থেকে গেল ।
পরের দিন সকালে দোকানদার কাকু নিজেকে সুস্থ মনে
করলেন এবং ভোলাকে ডেকে বললেন বস, ভোলা বসতেই কাকু জিজ্ঞেস
করলেন তুই রান্না করতে পারিস? কারণ চা তো ভালো বানালি।
ভোলা বললে হ্যাঁ, রান্নাও পারি। কাকু বললেন আমার
অনেক দিনের ইচ্ছা একটা হোটেল করার, তুই বললে
আমি চায়ের দোকানে একটা ভাতের হোটেলও শুরু করব। ভোলা আপত্তি না জানিয়ে বলল ঠিক আছে।
কাকু বললেন,থাকা খাওয়া আমার বাড়িতে আর মাস গেলে কিছু
মাইনেও দেব। ভোলা রাজি হয়ে গেল আর কয়েকদিনের মধ্যে চায়ের সঙ্গে দুজনে মিলে একটা
ভাতের হোটেল খুলল। লোকেরা সেখানে খাওয়া দাওয়া করে রান্নার প্রশংসা করতে লাগলো।
ভোলা গ্রামের বাড়িতে ফোন করে জানাল সে একটা কাজ পেয়ে গেছে। একদিন দোকানদার কাকু
কথায় কথায় ভোলাকে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ রে ভোলা, তোর
রান্না তো সকলের খুব ভালো লাগে, তুই এত সুন্দর রান্না কোথায়
শিখলি বলতো? ভোলা হেঁসে বলল, কাকু
মায়ের কাছে শিখেছি, আমার মা খুব ভালো রান্না করে ।
কয়েক মাসের মধ্যে হোটেলটার খুব নাম ডাক হয়ে
গেল। সেই সঙ্গে ভোলার মাইনেও বাড়ল। এই ভাবে বছর দুয়েক কেটে গেল। ওই হোটেলে দুটো
ছেলে প্রায়ই খেতে আসত। এক দিন তারা খাওয়ার পর ভোলাকে বলল, তুই
তো খুব ভালো রান্না করতে পারিস, তুই রান্নার প্রতিযোগিতায়
অংশ নে। ভোলা না বুঝতে পেরে বলল ওটা আবার কি? ছেলেরা
বলল,নতুন
দিল্লিতে একটা খুব বড় রান্না প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে । আয়োজন করছে মাস্টার
সেফ রাজীব কাপুর। তুই ওখানে গিয়ে রান্না কর। ভোলা বলল, আমি
কি আর ওসব পারব! কেন পারবি না, ওখানে দেশের বিভিন্ন জায়গা
থেকে প্রতিযোগীরা আসবে আর নিজেরা রান্না করবে ।
বিভিন্ন
জায়গা থেকে? ভোলার প্রশ্ন
ছেলেরা
বলল,
হ্যাঁ তাই ।
আমি কি
ওদের সঙ্গে পারব! ভোলা বলল। ছেলেরা বলল, পারবি
পারবি ।
না না আমি
পারব না,
ভোলা জবাব দেয় ।
ছেলেরা
বলল,
আগেই না করিস না, জানিস, যে
ওই প্রতিযোগিতা জিতবে তাকে কি পুরস্কার দেওয়া হবে ?
ভোলা
উৎসুক হয়ে বলল কি ?
তারা বলল, ৫০
লক্ষ্য টাকা ।
কি? ভোলার
দোকানদার কাকু শুনে বলল,আগেই না করিস না, ভেবে
দেখ,
অনেক টাকা।
কিন্তু
আমি ওখানে যাব কি করে, আমি তো কিছুই জানিনা। ভোলা বলতেই
ছেলেরা বলল আমরা সব ব্যবস্থা করে দেব। এই মোবাইল এ তোর ফটো, নাম
ঠিকানা এবং তোর রান্না করা কয়েকটা ডিশের ফটো, তার
রেসিপি পাঠাবো, ওনাদের ভালো লাগলে, তখন
ওনারা তোকে ডেকে পাঠাবে। কাকু, কাকিমাও বলল একবার চেষ্টা
করে দেখ । ওনাদের কথা অনুযায়ী ওই ছেলে দুজনে ভোলার নাম পাঠাল বিবরণ সহ ।
কয়েক দিন পর দিল্লি থেকে খবর এলো ভোলার ডাক
এসেছে,
ওকে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্য। তারপর ভোলা বাড়িতে
ফোন করে বাবা,মাকে জানিয়ে দিল্লি পাড়ি দিল ।
এরপর ওখানে সব বয়সী মহিলা পুরুষ, ছেলে
মেয়েদের সঙ্গে ভোলাও রান্না প্রতিযোগিতায় অংশ নিলো। ভোলার রান্না সবার বেশ পছন্দ
