Advt

Advt

biswa-sahityer-sera-bara-galpo-3rdpart-feature-by-nalinaksha-bhattacharya-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine

ধারাবাহিক  

 

biswa-sahityer-sera-bara-galpo-3rdpart-feature-by-nalinaksha-bhattacharya-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine

 ৩য় পর্ব

ভাড়াটেদের উঠিয়ে দিয়ে, গ্রেগর নামের সেই বিরাট পোকাটাকে বাঁচিয়ে রাখার ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে, গ্রেগরের মা,বাবা এবং বোন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে শহরের বাইরে গিয়ে প্রকৃতির সংস্পর্শে এসে মনকে স্থিতাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে। এমনকি এত কষ্টের মধ্যেও গ্রেটা যে এতদিনে এক সুন্দরি যুবতী হয়ে উঠেছে তা লক্ষ করে গ্রেগরের বাবা মা ওর বিয়ের কথা চিন্তা করেন।

মেটামরফসিস নিয়ে নানারকম মন্তব্য করেছেন সমালোচক এবং লেখকরা। এঁদের মধ্যে কেউ এই গল্পকে ব্যাখ্যা করেছেন ধর্ম এবং মনোবিদ্যার দৃষ্টিকোন থেকে আবার কেউ বলেছেন যে রূপক বা প্রতীকের কোন সাহায্য না নিয়েও এ গল্পের রস আস্বাদন করা সম্ভব। এমন কি গ্রেগর যে পোকাতে রূপান্তরিত হল সেটা আরশোলা না গুবরে পোকা তা নিয়েও মতদ্বৈততা আছে। এই সব বিতর্কের মধ্যে না গিয়েও গল্পটাকে বুঝবার একটি সহজ উপায় হচ্ছে গ্রেগরের এই অকল্পনীয় রূপান্তরকে একজন সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষ সামাজিক, আর্থিক বা শারীরিক কারণে যখন অসহায় হয়ে পড়ে তার সঙ্গে তুলনা করা। প্রথম দিকে সাহায্য, সহানুভূতি, সমবেদনা আসে, তারপর আসে অবজ্ঞা ও বিরক্তি এবং পরিশেষে একটা সময় আসে যখন এই অসহায়, পরনির্ভর মানুষটিকে আমরা এড়িয়ে চলি, এমনকি তার মৃত্যু কামনা করি। আমাদের মানবিকতা শেষ পর্যন্ত উধাও হয়ে যায় পরিস্থিতি এবং পরিবেশের চাপে। কাফ্‌কা এই গল্পে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন এই নির্মম বাস্তবের মুখোমুখি যার থেকে পালিয়ে যাবার কোন উপায় নেই।

কাফ্‌কার জগত আমাদের অনেক সময়ই অপরিচিত, অবাস্তব মনে হয় কিন্তু তাঁর গল্প উপন্যাসে যে চরিত্রগুলো ঘোরাফেরা করে, যে ঘটনাগুলো ঘটে তা আমাদের অস্তিত্বের সংকটকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসে। ফরাসি ঔপন্যাসিক আন্দ্রে জিদ্‌ কাফ্‌কার সাহিত্য সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয় – ‘ I cannot say what I admire more, the naturalistic presentation of an imaginary world rendered believable through minute precision of the images or the daring turn of the mysterious.’

নিকোলাই গোগোল – দ্য ওভারকোট ( ১৮৪২)

নিকোলাই গোগোলের( ১৮০৯–১৮৫২) রুশ সাহিত্যে অবদান কত বিশাল এবং প্রগাঢ় তা বোঝা যায় ফিয়োদর ডস্টয়েভস্কির এই বিখ্যাত উক্তি থেকে – ‘ We have all emerged from the Overcoat of Gogol.’আমরা সবাই গোগোলের ওভারকোট থেকে বেরিয়ে এসেছি’। বিশ্ব সাহিত্যে গোগোল তাঁর অতি উচ্চ স্থানটি সুনিশ্চিত করে নিয়েছেন তাঁর Dead Souls (মৃত আত্মারা) নামক ব্যাঙ্গাত্বক উপন্যাসের জন্য কিন্তু ছোট গল্প রচনায় যে তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন তা বুঝতে হলে পড়তে হবে তাঁর দ্য ওভারকোট গল্পটি।

