কথায় আছে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ । আর সেই তেরো পার্বণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ পার্বণ হল দুর্গা পুজো। সারা বছর সমস্ত বাঙালি অপেক্ষা করে থাকে এই চারটি দিনের। ধর্মীয় আচারের চেয়েও জোরালো হয়ে ওঠে বিবাহিতা মেয়ের ঘরে ফেরার আনন্দ। এই আনন্দের অংশীদার যেন সমস্ত প্রকৃতিও। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহের পর বর্ষার ধারাসিক্ত পৃথিবী ধীরে ধীরে সেজে ওঠে শরতের মোহময় পরিবেশে। তারই মাঝে ঢাকের শব্দে মায়ের আগমনবার্তা সমস্ত বাঙালির হৃদয়কে উদ্বেল করে তোলে।
2024-এ এবারের পুজোর নির্ঘণ্ট কিছুটা
গোলমেলে হওয়ায় পুজো তার কৌলীন্য ছেড়ে কোন কোন পঞ্জিকা মতে তিনদিনে এসে দাঁড়িয়েছিল।
তাতে সবার মনে কিছুটা বিষণ্ণতা তো ছিলই । তবু তারই মাঝে, এ বছর ভেবে রেখেছিলাম একটু
অন্যরকম পুজোর যদি কিছু সন্ধান পাই, তবে সেটা দেখতে যাবো। বেশ কয়েকবছর প্রবাসে কাটিয়ে
আপাতত আছি পশ্চিমবঙ্গে। প্রবাসের বাঙালি পুজোগুলি নিঃসন্দেহে খুব ভাল কাটিয়েছি, কিন্তু
তবু বাংলার নিজস্ব কিছু দুর্গাপুজো অবশ্যই স্বতন্ত্র। সেরকমই একটি পুজোর কথা শুনেছিলাম
–‘হীরালিনী দুর্গোৎসব’, বনেরপুকুর
ডাঙা গ্রাম, শান্তিনিকেতনে।
এই পুজো দেখতেই বেরিয়ে পড়লাম । শহরের থিম পুজোর আকর্ষণ এড়িয়ে
চললাম অজস্র কাশ ফোটা অজয় নদের দু’পাশের ‘নয়ন ভুলানো’ রূপ দেখতে দেখতে। অজয় নদের ব্রিজ পেরিয়ে আমরা শান্তিনিকেতনের
দিকে চললাম। শান্তিনিকেতনের একটি অন্যতম ভ্রমণ কেন্দ্র ‘শনিবারের হাট’, যা খোয়াইতে সোনাঝুরির জঙ্গলে বসে। এই সোনাঝুরির জঙ্গলের
মধ্যেই আছে বনেরপুকুর ডাঙা গ্রাম। ওখানে গিয়ে স্থানীয় কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই তাঁরা রাস্তা
দেখিয়ে দেবেন। মেইন রাস্তা থেকে বাঁদিক ধরে একটু নেমে গেলেই জঙ্গলের মধ্যে এই পুজোর
খোঁজ পাবেন। জঙ্গলের মধ্যেই গাড়ি পার্কিং এর জায়গা। যারা এখানে গেছেন তাঁরা বুঝবেন
এই খোয়াই, সোনাঝুরি গাছের জঙ্গল অন্য কোন জঙ্গল থেকে কতটা আলাদা। লাল মাটির এই জঙ্গল
কিন্তু অন্য জঙ্গলের মত ঘন নয়। এখানকার প্রকৃতি নাগরিক মানুষকে টানবেই।
এবার এই পুজোর ইতিহাস জানা যাক।
Government College Of Art & Craft এর শিক্ষক শ্রী বাঁধন দাস এই পুজো শুরু করেন ২০০১ সালে। তার
আগে ১৯৯০ সালে তিনি এই খোয়াইতে নিজস্ব স্টুডিও
বানিয়েছিলেন। প্রকৃতির বুকে বেশ ছড়ানো ছিটানো এই স্টুডিও । আদিবাসী অধ্যুষিত
এই গ্রামে তিনি স্থানীয় আদিবাসীদের সহযোগিতা
পেয়ে এসেছেন বরাবর। শ্রী দাস এই দুর্গোৎসবের নাম রাখেন ‘হীরালিনী দুর্গোৎসব’। এখানে ‘হীরা’ তাঁর আপন
স্বর্গগতা সহোদরা এবং ‘নলিনী’ তাঁর স্বর্গীয়
পিতার নাম। শ্রী দাস যে দুর্গাপ্রতিমা তৈরি করেন তার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে। সেগুলি
হল –
১- প্রতিমা তৈরি হয় পাঁচ প্রকারে,
মূলত পাঁচটি উপাদানে। মাটি, বাঁশ, কাঠ, পোড়ামাটি এবং লোহা। এরমধ্যে দুটি মূর্তি উনি
