মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ
বাঙলা বিহার ওড়িশার শেষ স্বাধীন রাজধানী এই
মুর্শিদাবাদ। ৫৪ বছরের নবাবীয়ানার সাক্ষ্য ও ঐতিহ্য বহন বহন করে চলা এই
মুর্শিদাবাদের প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে রয়েছে সেই অতীত দিনের ইতিহাসের গন্ধ।
মুর্শিদাবাদের প্রধান দ্রষ্টব্য হাজার দুয়ারী। ১৮৩৭
সালে ব্রিটিশ স্থপতি স্যার ডানকান ম্যাকলয়েডের নকশায় এই, নগদ সাড়ে ষোল
লক্ষ টাকা ব্যয়ে এই সুরম্য প্রাসাদটি গড়ে তোলেন নবাব নাজিম হুমায়ূন জা। গথিক
শিল্পশৈলীতে গড়া প্রাসাদটির ১০০০ টি দরজা
থাকার জন্য এর নাম হয়েছে হাজার দুয়ারী। তবে এই হাজারটি দরজার মধ্যে ৯০০ টি দরজাই
নকল। আসল দরজা কিন্তু ১০০ টি । প্রাসাদের অভ্যন্তরে রয়েছে মিউজিয়াম। এখানে
রয়েছে নবাব , আমির ওমরাহদের ব্যবহৃত পালঙ্ক, তৈজসপত্র, পোশাক, তৈজসপত্র
প্রভৃতি। এখানকার আর্ট গ্যালারিতে রয়েছে মার্শাল, টিটো
প্রমুখ বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা অসাধারণ সব ছবি। হাজার দুয়ারী প্যালেস মিউজিয়ামের
অন্যতম সেরা আকর্ষণ এখানকার অস্ত্রাগারটি। সেই সময় ব্যবহৃত ২৯০০০ - এরও বেশি
অস্ত্রশস্ত্র এখানে প্রদর্শিত হয়েছে।
১৩০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৬১ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট এই
প্যালেসটির ২৪ মিটার উঁচু পঙ্খের কাজ করা গম্বুজটিও আকর্ষণীয়। হাজার দুয়ারী প্রাসাদের
বিপরীত দিকেই রয়েছে ইমামবাড়া। পূর্ব ভারতের সর্ববৃহৎ এই ইমামবাড়াটি ১৮৪৭ সালে
নগদ ৬ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেন নবাব নাজিম ফেরাদুন জা । হাজার দুয়ারীর
প্রাঙ্গণেই রয়েছে সিরাজের তৈরি মদিনা, ঘণ্টা মিনার এবং বাচ্চেওয়ালী তোপ ।
সুবিশাল এই কামানটি ১৬৪৭ সালে ঢাকার বিশিষ্ট লৌহ শিল্পী জনার্দন কর্মকার তৈরি করেন
। কামানটির ওজন ৭৭০০ কেজি, দৈর্ঘ্য ১৮ ফুট। এটি একবার দাগতে
বারুদ লাগত ১৮ সের । কাছেই জাফরাগঞ্জ মকবরায় রয়েছে নবাব মীরজাফর সহ তাঁর
পরিবারের সদস্যদের মোট ১১০০ সমাধি। ২ কিমি দূরে মহিমাপুরে রয়েছে আজিমুন্নেসা
বেগমের সমাধি । সামান্য দূরত্বে নসীপুরে দেবী সিং - এর রাজবাড়ি। এখানেও আছে
মিউজিয়াম। আছে ফাঁসিঘর, নাটমঞ্চ, নবগ্রহের
মন্দির প্রভৃতি।
মুর্শিদাবাদের পরবর্তী আকর্ষণ কাঠগোলা বাগান। ধনকুবের
লক্ষ্মীপত সিং দুগ্গর এই বাগান ও প্রাসাদ , মন্দির নির্মাণ করেন। কাজেই জগৎ
শেঠের বাড়ি ও মিউজিয়াম।
মুর্শিদাবাদের অন্যতম সেরা দ্রষ্টব্য কাটরা মসজিদ। এখানে
রয়েছে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ - র সমাধি । এর কাছেই তোপখানায় রয়েছে জাহানকোষা
কামান। একই সঙ্গে দেখে নেওয়া যায় মতিঝিল
, আখড়া প্রভৃতিও।
ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে রয়েছে খোশবাগ। এখানেই চির
নিদ্রায় শায়িত রয়েছেন নবাব আলীবর্দি খাঁ,বাঙলা বিহার ওড়িশার শেষ স্বাধীন
নবাব সিরাজউদ্দৌলা এবং তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী লুৎফান্নেসা। এপারেই রয়েছে একান্ন
সতী পীঠের অন্যতম কিরীটেশ্বরী মন্দির, ডাহাপাড়া জগদ্বন্ধু
ধাম, বড়নগরে রানী ভবানীর ১৮ শতকে তৈরি মন্দিরগুলি,ফারহাবাগ প্রভৃতিও।
কলকাতা থেকে ট্রেনে মুর্শিদাবাদের দূরত্ব ১৯৭ কিমি।
যাচ্ছে ১৩১০৩ ভাগীরথী এক্সপ্রেস, কলকাতা স্টেশন থেকে যাচ্ছে ১৩১১৭
ধনধান্য এক্সপ্রেস, শিয়ালদা স্টেশন থেকে যাচ্ছে লালগোলা