গল্পের সারাংশ

আকাকাই আকাকাইয়েভিচ তৎকালীন রাশিয়ার রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গের একটি সরকারি অফিসে কেরানি এবং নকলনবিশ। আকাকাইয়ের গতানুগতিক জীবনে কোন আনন্দ নেই। চিঠি পত্র, দলিল দস্তাবেজের নকল তৈরি করাই তার জীবনের একমাত্র ব্রত। তার বছরের মাইনে চারশো রুবল যা থেকে অতি কষ্টে জীবন নির্বাহ করে আকাকাই। যে শতচ্ছিন্ন, তাপ্পি মারা ওভারকোটটি পরে সেন্ট পিটার্সবার্গের প্রচন্ড শীতে কাঁপতে কাঁপতে অফিসে আসে আকাকাই সেটি তার সহকর্মিদের ঠাট্টা বিদ্রুপের উৎস হয়ে দাঁড়ায়। সহকর্মিরা তাকে বেশি জ্বালাতন করলে সে শুধু মিন মিন করে বলে, ‘ কেন আমাকে অপমান করছ তোমরা? আমাকে একা থাকতে দাও।‘

পুরনো ওভারকোটটিতে আরও একটি তাপ্পি লাগাতে সে গিয়ে একদিন হাজির হল তার দরজি পেত্রোভিচের কাছে। কোটটিতে ইতিমধ্যেই এত তাপ্পি মেরেছে পেত্রোভিচ যে ও এবার স্পষ্ট জানিয়ে দিল যে ওতে আর রিফুর কাজ করা সম্ভব হবেনা। আকাকাইকে নতুন ওভারকোট বানাতে হবে। কিন্তু কাপড় কিনে নতুন কোট সেলাই করতে যে রুব্‌ল লাগবে তা কোত্থেকে জোগাড় করবে আকাকাই? অথচ নতুন কোট না হলে হিমেল ঠান্ডায় অফিসে যাতায়াত করবে কী করে ও? ব্যয়সংকোচ করা শুরু করল আকাকাই। রাতের খাবার কমিয়ে দিল, সন্ধ্যার চা খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল ওর।

ছয় মাস নিজেকে নানাভাবে বঞ্চিত রেখে কিছু রুবল জমিয়ে পেত্রোভিচকে সঙ্গে নিয়ে অনেক কাপড়ের দোকান ঘুরে কাপড় কিনে শেষ পর্যন্ত নতুন ওভারকোট বানিয়ে নিল আকাকাই। ওই কোট পরে প্রথম যেদিন ও অফিসে এল ওর সহকর্মিরা সবাই এসে ওকে অভিনন্দন জানাল। ওর অফিসার খুশি হয়ে আকাকাইয়ের নতুন ওভারকোটকে সন্মান জানাতে নিজের বাড়িতে পার্টির আয়োজন করলেন সেরাতে। কিন্তু রাত বারোটার পর পার্টি থেকে বেরিয়ে ও যখন পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল তখন ঘন কুয়াশার মধ্য থেকে দুটো গুন্ডা এসে দাঁড়াল ওর সামনে।ওরা আকাকাইয়ের ওভারকোট ছিনিয়ে নিয়ে ওকে বরফের মধ্যে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে পালিয়ে গেল।

ওভারকোট ফিরে পাবার জন্য আকাকাই চলে গেল পুলিশের কাছে কিন্তু ওরা কোন সাহায্য করলনা। অফিসের একজন সহকর্মির পরামর্শে আকাকাই গিয়ে দেখা করল একজন ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেলের সঙ্গে। এত ছোট ব্যাপার নিয়ে কেন আকাকাই ওঁকে বিরক্ত করতে এসেছে, কেন ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারি কাছে দরখাস্ত জমা দেয়নি আকাকাই তা নিয়ে জেনারেল ওকে প্রশ্ন করলে আকাকাই বলতে বাধ্য হল যে ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারিরা তার মত সাধারণ লোকদের কোন পাত্তা দেয়না। এই সত্যবচনে ক্ষুব্ধ হয়ে এমন তর্জন গর্জন শুরু করেন জেনারেল যে আকাকাই প্রায় অজ্ঞান হয়ে যায়। লাঞ্ছিত, অপমানিত আকাকাই প্রচণ্ড ঠান্ডায় টলতে টলতে বাড়ি ফিরে আসে কোনোরকমে। সেরাতেই প্রচণ্ড জ্বর হয় আকাকাইয়ের। জ্বরের ঘোরে ভুল বকতে শুরু করে ও। প্রথম দিকে জেনারেলের কাছে ও ক্ষমা ভিক্ষা করে কিন্তু মৃত্যু যখন ওর শিয়রে এসে দাঁড়ায় তখন জেনারেলকে গালাগালি করে আকাকাই।

