১ম পর্ব
সম্ভবত
শনিবার ছিল দিনটা। টিপ্ টিপ্ করে বৃষ্টি পড়ছে। সকাল থেকেই লেগেছে, নাছোড়বান্দা বৃষ্টি।
সেদিন বিক্রিবাট্টা প্রায় নেই বললেই চলে। সন্ধ্যের পরে রাস্তাঘাট একেবারেই শুনশান।
খুব দরকার না পড়লে, এই শীতকালের বৃষ্টিতে কেউ বেরোয়! এমনিই হাড়কাঁপানো ভিজে
ভিজে ঠান্ডা, তার ওপর দু’ফোঁটা জল পড়লে, আর রক্ষে নেই।
বেশীরভাগ
দোকানদারই দোকান বন্ধ করে পালিয়েছে। ঠিকই
করেছে। বেকার বসে খুলে রেখে লাভ কী! গোবিন্দ শুধু চায়ের দোকানটা খুলে রেখেছে। যদি
দু’একটা রিক্সাওয়ালা ভিজে গামছা মাথায় দিয়ে
চা খেতে আসে। পবিত্র-ও বন্ধ করে দিত। কিন্ত হাতে একটা আর্জেন্ট্ কাজ আছে। কালকেই
ডেলিভারি দিতে হবে। শ্রাদ্ধের ব্যাপার। সকালবেলাই
নিতে আসবে। তবুও যে মানুষ, একটু আগে থাকতে ছবি বাঁধাতে কেন দেয় না, কে জানে! মা তো
কবে মরে গেছে। জানে তো, ছবি বাঁধাতে হবে, শ্রাদ্ধের
সময় লাগবে। তবু দেবে ঠিক দু’দিন আগে। তারপর ছবিটা দিয়েই মাথার ওপর চড়ে বসবে। ফোনের
পর ফোন। কই হলো? আরে! লোকে কী একটা কাজ নিয়ে বসে আছে। ঠাকুরের ফটো, ঘোড়ার, ফুলের,
বিয়ের, জন্মদিনের, পাহাড়ে ঘোরার, সমুদ্রে নাচার কতরকম ছবি যে লোকে বাঁধাতে দেয়,
তার ঠিক নেই। তার
মধ্যে এই মৃত মানুষের ফটো ফেলে রাখা যায় না। দিনের দিন ঠিক হাতে দিতেই হবে। শ্রাদ্ধ
তো আর ছবির জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে না। পবিত্র চাইছে তাড়াতাড়ি করে দত্ত কাকিমার, মানে
কাল যার শ্রাদ্ধ, তার
ছবিটা বাঁধিয়ে ফেলতে। তারপর পায়ের ‘ছাপ’টা বাঁধিয়ে একদিন পরে দিলেও হবে। হাতের কাজটা শেষ হলেই দোকান বন্ধ করে পালাবে। ফ্রেমের
ভেতর ঢোকানো হয়ে গেছে, তা-ও এখনও কাচটা কাটা বাকী। একটু হালকা ঝড় দিচ্ছে আবার! বেশ
শীত করছে। চিৎকার করে গোবিন্দকে একটা চায়ের ইশারা করল। গোবিন্দ হাত দেখাল।
পাশের
চায়ের দোকান থেকে লাফিয়ে নেমে এল গোবিন্দ। কাঁপা গলায় বলে উঠল, “কী হয়েছে দাদা? কারেন্ট মারল?”
এইজন্যই বলে,
মাথামোটা গোবিন্দ। লোডশেডিং-এ কারেন্ট মারবে! আঙুল দিয়ে ইশারা করল পবিত্র ঐ আলতা
পরা পায়ের ছাপের দিকে। মাথায় বুদ্ধি কম, তবুও চিরকাল বেশি চালাকি করার শখ
গোবিন্দর। একগাল হেসে বলল, “দূ…র! কোনও মহিলা এসে তোমার দোকানের শেডের নীচে দাঁড়িয়েছিল, হয়তো
পায়ে আলতা ছিল, বৃষ্টিতে সেই ছাপ পড়েছে।”
--- “তার পায়ে চটি থাকবে না?”
--- “ছাড়োতো। রাত্তিরবেলা মাথা খারাপ কোরো না। হয়তো চটি ঝড়বৃষ্টিতে ছিঁড়ে
গেছে!”
