পল্লী সমাজ,রামের
সুমতি, উপন্যাস গুলো যতবারই পড়ি,নতুন বলে
মনে হয়। বারে বারে বইগুলো উঠে আসে আমাদের হাতে। আবেগ অনুভূতি গুলিকে নাড়িয়ে
দেয়। কখনো হাসি,কখনো বা দুই চোখ ভরে ওঠে। কল্পনায় দেখার চেষ্টা করি বাংলার সহজ সরল পরিবেশ, ভালো-মন্দ, দোষে-গুনে
ভরা মানুষগুলো। পাতা উল্টাতে উল্টাতে যেন হারিয়ে যাই ছায়া
সুনিবিড় পল্লী গ্রামে যেখানে বাস
করে নারায়ণীর মত মাতৃসমা বৌদি, বাস করে
গফুরের মত দুর্ভাগারা, আছে
ইন্দ্র নাথের মত দুরন্ত নির্ভীক ছেলে।
একদিন মনে হল একবার স্বচক্ষে দেখেই আসা যাক সেই পল্লী গ্রাম
যার সৌরভ উপন্যাস গুলিতে ছড়িয়ে
আছে।
যেমনি ভাবা, রওনা হলাম
সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভিটে। যেতে হবে দেউলটি গ্রাম, (হাওড়া
জেলা) কলকাতা থেকে ৬৮ কিলোমিটার।
ঘণ্টা দুয়েক লাগল। হাইওয়ে
১৬ ধরে দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম ।
ছোট রাস্তায় তীর চিহ্ন দিয়ে লেখা , শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাসভবন। ঢুকে পড়লাম। সরু রাস্তা চার দিকে গাছ-গাছালি, পুকুর, ছোট ছোট বাড়ি, দোকান । গ্রাম বাংলার মন ভরানো ছবি। আধুনিকতার তেমন একটা ছাপ নেই । মনে সন্দেহ আমরা ঠিক পথে চলছি তো! এত নির্জন পাড়া গা! এখানেই কি দিকপাল অমর সাহিত্যিকের বাড়ি!! এই অজ পাড়াগাঁয় ----!
তবে পথে মাঝে মাঝেই দিক
নির্দেশ দেওয়া আছে, আছে
সাহিত্যিক শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের
স্ট্যাচু। তবুও------একটু যেন খটকা ----!!
ভাবতে ভাবতেই সরু পাকা রাস্তা ধরে এসে পৌঁছলাম একেবারে সামনে, ওই তো লাল প্রাচীর দিয়ে ঘেরা, সামনে শ্বেত পাথরের ফলকে লেখা (নেম-প্লেট)),"শরৎস্মৃতি মন্দির"। সেখানে মহেশ গল্পর কিছু উদ্ধৃতিও লেখা আছে। গেটের সামনে রাস্তা তো নয়, গলি বললেও চলে।
গলির ডান হাতে সাহিত্যিকের বাড়ি। আর গেটের
মুখোমুখি ছোট্ট পুকুর, কচুরিপানা
ও আছে। বাঁধানো ঘাট। তেমন একটা সংরক্ষিত নয়।
গ্রামের প্রায় শেষ প্রান্তে এই বাড়ি। জানা গেল শরৎচন্দ্র জেলে জাতীয় নানা
নিচু জাতির সাথে ওঠাবসা করতেন তাই তাকে এক
ঘরে করা হয়েছিল। হয়তো বা সে কারণেই একেবারে শেষ সীমানায় রূপনারায়ণের ধারে
গৃহ করতে হয়েছিল। এই এলাকার নাম দেওয়া
হয়েছিল সমতা বেড়।
মাঝারি মাপের লোহার গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়েই থমকে
দাঁড়ালাম, পা দুটো স্তব্ধ হয়ে গেল।
এইতো তীর্থস্থান! ছোট্ট রাস্তাটি হাত দিয়ে ছুঁয়ে মাথায় ঠেকালাম। মন্দিরের
প্রবেশের মুখে এমনটাই তো করতে হয়।
তপোবন!! চারিদিকে সুসজ্জিত
গাছ, ছোট বড়। গেট থেকে বাড়ির বারান্দা প্রায়
৯/১০মিটার। বাঁদিকে দু কদম গিয়েই বাগানের
ভেতরে ধবধবে সাদা মর্মর মূর্তি, লেখকের
নাম তারিখ লেখা। সামনে দাঁড়াতে, আপনিই হাত
দুটো জড়ো হল।
কি অসাধারণ সৃষ্টি এই মানুষটির ! কি
অপরিসীম শক্তি তাঁর লেখনীর।