হওয়ায় সব কটা ধাপ পেরিয়ে এবার ভোলা ফাইনাল রাউন্ডে পৌঁছে গেল। সেখানে ভোলার সঙ্গে
আরও তিন জন প্রতিযোগী পৌঁছে গেল। এবার এই চার জনের মধ্যে রান্না প্রতিযোগিতা হবে
এবং এই প্রতিযোগিতা টেলিভিশনে দেখান হবে। এখানে আসার প্রায় এক মাস হয়ে গেছে, ভোলা
এবার কিশোরগঞ্জ-এর দোকানদার কাকু আর বাড়িতে ফোন করে জানালো ওর ওই প্রতিযোগিতা
টেলিভিশনেও দেখানো হবে বলে জানালো,তাই
সবাইকে দেখতে বলল। এসব শুনে সকলেরই খুব আনন্দ। ফাইনালের দিন, ভোলার
বাড়িতে আর কিশোরগঞ্জের আত্মীয় পরিজন ও চেনা পরিচিত সবাই টেলিভিশনের সামনে বসে
প্রতিযোগিতা দেখতে বসল ।
আজ তিন জন বিখ্যাত সেফ বিচারকের স্থানে বসেছেন, রাজীব কাপুর, বিমলা দেবী এবং প্রকাশ
খান্না। ভোলাসহ চারজন প্রতিযোগী বিশাল রান্না ঘরে প্রবেশ করলো। খেলার নিয়ম অনুযায়ী
ওদের বলা হল, রান্না ঘরে প্রচুর রান্না সামগ্রী রাখা হয়েছে, ওখান
থেকে ৩০ সেকেন্ড সময়ের মধ্যে যা যা সামগ্রী পারবে তুলে নিয়ে ৩০ মিনিটের মধ্যে একটা
ডিশ রান্না করে দিতে হবে। তার পর ওদের ওই রান্না করা ডিশটি তিন বিচারপতি বিচার করে
দেখবেন এবং যার রান্না সকলের কাছে সব চাইতে ভালো লাগবে তাকেই বিজেতা ঘোষণা করা হবে
।
ভোলা ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে চাল, ঘি, নুন
ও কিছু তরকারি তুলতে পারল। এরপর সেগুলো নিয়ে কি রান্না করবে ভাবতে ভাবতে রান্না
শুরু করলো। সে ওই সব কিছু দিয়ে কি যেন একটা বানাল এবং সময় অনুসারে রান্না করা
ডিশটি নিয়ে বিচারকদের সামনে রাখল। বাকি তিন জনও তাদের মত রান্না করে ডিশ নিয়ে
বিচারকের সামনে রাখল। এবার বিচারকদের টেস্ট করার পালা, ওনারা
তিন জন এক এক করে সবার রান্না টেস্ট করলেন। শেষে ওনারা ভোলাকে কাছে ডাকলেন এবং
জিজ্ঞেস করলেন এটা কি রান্না করেছ? এই ডিশটির
নাম কি?
ভোলা একটু সংকোচিত হয়ে বলল, আজ্ঞে এটা
ভেজ পোলোও। ভেজ পোলাও ভীষণ টেস্টি হয়েছে, এই ডিশটি
সকলের মন জয় করেছে। বিমলা দেবী বললেন ঠিক আছে তুমি যাও আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা
বিজেতার নাম ঘোষণা করব । তখন সবাই মনে মনে নানা জল্পনা করতে লাগলেন।
অবশেষে ভোলার
নাম ঘোষণা করা হল প্রতিযোগিতার প্রথম স্থানাধিকারি হিসাবে। ভোলাকে কাছে ডেকে সকলে
তাকে শুভেচ্ছা জানাল এবং ৫০ লক্ষ টাকার চেক তার হাতে তুলে দিল। ভোলা আনন্দে ভেসে
গেল,সবাইকে
ধন্যবাদ জানাল। এদিকে টেলিভিশন এর সামনে বসা চড়ক পাড়া ও কিশোরগঞ্জের মানুষেরা
আনন্দে নাচতে লাগলো। ভোলার বাবা বললেন, আজ থেকে
ভোলা আর ভোলা রইল না ও “নতুন ভোলা” হয়ে গেল।
____________________________________________________
লেখিকার পরিচিতি –
জন্ম বিহারের কিশানগঞ্জ। প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর কিষান গঞ্জেই ।আঞ্চলিক বার্ষিক পত্রিকা, উত্তরবঙ্গ সংবাদে অণুগল্প,ছোট গল্প লেখেন। সঙ্গীত, বই পড়া, ভ্রমণ ও আধ্যাত্মিকতায় রুচিশীল এবং কুসংস্কার বিরোধী ।