--- “ঠিক আছে, চল্। তোর দোকানে গিয়ে একটু বসি। তখন অন্ধকারে চা-টাও ঠিকমত
খাওয়া হল না। চল্ আর এক কাপ চা খাই।”
--- “চলো, গিয়ে বসবে চলো।”
--- “তুই কখন দোকান বন্ধ করবি?”
--- “একটু পরে।”
--- “আজ আর এই অন্ধকারে শীতের বৃষ্টির রাতে একা যেতে ইচ্ছে করছে না, তোর সঙ্গেই
বাড়ি ফিরব। একটু বসি।”
--- “বোসো না। কে বারণ করেছে। একসাথে গপ্পো করতে করতে ফিরব।”
একটু পরেই
দোকান বন্ধ করল গোবিন্দ। তবে
ছাতা আনে নি। ঘাড়ে হাত দিয়ে পবিত্র’-র ছাতায় ঢুকল।
টুকটুক
করে দু’জনে হাঁটছে আর টুকটাক গল্প হচ্ছে। এবার মেন
রোড্ থেকে ডানদিক মারল। এই রাস্তাটা গাছপালায় ঘেরা। রাস্তার একদিকে টালাপার্ক, আর
একদিকে জিমখানার মাঠ। এমনি সাধারণ দিনেই রাস্তাটা ছায়াময়।
গাছপালা ঝোপের আড়ালে জোড়ায় জোড়ায় প্রেমিক প্রেমিকারা দাঁড়িয়ে
থাকে। আসল নাম টালাপার্ক সরণী। লোকে বলে বৃন্দাবন লেন। রাত্তিরে মাঝেমধ্যেই
বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এখান দিয়ে যাওয়াটাই দুষ্কর। এক
একটা প্রেমিক যুগল এমন দাঁড়িয়ে থাকে যেন ইভ সবে আপেল খেয়েছে আর আদম্ তখন খাবে
খাবে করছে। মনে হয়, বাচ্ছাদের চোখ চেপে নিয়ে যাই। আজ একদম জনমানবশূন্য। আজ যা
বৃষ্টি হচ্ছে, পুরো ‘প্রেমেরও জোয়ারে, ভাসাবে দোঁহারে'।
হঠাৎ মনে
হল একটা জোড়া। পিছন থেকে দেখছে ওরা। বড় কালো ছাতায় পিঠ অবধি ঢাকা। হনহন করে
হাঁটতে লাগল পবিত্র আর গোবিন্দ। ঐ
যুগলের একটু কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করল। মানে কৌতূহল, এই বৃষ্টিতেও কাদের এত শখ
প্রেম করার! ফুট্ বিশেকের মধ্যে চলে এসেছে। মেয়েটি মনে হচ্ছে, ফ্যাকাশে রঙের
শাড়ি পরা, হাঁটাটা বয়স্ক মহিলাদের মত। ছেলেটার না লোকটার বলাই ভালো,পরনে ধুতি পাঞ্জাবি। বাব্বা!
বয়স্ক পুরুষ,মহিলারাও আজকাল এই দুর্যোগের মধ্যে অন্ধকারে
প্রেম করছে! হাঁটার গতি আরেকটু বাড়িয়ে দিল ওরা, ঐ লোক আর মহিলাটার মুখ দেখতে চাইল। যত
কাছাকাছি আসতে লাগল,দেখল ঐ বুড়োবুড়ি দু’টো
যেন আরও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। গোবিন্দরা
এখন দৌড়োনোর মত হাঁটছে, তবুও মনে হচ্ছে বুড়োবুড়িটা যেন উড়ছে। ওমা! একি! ওদের দু’জনেরই খালি পা। শুধু তাই নয়, পায়ে আলতা পরা। এমনকি লোকটারও। পবিত্র
ফিসফিস করে উঠল, “কিরে গোবিন্দ?কী
বুঝছিস?”
গোবিন্দ
হিসহিসিয়ে উত্তর দিল, “মন্দির থেকে আসছে মনে হয়, চটি
মন্দিরেই হারিয়েছে। পায়ে সিঁদুর লেগে আছে। কী মতলব বলতো দু’টোর? চু…উপ, আস্তে!