প্যাসেঞ্জার প্রভৃতি ট্রেন।
থাকা খাওয়া -- এখানে ঘোরাঘুরির সুবিধার জন্য
হাজারদুয়ারীর আশেপাশে থাকাটাই সুবিধাজনক। হাজারদুয়ারীর কাছেই রয়েছে হোটেল
অন্বেষা এবং হোটেল হিস্টোরিকাল ( দুটির ফোন নম্বর ৯৪৩৪১১৫৪৭০ , হোটেল ফ্রেন্ডস
এবং হোটেল পাপিয়া ( ৯৭৩২৬০৯০৮৪ ) হোটেল
যাত্রিক ( ৯৭৩৩৯৭৫০২৪ , ৬২৯৬৫১৯৭৩৯ ) প্রভৃতি। আর ঐতিহাসিক
স্থান ঘোরাঘুরি করার জন্য প্রয়োজন হয় উপযুক্ত এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গাইডের।
গাইডের জন্য প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারেন ৯৪৭৫৬৪৮৮৯ অথবা ৯৭৭৫৮৫৬৭০৫ নম্বরে ।
*************************************************************
পুরুলিয়ার বড়ন্তি ভ্রমণ
বেড়াতে যাওয়া মানেই কি অনেক দূরে , নিজের রাজ্য
ছেড়ে অন্য রাজ্যে পাড়ি দেওয়া? আমাদের নিজের রাজ্য ,
অর্থাৎ এই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এমন বহু
স্থান যেগুলির, নৈসর্গিক সৌন্দর্যের নিরিখে যে স্থানগুলি
অনায়াসে মুগ্ধ করতে পারে প্রকৃতি প্রেমিক পর্যটকদের।
এমনই একটি অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত স্থান হল
পুরুলিয়া জেলার " বড়ন্তি" ।
আদ্যন্ত আদিবাসী অধ্যুষিত ছোট্ট একটি পাহাড়ি গ্রাম
বড়ন্তি। প্রকৃতি যেন নিজের হাতে সাজিয়েছেন বড়ন্তিকে । ছোট ছোট পাহাড়, সুবিশাল জলাশয়,
অগভীর অরণ্য, সেই অরণ্যের বুক চিরে চলে গেছে
লাল মাটির রাস্তা। দুপাশে ছোট ছোট আদিবাসী মানুষজনের মাটির কুটির।
সেই সব আদিবাসী কুটিরের মাটির প্রাচীরের গায় রং -
বেরঙের অসাধারণ আলপনার শিল্প। পূর্ণিমার রাতে যখন এই সব আদিবাসী গ্রাম থেকে ভেসে
আসে বাঁশের বাঁশির সুরে ঝুমুর গানের সুর "
কালো জলে কুচলা তলে ডুবলো সনাতন / আজ সারানা কাল সারানা পাই যে দরশন "-- তখন
মন উদাস হয়ে যায় বৈকি।
শাল , পলাশ, মহুয়া,
পলাশ গাছের অরণ্যর ছায়ায় ঢাকা এই বড়ন্তি। তার মাঝেই মুরাডি পাহাড়ের গা ঘেঁষে চলে গেছে
বড়ন্তি নদী। এই নদীর বুকেই বাঁধ দিয়ে তৈরি হয়েছে বড়ন্তি রামচন্দ্র জলসেচ
প্রকল্প। চারদিকে ছোটোখাটো পাহাড় , বিশাল জলাধারে শীতকালে
বসে হরেক রঙের হরেক কিসিমের পাখির মেলা। দেখা মেলে অসংখ্য বিভিন্ন প্রজাতির
পরিযায়ী পাখির। ইচ্ছে হলে বড়ন্তি থেকে ঘুরে আসা যায় মুরাডির ছিন্নমস্তা মন্দির
বা প্রায় আধ ঘণ্টার দূরের জয়চন্ডী পাহাড়, প্রায়
সমদূরত্বে অবস্থিত বিহারীনাথ পাহাড়,গড় পঞ্চকোট থেকেও ।
যাতায়াত, থাকা খাওয়া ------বড়ন্তি যাওয়ার জন্য
প্রথমে আসতে হবে আসানসোল।
হাওড়া থেকে প্রচুর ট্রেন আসছে আসানসোল। এখান থেকে লোকাল
বা প্যাসেঞ্জার ট্রেনে সামান্য দূরত্বে অবস্থিত মুরাডি। মুরাডি থেকে অটো বা
গাড়িতে মাত্র ৫ কিমি দূরে বড়ন্তি।
এখানে রয়েছে রিসোর্ট সলিটারি ভেল । এখানে বাচ্চাদের
খেলার ব্যবস্থা,
সুইমিং পুল, রেস্তোরাঁ,মিনি
জু সহ সব রকমের সুব্যবস্থা আছে। ফোন ৯৪৩৪৩২২৫৩২, ৭৫৮৪০২৪৬৬৮,
এছাড়াও আছে বড়ন্তি ভিলেজ রিসোর্ট,বড়ন্তি
ইকো ট্যুরিজম রিসোর্ট প্রভৃতি।
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক পরিচিতি -
জন্ম কলকাতায়। দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতা
করেন। সাপ্তাহিক বর্তমানে ভ্রমণ নিয়ে নিয়মিত লেখেন। বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে এবং
তথ্য সংগ্রহে আনন্দ পান ।
ছবি - সংশ্লিস্ট সংস্থার সৌজন্যে