বানিয়েছিলেন, বাকি তিনটি ওনার ছাত্রদের বানানো ।
২- এই পাঁচটি মূর্তি বানানোই আছে,
প্রতি পাঁচ বছর পর পর পুনরাবৃত্তি হয়।
৩- দুর্গা এবং অন্য প্রতিমার হাতে
কোন অস্ত্র থাকেনা।
৪- পুজোর পর প্রতিমা বিসর্জনও হয়না,
কেবল ঘট বিসর্জন হয়।
এই পূজা মন্ডপের সামনে আমরা বেশ কিছুক্ষণ আবিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম । এত সুন্দর
পুঙ্খানুপুঙ্খ নকশা এবং নির্মিতি যে, দেখতে দেখতে বেশ কিছু সময় চলে যায়। ছড়ানো ছিটানো
স্টুডিও পরিসরটি পরিষ্কার ছিমছাম অথচ জমকালো এক সুদৃশ্য বাতাবরন তৈরি হয়েছে। সমগ্র
অঞ্চলটির সজ্জা-বিন্যাস পরিকল্পিত বলেই কোথাও বাহুল্য মনে হয়না। মণ্ডপের চারধারে গাছপালার
মাঝেই দুপাশে দুটি ফলন্ত কলাগাছ দৃষ্টি আকর্ষণ করে । এছাড়া বাঁশের অন্দর-সজ্জা , চালার
ওপরে লোহার বেশ কিছু installation , চমকে যেতে হয় দেখে। স্টুডিওর বহিরঙ্গের
সজ্জা অনেকটাই দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল প্রভাবিত।
বর্তমানে সামাজিক মাধ্যমের প্রভাবে
এই পুজোর খ্যাতি বিশেষ ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে । ফলত, দর্শনার্থীর ঢল দেখতে পেলাম। বিশেষত,
অল্পবয়সী তরুণ, তরুণীর ভিড় লক্ষ্য করার মত। তবে, আমার মনে হল এই ভিড়ের বেশিরভাগ অংশই
ফেসবুকে বা ইন্সটাতে সেলফি আপলোড করতে বেশি আগ্রহী। পুজোর চারদিন স্থানীয় আদিবাসীরা
এখানকার দেখাশোনা করেন, পুজো শেষ হওয়ার পরেও ওনারাই আবার জঙ্গল পরিষ্কার করে দেন।
শ্রী বাঁধন দাসের মৃত্যু হয় মাত্র
আটান্ন বছর বয়সে, ২০০১ সালে। তারপর থেকে শ্রী দাসের আরেক বোন শ্রীমতী চিত্রা এবং তাঁর
স্বামী শ্রী আশিস ঘোষ এই পুজোর তত্ত্বাবধান করেন। পুজোর কয়েকদিন বাউল শিল্পী এবং ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী শিল্পীরা এখানে তাঁদের শিল্প প্রদর্শন করেন। এত সুন্দর পরিবেশ
ছেড়ে আসার ইচ্ছা করছিল না, কিন্তু ফিরতে তো
হবেই । তাই এই খোয়াই, সোনাঝুরির জঙ্গল, এই উন্মুক্ত আকাশের নীচে এক মেঠো অথচ
শিল্প-সুষমায় অনবদ্য এই আয়োজন থেকে আবার দৈনন্দিন
জীবনে ফেরার তাগিদে গাড়ীতে চেপে বসলাম। ফিরতে তো হয়ই।
লেখিকার পরিচিতি:----
শর্মিষ্ঠা চ্যাটার্জি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যে স্নাতক এবং বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর সম্পূর্ণ করেছেন। স্বামীর চাকরিসুত্রে ভারতের নানান প্রদেশে থাকার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তিনি নিজেও লেখালেখি চালানোর পাশাপাশি অনেক জায়গায় স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। বই পড়ার সঙ্গেই গানের চর্চাও চালিয়ে গেছেন। বেশ কিছু ওয়েব ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখে থাকেন। কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিনেও ওনার লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
প্যাশন- ভ্রমণ এবং
ভ্রমণ সংক্রান্ত ব্লগ লেখেন।