সোজা গিয়ে ৩ ধাপ লাল সিঁড়ি বেয়ে খোলা বারান্দায় উঠলাম। দোতলা বাড়ি, লাল টালির ছাদ লাল সিমেন্টের মেঝে। অনেকটা জায়গা জুড়ে বাড়ি, চারিদিকে সবুজ গাছ-গাছালি, ছবির মত। কত রকমের যে গাছ! বারান্দায় বাঁদিকে বসে এক বৃদ্ধ, বোধ করি দৃষ্টি শক্তি দুর্বল,পাশে অল্পবয়সী এক যুবক। আমাদের উপস্থিতি বুঝতে পেরেই বৃদ্ধ গড়গড় করে বলতে লাগলো, বাঁ দিকে কোনের ঘরে চলে যান। বাঁদিকের ঘরের সামনে আমরা দাঁড়ালাম। বৃদ্ধ তার নিজের জায়গায় বসেই গড়গড় করে বলে যাচ্ছেন, আমরা দেখছি মন্ত্রমুগ্ধের মত।
এই ঘরেই তিনি বসে লিখতেন, চেয়ার
টেবিল আজও সাজানো। আরাম কেদারায় তার একটি ছবি, চন্দন
চর্চিত ফুলের মালা পরানো। দেওয়ালে কাঠের
তাকে রাখা আছে কিছু কাগজপত্র। এমনকি তার ব্যবহৃত হাতের লাঠিটি পর্যন্ত
রাখা। ছোট্ট ঘরটির দেয়ালের ঠিক মাঝখানে, লোহার শিক
দেওয়া উপর নিচ একটি লম্বাটে জানালা। এখান থেকে রূপনারায়ণ দেখা
যেত। এখন অবশ্য নদী অনেকটা সরে গেছে। এই চেয়ারটিতে বসেই কথাশিল্পী ধ্যানমগ্ন হতেন, হাতে
থাকতো কলম, কালির আঁচড়ে ভরে উঠতো পাতার
পর পাতা, সৃষ্টি হতো উপন্যাস। এই ঘরটিই, পথের দাবী, মহেশ, কমললতা, পল্লীসমাজ, রামের
সুমিত, বিরাজ বৌ এর মত আরও অনেক উপন্যাসের
আঁতুড় ঘর বলা যেতে পারে ।
এবার ঠিক তার পাশের ঘরটির সামনে দাঁড়ালাম, দরজার সামনে কাঠের পাটাতন, যাতে কেউ প্রবেশ করতে না পারে। এবার অল্পবয়সী যুবকটি এগিয়ে এলো সব চিনিয়ে দিল। এটি বৈঠকখানা, ভেতরে একটি বেশ বড়সড় চৌকি তোষক পাতা, ওপরে সাদা চাদর , কিছু চেয়ার, ১০০ বছরের পুরনো দেয়াল ঘড়ি আজও টিকটিক করে ঠিক ঠিক সময় বলে যাচ্ছে। এই ঘরটিতেই মিটিং হত। এসেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, বাঘা যতীন, রাসবিহারী বসু, বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী। রূপনারায়ণ নদীপথে নৌকো করে তারা আসতেন। আরও আরও অনেক বিপ্লবীরা আসতেন।
এবার পাশের ঘরটির সামনে
দাঁড়ালাম। এটিতে কিছু বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম, হুঁকো, জলচৌকি, আলমারি।
এখানে তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন বিনি পয়সায়। এরও পাশের ঘরটি বারান্দার
ডানদিকের কোণের ঘরটি তে অপেক্ষা করছিল আরেক বিস্ময়। জানালার সামনে গিয়ে
দাঁড়ালাম। চোখের সামনে ছোট্ট সিংহাসনে ধবধবে সাদা পাথরের রাধা কৃষ্ণর মূর্তি তার
সামনে ধূপ ধুনো প্রদীপ এবং এক পুরোহিত উপবিষ্ট। উনি বললেন, চিত্তরঞ্জন দাস কারাবন্দী
হবার আগে এই মূর্তি দুটি কথা সাহিত্যিককে দিয়ে গিয়েছেন। এই মূর্তি দুটি লেখক
নিজে হাতে পুজো করতেন। এখনো নিত্য পুজো চলে আসছে। প্রণামীর থালায় কিছু প্রণামী
দিয়ে গেলাম ভেতর উঠোনে।
ভেতর উঠোনের মাঝে বিরাট
ধানের গোলা। ধানের গোলা আমি আগে কখনো দেখিনি। প্রথমে বিস্মিত হই এটি কি! দরজা নেই
জানালা নেই একটি ঘর! এ কেমন ঘর! পরে জানলাম এটি
ধানের গোলা। বারান্দার পাশ দিয়ে দোতালায় ওঠার সিঁড়ি, সবটাই লাল
সিমেন্টের। দোতালায় গেলাম। আহা মন ভরে গেল। এখান থেকে ডানদিকে রূপনারায়ন বেশ অনেকটা দেখা যায়। সত্যিই এমন মনোরম পরিবেশ! এমন পরিবেশেই তো হতে