চলো গিয়ে পাকড়াও করি।”
এই বলেই
গোবিন্দ ছুটতে লাগল। ব্যাটার
খুব সাহস। বুড়োবুড়িটা আচমকা আবার ডানদিকে ঘুরে, টালাপার্কে ঢুকল। ওরাও পিছু নিল।
এবার একেবারে ভীষণ কাছাকাছি। এই
ধরে ফেলল বোধহয়। পুকুরের
ধারের বাঁধানো রাস্তাটা থেকে দুম্ করে সেই বুড়োবুড়িটা ঝিলপুকুরে নেমে গেল। হাঁটছে
একইরকম। জলের ওপর দিয়ে। পবিত্র আর গোবিন্দর হাত-পা ঠান্ডা। মনে হচ্ছে, পায়ে কেউ
পেরেক গেঁথে রাস্তার সাথে আটকে দিয়েছে। নড়তে চড়তে পারছে না আর। হঠাৎ অন্ধকারে একটা বিদ্যুতের
ঝলকানি। আকাশ চিরে এফোঁঢ় ওফোঁড় করে দিল। একটা প্রচন্ড বাজ পড়ার আওয়াজে ওদের
সংবিত ফিরল। মনে হয়, কাছাকাছি কোথাও পড়ল। দুজনে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড় লাগাল বাড়ির
দিকে। সারারাত মোটামুটি ঘুমোতেই পারল না পবিত্র। শুধু চোখ বুজে পড়ে রইল বিছানায়। একটা
চিন্তাও আছে মাথায়। খুব ভোরে উঠেই দোকানে যেতে হবে। ঐ দত্তকাকিমার ছবিটা বাঁধাতে
হবে। কাজটা মাথার মধ্যে খচখচ করছে। আলো ফোটার আগেই মোটামুটি উঠে পড়ল। তাড়াতাড়ি
রেডি হয়ে দোকানের পথে হাঁটা দিল। তখনও কেউ দোকান খোলেনি। গোবিন্দ-ও আসেনি।
প্রণাম
করে সার্টারের চাবিটা লাগাল। তারপর টেনে সার্টারটা খুলতেই থরথর করে কাঁপতে লাগল
পবিত্র। দোকানের
সারা মেঝেতে আলতা পায়ের ছাপ। লাফিয়ে পিছিয়ে এল পবিত্র। দূরে দুধের দোকানটা সবে
খুলছে। দোকান খোলা রেখেই পবিত্র দুধের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তবে এই গল্প
সবার সাথে করা যাবে না। কারণ আছে। তবে মনে হয়, যা কান্ড ঘটা শুরু হয়েছে, বোধহয়
সেই গল্পটা এবার বাধ্য হয়ে সবাইকেই বলতে হবে।
প্রতিদিন
গোবিন্দ অনেক ভোরেই চায়ের দোকান খোলে। কিন্তু আজ আসতে দেরি করছে কেন? বেশ
খানিকক্ষণ পরেই এল আজ গোবিন্দ। গোবিন্দকে
দেখে যেন একটু ধড়ে প্রাণ ফিরে পেল পবিত্র। দূর থেকেই ডাক দিল, “এ…ই গোবিন্দ।”
--- “কী হল? তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?”
ঠোঁটের
ওপর আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলল পবিত্র। তারপর ইশারায় দোকানের সামনে ডাকল। গোবিন্দর
মাথায় তখনও কিছু ঢুকছে না। দোকানের সামনে এসে গোবিন্দকে দেখাল। এবার গোবিন্দর-ও
চক্ষু চড়কগাছ! চোখেমুখে একটা আতঙ্ক। মনে হয় একটু ভয় পেয়েছে। সেটা কি ভূতের না
পুরোনো কোনও অপরাধবোধের? কী সেই অপরাধবোধ! সেই গল্পই এখন জানতে হবে।
ক্রমশ ……………
২য় পর্ব পড়ুন
আগামী বুধবার
লেখক পরিচিতি:-
দেশ, আনন্দবাজার, সানন্দা, আনন্দমেলা, নবকল্লোল, ও বর্তমান প্রকাশনীর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এবং
অসংখ্য গল্প সংকলন ও পত্রিকায় নিয়মিত
লেখক।
২০২৩ সালের এবিপি আনন্দ'-র সেরা গল্পকার (অণুগল্প)
একক বই:- বই-শাখে পঁচিশ, চতুরঙ্গে দৈবরহস্য,কুড়ির মধ্যে কুঁড়ি (ছোটদের)।