Advt

Advt

martyer-umara-galpo-story-by-reshmi-goppi-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-মর্ত্যের-উমারা-রেশমী-গোপ্পী


 

সুদূর বঙ্গভূমি থেকে ইন্দ্রপ্রস্থে আগমন কর্ম হেতু। নতুন জায়গা, সবকিছুই আলাদা। আর বঙ্গ-সন্তান মাত্রই পরবাসে এলে যে সমস্যার সম্মুখীন হয় তা হোল খাদ্যাভ্যাস। হ্যাঁ, আজকের দিনে সব জায়গাতেই মোটামুটি সব পাওয়া যায়, কিন্তু রাঁধুনি? সে কোথায় পাই? না, পরবাসে এসে কেউ শাক, শুক্তো, মাছের ঝোল রেঁধে খাওয়াবে এমন আশা করিনা, কিন্তু শুধু রুটি, পরোটা খেয়েও তো থাকতে পারবো না। আমাদের দুজনকেই সকাল সকাল ছুটতে হয়, তাই একজন ঠিকঠাক রাঁধুনি চাইই চাই। আশেপাশের যত জনের সাথে পরিচয় হোল সবাইকে বললাম যদি কেউ কোন সুরাহা করতে পারে।

আশায় আশায় দিন কাটে। এক রবিবারের সকালে ডোরবেলের আওয়াজে দরজা খুলে দেখি হাসি হাসি মুখে এক মাঝবয়সী মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। পাঁচ ফুটের মতো হাইট, ফর্সা পাতলা চেহারা, পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুলে টানটান করে খোপা বাঁধা, আর সিঁথি ভরা কমলা সিন্দূর। 

ভাবিজী, আপ খানা বানানেওয়ালি ঢুঁন্ড রাহিথি।“ আধা হিন্দি আধা ভোজপুরীতে যা বলল, তা হোল ওর নাম সরিতা। পাশের বাড়ির আন্টি (অবাঙালী জায়গায় তো আর কাকিমা বলতে পারিনা!) ওকে পাঠিয়েছে। কত্তা – গিন্নীর ছোটাছুটির সংসারে যেন হাতে চাঁদ পেলাম। সরিতা কাজে বহাল হোল।

কথায় কথায় জানলাম ওর বাড়ি বিহারের দ্বারভাঙ্গা জেলার কোনও এক গ্রামে। এখানে ওর স্বামী কোন এক কারখানায় কাজ করতো। কিছু শারীরিক সমস্যা হওয়াতে এখন কাজ ছেড়ে কারখানার সামনে চা – সিঙ্গারার দোকান দেয়। ওদের পাঁচটি মেয়ে। বড়টির আঠারো বছর বয়স। একবছর হোল বিয়ে হয়েছে, বর্তমানে পোয়াতি। জামাই কোন এক বেসরকারি ব্যাঙ্কের সিকিউরিটি গার্ড, গাজীয়াবাদে নিজস্ব বাড়ি আছে। বিয়েতে গয়নাগাটির সাথে চার লাখ টাকা দামের গাড়ি দিতে হয়েছে। গ্রামে ওদের জমিজমা কিছু আছে, কিন্তু ছেলে নেই বলে ওরা ভাগ পাবেনা। শুধু তাই নয়, শ্বশুর, শাশুড়ি তাদের কোন খবরও নেয়না। অথচ ওর বর মাসে মাসে সংসারের খরচ পাঠায়।

ভাবিজী, দেশে আমাদের বাড়ি আছে, জমি আছে সেখানে ফসল হয়। কিন্তু আমাদের কিছু দেয়না। আমার ‘পতি’ খুব মন খারাপ করে। বলে সবই আমাদের কপাল।“

সে আরও বলত, “জানেন ভাবিজী, আমরা পাঁচ বোন, দুই ভাই। আমি সবার বড়। মা আমাকে কখনও স্কুলে যেতে দেয়নি। আমি গোবর কুড়তাম, আর ভাই বোনেদের দেখভাল করতাম।“