পারে কালজয়ী সৃষ্টি। বারান্দার কোণে বড়সড় খাঁচা,অল্প
কিচিরমিচির শোনা গেল বৈকি।
দোতলার এই বারান্দা থেকে
তাকালাম সামনে, চমৎকার
দৃশ্য। সামনের পুকুরটা আগে আরও বড় ছিল অনেকেই আসত স্নান করতে। এখন তেমন ব্যাবহার
হয় না। এই পুকুরেই নাকি ছিল লেখক এর পোষা কার্তিক গণেশ দুটি মাছ। তাদের চিনবার জন্য নাকি তাদের নাকে সোনার লোক পরিয়ে দিয়েছিলেন লেখক । রোজ
দুপুরে মাছদের কে খাবার দেবার সময় তিনি নাম ধরে ডাকতেন, "কার্তিক
গণেশ "। দুটো মাছই ভেসে উঠতো।
এই পুকুর গাছ গাছালি মনে
করিয়ে দেয় পল্লী সমাজের কথা, মনে
করিয়ে দেয় বিরাজ বউয়ের নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার কথা, মনে পড়ে
যায় রামের সুমতির কথা।
বাগানের কোণে একটি পেয়ারা
গাছের গুড়ি ধীরে ধীরে মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে। মনে করা হয় এই পেয়ারা গাছটিই
রামের সুমতি তে তিনি অমর করে রেখেছেন।
চারিদিকে গাছে গাছে ভরা
প্রায় জঙ্গলাকীর্ণ পরিবেশ । মনে হয় এখানেই কোন না কোন কোনে ছিল গফুরের
জীর্ণ কুটির, চোখের
সামনে ভেসে ওঠে মহেশের হাড় জিরজিরে
চেহারা। দুমুঠো খাবার জন্য এই মাঠে ঘাটেই হয়ত ঘুরে বেড়াতো।
দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে
ভাবতে ভাবতে কোন ভাব সাগরে ডুবে যাচ্ছিলাম। ঝিরঝিরি ঠাণ্ডা হাওয়ায় শরীর শীতল
হচ্ছিল। ইন্দ্রনাথের বাঁশী তে
রামপ্রসাদী সুর যেন ভেসে বেড়াচ্ছে । হুঁশ ফিরল এবার তো ফিরতে হবে। ফিরতে কি আর মন
চায়? আহা এমন সবুজে সবুজে ঘেরা! আরও খানিকক্ষণ যদি থাকা যেত! একেবারে নিরিবিলি, চারিদিকে
বাড়িঘর নেই বললেই চলে। দুচোখ ভরে তাকিয়ে
তাকিয়ে দেখি, মন যেন আর ভরে না, তবু ফিরতে তো হবেই।
জীবনের শেষ বারটি বছর এখানে
কাটান শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এই গ্রামে
তার বড় দিদি অনিলা দেবীর বাড়ি। দিদির কাছাকাছি থাকবেন বলেই ভবঘুরে
সাহিত্যিক এখানেই বাড়ি বানান।
এই অনিলা দেবীর ছদ্ম নামেই
লেখক প্রথমে লিখতেন।
বাড়িতে ঢুকতে কোন টিকিট
লাগেনা। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ওনার বংশধরেরা দুজন লোক রেখে দিয়েছেন। আটাত্তরের
বন্যার সময় অনেক কিছু নষ্ট হয়ে যায়, সরকারি
তরফ থেকে আবার মেরামত করা হয়।
লাল প্রাচীরে ঘেরা প্রান্তিক বাড়ি টির দিকে আরেক বার হাত জোড়
করলাম।
এবার লোক থৈ থৈ শহরে ফিরে যাবার পালা।
লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
লেখিকার পরিচিতি -
স্টেটস্ম্যান, সুখবর, সকালবেলা ইত্যাদি খবরের কাগজে গল্প প্রকাশিত হয়েছে। প্রসাদ, সারথি পত্রিকায় গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ লেখেন। 'Times of India'-তে বেশ কয়েকবার কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। কবিতা দিয়ে সাহিত্য জীবনের শুরু।বর্তমানে কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য গল্প লিখতেই বেশি ভাল বাসেন । বহু e magazine এ লেখেন ।