হতভাগ্য আকাকাইয়ের মৃত্যু দিয়ে গল্পটি শেষ করেননি গোগোল। কিছুদিন পরে শহরে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে আকাকাইয়ের ভূত গভীর রাতে ঘুরে বেড়ায় সেন্ট পিটার্সবার্গের রাস্তায় আর সেই ভূত ভাল ওভারকোট দেখলেই ছিনিয়ে নেয় পথচারীদের কাছ থেকে। আকাকাইকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন যে জেনারেল তার মনে পাপবোধ জাগ্রত হয় কিন্তু একরাতে পার্টি থেকে ফেরার সময় সেই জেনারেলের ওভারকোটও ছিনিয়ে নেয় আকাকাইয়ের ভূত। জেনারেলের কোটটি ছিনতাই করে আকাকাইয়ের আত্মা সন্তুষ্ট হয় কেননা এই ঘটনার পরে আকাকাইয়ের ভূতকে আর কেউ সেন্ট পিটার্সবার্গের রাস্তায় দেখতে পায়নি কোনদিন।

গোগোল তাঁর ‘ডেড সোলস’ উপন্যাসে আমলাতন্ত্রের উপর ব্যঙ্গের তীব্র কশাঘাত করেছেন। ওভারকোট গল্পেও গোগোলের চাবুক আমলাতন্ত্রকে আঘাত হেনেছে কিন্তু নিঃস্ব, হতভাগ্য  আকাকাইয়ের নতুন ওভারকোট হারাবার মর্মবেদনা যেভাবে ব্যক্ত করেছেন গোগোল তা এক অন্য মাত্রা সংযোজন করেছে এই গল্পে। রুশ সাহিত্যে ওভারকোট গল্পটি যে শীর্ষ স্থান অধিকার করে আছে তাকে স্বীকৃতি দিয়ে বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ভ্লাদিমির নবোকভ বলেছেন  ‘The greatest Russian short story ever written.’ ২০০৯ সালে গোগোলের দ্বিশত জন্মবার্ষিকীতে এই মহান কথাকারকে সম্মান জানাতে রুশ সরকার যে ডাক টিকিটটি বের করেছিল তাতে আমরা দেখতে পাই সেই হতভাগ্য কেরানিকেই। টাক মাথা আকাকাই ঘাড় গুঁজে টেবিলে বসে কাজ করে যাচ্ছে আর তার পাশেই দেয়ালে ঝুলছে তার সেই অবিস্মরণীয় ওভারকোট।

ক্রমশ ……

 

৪র্থ পর্ব পড়ুন আগামী মঙ্গলবার

লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

লেখক পরিচিতি

জন্ম এবং শিক্ষা কলকাতায়; কর্মজীবন দিল্লিতে, কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রালয়ে। গল্প লেখার শুরু ষাটের দশকের শেষ দিকে। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে আসছেন গত পঞ্চাশ বছর ধরে। ইংরেজিতে দেশে এবং বিদেশে ওঁর কিছু গল্প এবং তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। বিবিসি থেকেও ওঁর কয়েকটি গল্প প্রচারিত হয়েছে। বাঙলায় চারটি উপন্যাস এবং দু’টি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। দেশ, আনন্দবাজার, সাপ্তাহিক বর্তমান, নবকল্লোল, পরিচয়, কালি ও কলম(বাংলাদেশ) এবং দিল্লি ও কলকাতার অনেক সাহিত্য পত্রিকায় গল্প লেখেন নলিনাক্ষ। দিল্লি থেকে প্রকাশিত ‘ কলমের সাত রঙ’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত আছেন।