তোমার মেয়েদের কি স্কুলে পাঠাও?” আমি জিগ্যেস করি।

হ্যাঁ, দাখিলা তো করে দিয়েছি, কিন্তু ওরা যায়না।“

কিছুদিন পর সরিতা এলো ছুটির আর্জি নিয়ে। নাতনী হয়েছে, মেয়ের বাড়ি যাবে। সাতদিন পর খুশী মনে ফিরে এলো। বলল মেয়ের শাশুড়ি খুব খুশী, বংশে প্রথম মেয়ে হয়েছে বলে। আরও জানালো, প্রথম সন্তান তাই কিছু বলেনি, যা হয়েছে তাতেই খুশী। তবে পরের বার আগেই ‘যাচ’ করাবে। মানে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ! এতো সহজ! শুনে সরিতা হেসে বলল “হ্যাঁ ভাবিজী, পাঁচ হাজার টাকা লাগে। আমাদের যদি টাকা থাকতো তবে আগেই ‘যাচ’ করিয়ে নিতাম। পাঁচ পাঁচটা মেয়ে হতো না। একজনের তো বিয়ে দিয়েছি, বাকিগুলোর কি হবে জানিনা। ওদের বাবা খুব রেগে থাকে ওদের ওপরে। মারধোর করে।“

খুব বিরক্ত লাগলো শুনে “কেন, মারধোর করে কেন?  ওদেরকে পৃথিবীতে আনার সময় মনে ছিলনা?” সরিতার ওপর বিশেষ প্রভাব ফেললো বলে মনে হলনা। আমিও আর কথা বাড়ালাম না।

এইভাবেই ব্যস্ততায় দিন কেটে যেতে লাগলো। মাঝখানে সরিতা দিন দুয়েক ছুটি করল। যেদিন কাজে এলো, দেখি খুব দুর্বল, চোখ মুখ একেবারে বসে গেছে।

কি হয়েছে সরিতা?” আমি জিগ্যেস করি।

জানিনা ভাবিজী। মাথা ঘোরাচ্ছে। আর বমি পাচ্ছে। কিছু খেতে পারছিনা।“

ওকে বললাম যেন অবিলম্বে নিকটবর্তী সরকারী হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার দেখায়। কিন্তু ওর বর ওকে কোন হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ও এসে বলে ডাক্তার বলেছে পেটে ‘পাথরি’ অর্থাৎ পাথর হয়েছে। ওষুধ দিয়েছে, বলেছে ঠিক হয়ে যাবে। বুঝলাম আমি কিছু বলা মানে অপাত্রে দান। ওর শরীর দিন দিন আরও খারাপ হতে থাকলো। ওকে দিয়ে আর কাজ করাতে সাহস পেলাম না। কিন্তু মানবিকতা বলেও একটা ব্যাপার আছে। বললাম “তোমার বরের সাথে কথা বলাও। আমি বলবো ভালো ডাক্তার দেখাতে। আমার তরফ থেকে যদি কিছু করার থাকে তো আমি করবো।“

একদিন সরিতা ফোন করে বলল ওরা গ্রামে ওর বাড়িতে যাচ্ছে। যেহেতু ওর কোন ছেলে নেই, তাই শ্বশুরবাড়ির লোকজন ওর কোন দায়িত্ব নিতে চায়না! আমার কিছু বলার নেই। অদ্ভুত এক সমাজে বাস করি আমরা।

প্রায় দু’সপ্তাহ পর সরিতার বরের নাম্বার থেকে আমার কাছে ফোন আসে।

ম্যাডাম জী, সরিতা আমাকে আপনাকে জানাতে বলেছে। ওর মা – বাবা ওকে সদর হাসপাতালে নিয়ে গেছিল। পাথরি নয়, সরিতা মা হতে চলেছে।“

মা হতে চলেছে! আর এখানের হাতুড়ে ডাক্তার ওকে পেটে পাথরের ওষুধ দিয়েছিল!! কি সাংঘাতিক! ওর বাকি মেয়েগুলোর কথা মনে পড়লো। তারপরেও আরেকজনকে আনছে এই পৃথিবীতে এইভাবে অযত্নে, অবহেলায় মাটিতে পড়ে থাকার জন্য! ওর বরের থেকে সরিতার বাড়ির ফোন নাম্বার নিয়ে নিলাম।

বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর ফোনে রিং হোল। এক নারী-কণ্ঠ। মনে হল সরিতার মা। কিন্তু মুশকিল হোল ভদ্রমহিলা হিন্দি বোঝেননা। আর আমি ভোজপুরী বলতে পারিনা। যাই হোক, অনেক চেষ্টা করে বার বার ‘সরিতা’ ‘সরিতা’ বলাতে তিনি হয়ত বুঝলেন। সরিতা আমার গলা পেয়ে উচ্ছ্বসিত কিশোরীর মত বলে উঠলো  -

ভাবিজী, আমি জানতাম আপনি ফোন করবেন। থাঙ্কু ভাবিজী“ সে বলে চলে “ইসবার যাচ করিয়েছি ভাবিজী। লাল্লা হবে।“ সরিতার খুশী আমি ফোনের এপার থেকে আন্দাজ করতে পারলাম।

বাবু হয়ে যাক ভাবিজী, আমি গিয়ে আবার কাজে ফিরবো।“ আমার আর কিছু বলার ছিলনা। শুধু বললাম “আপনা খ্যায়াল রাখনা।“

সেই প্রথম ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ আমার সঠিক মনে হোল। অন্তত কিছু নিষ্পাপ জীবন পৃথিবীতে এসে অনাদরে, অবহেলায়, অসন্মানে তো মাটিতে গড়াবে না। এরাই আবার নবরাত্রিতে ধূমধাম করে দেবীর আরাধনা করবে! কি বিচিত্র এই দেশ! 

সময় নদীর স্রোতের মতই বয়ে চলে। বছর ঘুরে গেছে। কর্মব্যস্ততায় সরিতার কথা ভুলেই গেছিলাম। হঠাৎ এক রবিবারের সকালে সরিতার উদয়!

ভাবিজী, আমি চলে এসেছি, আপনার কাছে কাজ করবো।“

তোমার ছেলে কেমন আছে?”

ভালো আছে ভাবিজী। খুব খিলাব পিলাব, তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাবে।“

 সে এখন খুব খুশী। শ্বশুর বাড়ির জমি জায়গাও পাবে। সমাজে এখন তার স্থান হয়েছে!

আর তোমার মেয়েরা?”

আছে ভালো।“

martyer-umara-galpo-story-by-reshmi-goppi-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-মর্ত্যের-উমারা-রেশমী-গোপ্পী


বুঝলাম সে তাদের কথায় বিশেষ আগ্রহী নয়। সত্যি তো, যাদের জন্য তার গঞ্জনার শেষ ছিলনা, তারা তো বোঝাই! ওর মেয়েদের আমি কোনদিনও দেখিনি, কিন্তু মনে মনে সেই ধূসর ধুলোমাখা মুখগুলো কল্পনা করলাম। চোখ সিক্ত করা ছাড়া কিছুই করার নেই।

ওকে বললাম “এখন তো আমার ঘরে একজন রান্না করে। কোনও সময় যদি ও নিজে থেকে ছেড়ে দেয় তো তোমায় জানাবো। আর তাছাড়া এত ছোট বাচ্চা রেখে তুমি এখন কাজ করতে পারবে না। ও একটু বড় হোক।

তবুও ও মাঝে মাঝেই আমায় ফোন করতো। ও যখন গ্রামে ছিল তখন যে আমি ফোন করে ওর খোঁজ নিয়েছিলাম সেটা ও ভুলতে পারেনি। বার বারই আমায় জানিয়েছে। কি জানি, হয়ত অজান্তেই দুই প্রান্তের দুই নারী কোন সূত্রে বাঁধা পড়েছে! ও হ্যাঁ, এরমধ্যে একদিন ছেলেকে দেখিয়েও নিয়ে গেছে।

এইভাবেই আরও সময় বয়ে চলে। উচ্চশিক্ষার জন্য আমি কর্ম-জগত থেকে সাময়িক বিরতি নিয়েছি। পরীক্ষা সামনে, এমন সময় আমার রাঁধুনি ছুটি নিয়ে দেশের বাড়ি চলে গেল। আমি পড়লাম অথই জলে! কী করি এখন! এমন সময় সরিতার কথা মনে পড়ল। সে মনে হয় আমার ফোনের অপেক্ষাতেই ছিল। পরদিনই এসে হাজির! যাক, স্বস্তি। 

আমি দেখতাম, আমি যখন পড়াশোনা করি, ও দূর থেকে চুপ করে একমনে আমাকে দেখে। একদিন ওকে জিগ্যেস করি “এমন করে কি দেখ?!”

ও বলে “পড় লিখকে কুছ বন যাও ভাবিজী। মুঝসে তো নেহি হুয়া, আপ বন যাও।“ অর্থাৎ লেখাপড়া করে জীবনে এগিয়ে যাও ভাবিজী। জীবনে আমি তো কিছু করতে পারলাম না, কিন্তু তুমি কোরো

দুই নারী, দুটি একেবারে ভিন্ন আর্থসামাজিক অবস্থান, কিন্তু এক দেশ! যেখানে দেশের অর্ধেক মানুষ অন্ধকারের অতলে, সেখানে সার্বিক বিকাশ কি সম্ভব? নবরাত্রি আসে, নবরাত্রি যায়, ঘটা করে দেবীর পুজো হয়, কিন্তু মর্ত্যের উমারা? তাদের অবস্থার কি কোন পরিবর্তন হয়

সরিতার ওপর আমি রাগ করবো না করুণা, ঠিক বুঝতে পারিনা। এটা সত্যি যে ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্বীকার। আবার মনে হয়, ও তো মা। সবাই যে বলে মা নিজের সন্তানের জন্য সবার বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়ায়, নিজের সন্তানদের অস্বীকার করতে পারেনা। তবে ও নিজের মেয়েদের প্রতি এত নির্দয় কি করে হয়? তবে কি মাতৃস্নেহ ও স্বার্থের ওপরে উঠতে পারেনা? নাকি আমি এক প্রেক্ষাপট থেকে এসেছি বলে এইভাবে ভাবতে পারছি। সমাজের বাকি অংশে আজও ‘অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম’ ও ‘যোগ্যতমের উদবর্তন’ ই আদি অনন্ত সত্য? আমাদের দেশের এটাই বাস্তব চিত্র যেখানে আজও কন্যা ভ্রূণ হত্যা হয়। শিশুকন্যার দেহ পলিথিনে মুড়ে আস্তাকুরে পাওয়া যায়। এই দেশই আবার শক্তির আরাধনায় ব্রতী হয়। ‘সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!’

ইতিমধ্যে এক এন জি ও এর সাথে আমার পরিচয় হয় যারা আশেপাশের বস্তির বাচ্চাদের জন্য কাজ করে। বাচ্চাদের পড়ায়, হাতের কাজ শেখায় ও পরে কাজের ব্যবস্থা করে। আমি সেখানে সরিতাকে নিয়ে যাই এবং তার মেয়েদের নাম নথিভুক্ত করি। এই শর্ত দিই যে আমি ওকে কাজে রাখব যদি ও মেয়েদের সেখানে পাঠায়।

একদেশ, বিভিন্ন আর্থসামাজিক অবস্থান। নবরাত্রি, দুর্গাপুজো, কালীপুজো …… সব আসে যায়। ৮ই মার্চ ঘটা করে নারী-দিবস পালন হয়। কিন্তু এ কোন সমাজে বাস করি আমরা। যেখানে এখনও বেঁচে থাকার জন্যই লড়াই করতে হয়, মানুষ হিসেবে ন্যূনতম অধিকারের জন্য লড়াই করতে হয়, সেখানে আত্মন্নতিসাধনের কথা তো অনেক দূরের গ্রহ। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ মনিষীরা নিজেদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে যে সমাজের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, জানিনা তা সর্বস্তরে কতটা সফল হয়েছে।

যে দেশে মায়ের চিন্ময়ী রূপের থেকে মৃন্ময়ী রূপের কদর বেশী, সেখানে মর্ত্যের উমাদের সন্মান আজও ভূলুণ্ঠিত।

লেখিকার পরিচিতি –

রেশমী গোপ্পী – পেশায় একজন ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। জন্ম ও বেড়ে ওঠা পশ্চিমবঙ্গের রাজার শহর কোচবিহারে। সাহিত্যানুরাগী, মাঝে মাঝেই বাংলা ও ইংরেজীতে কলম ধরেন এবং বিভিন্ন গ্রুপে লেখালেখি করেন।