মন্দিরময় এ দেশ ভারতবর্ষ। এই দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বহু প্রাচীন এবং পবিত্র মন্দির। এগুলির মধ্যে কিছু মন্দির আবার আভিজাত্য,কৌলীন্যর কারণে গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু এদের বাইরেও এমন কিছু মন্দির রয়েছে,ঐতিহাসিক গুরুত্ত্ব, শিল্পশৈলীর বিচারে এগুলির গুরুত্ত্বও কিছু কম নয়। আবার ধর্মীয় কারণেও এই মন্দিরগুলির মাহাত্ম্য কম নয়। স্থানীয় মানুষজনেরা এই মন্দিরগুলিকে অত্যন্ত জাগ্রত বলেই মনে করেন ।
আবার শুধু মন্দির-ই নয়, এর আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বেশ কিছু অপূর্ব নৈসর্গিক
সৌন্দর্যমন্ডিত স্থান ।
তেমনই এক মন্দির হল মা রঙ্কিণী দেবীর
মন্দির ।
ঝাড়খণ্ডে তো বটেই,বিহার পশ্চিমবঙ্গ,ওড়িশা
থেকেও বহু মানুষ,বহু
ভক্ত পুজো দিতে আসেন ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূম জেলার ঘাটশিলা লাগোয়া জাদুগোড়ায়
অবস্থিত এই মা রঙ্কিণী দেবীর মন্দিরে। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী এই মন্দিরে কখনও
কাউকে খালি হাতে ফেরাননা । বহু মানুষেরই মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে এখানে মানত করে বা
পুজো দিয়ে ।
অমর কথা সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের
লেখা ‘রঙ্কিণী দেবীর খড়গ‘ গল্পটি আজও অনেকের গায় কাঁটা দেয় ।
বর্তমান রঙ্কিণী দেবীর মন্দিরটি বিরাজ করছে
ঘাটশিলা থেকে ৪-৫ কিমি দূরে রাতমোহনা থেকে প্রায় ৩০-৪০ মিনিটের পথ গেলে জাদুগোড়ায়
যে পাহাড় আছে সেই পাহাড়ে ।
মা রঙ্কিণী দেবী মা কালীর এক
অবতার এবং প্রধানত পূর্ব ভারতের বিভিন্ন
উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে এক অত্যন্ত জাগ্রত দেবী বলে পরিচিতা । শুধুমাত্র
ভূমিজ উপজাতির মানুষই এই মন্দিরে পুরোহিত
হতে পারেন । এখানকার মানুষজন প্রতিদিন পরম ভক্তি ভরে এই দেবীকে পুজো করেন ।
দূর্গাপুজো,কালীপুজোর
সময় এখানে মেলা বসে যায়। হাজার হাজার
মানুষ তখন এখানে পুজো দিতে আসেন।
জনশ্রুতি অনুযায়ী মাতা রঙ্কিণী এখানে এই
জঙ্গলে অধিষ্ঠান করতেন। একদিন এক স্থানীয় আদিবাসী একটি মেয়েকে দেখেছিলেন এক
রাক্ষসকে হত্যা করতে, কিন্তু
এই দৃশ্য দেখে তিনি মেয়েটির খোঁজ করতে গেলে অবাক করা এক কাণ্ড ঘটে, অনেক চেষ্টা করেও তিনি মেয়েটির আর দেখা পান নি । সেই
রাতেই ওই আদিবাসী মানুষটিকে দেবী রঙ্কিণী স্বপ্নাদেশ দিয়ে বলেন ,ওখানে দেবীর একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে। সেই মতো
পাহাড়ের গুহায় এই মন্দির নির্মাণ করা হয়। যদিও ঠিক কোন সময় মূল মন্দিরটি নির্মাণ
করা হয়েছিল তা সঠিক জানা যায় না,তবে
বর্তমান যে মন্দিরটি রয়েছে সেটি নির্মিত হয়েছে ১৯৫০ সালে। এর আগে তৈরি প্রাচীন
মন্দিরটি এখনও রয়েছে ঘাটশিলা ষ্টেশনের কাছেই।
দক্ষিণ ভারতীয় শিল্পশৈলীতে এই মন্দিরটিতে
যাওয়ার পাহাড়ি পথটিও বেশ রোমাঞ্চকর। রাস্তার একধারে মন্দির,আর অন্যধারে রয়েছে মানত করার গাছ,এই গাছে লাল কাপড়ে নারকেল বেঁধে ভক্তরা মনস্কামনা জানান।
মন্দিরের অভ্যন্তরে দক্ষিণ ভারতের মন্দিরগুলির মতো গোপুরম রয়েছে। এই গোপুরমে দেবী
রঙ্কিণীর বিভিন্ন রূপ চিত্রিত হয়েছে। মন্দিরের প্রবেশদ্বারের ঠিক উপরেই দেবী
দুর্গার মহিষাসুর বধের দৃশ্য খোদাই করা আছে। রয়েছে আরও বহু দেবদেবীর মূর্তি। এখানে
একটি পাথরকে দেবী রূপে পুজো করা হয়। মূল মন্দিরের বাঁ দিকে গণেশ মন্দির আর ডান
পাশে শিব মন্দির।
কেউ
কেউ আবার বিশ্বাস করেন মা রঙ্কিণী দেবী দুর্গারই এক অন্য রূপ। শোনা যায় সুপ্রাচীন
এই মন্দিরে একসময় নিয়মিত নরবলি হত। ইংরেজ শাসন ব্যবস্থায় তাদেরই হস্তক্ষেপে সেই
কুপ্রথা বন্ধ হয় । তারপরই ঘাটশিলা চক্কর থেকে সরিয়ে এই নির্জন বনাঞ্চলে এই গুহায়
মন্দির নির্মাণ করা হয়।
রঙ্কিণী
মন্দিরের কাছে থাকার জায়গা তেমন নেই। তবে এই মন্দির থেকে সামান্য দূরত্বে রয়েছে
বেশ কয়েকটি অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত স্থান । এই সব স্থানে থেকেই ঘুরে
নেওয়া যায় রঙ্কিণী মন্দির । একইসাথে বেড়ানোর আনন্দ এবং তীর্থ,এককথায় রথ দেখা কলা বেচা, দুটিই
একসাথে হয়ে যায় সেক্ষেত্রে । এই রকম দু- একটি স্থানের নাম দেওয়া হল ।
শঙ্করদা পোটকা-
রঙ্কিণী মন্দির থেকে সবচেয়ে কাছের একদম আনকোরা নতুন এক পর্যটন কেন্দ্র। রঙ্কিণী
মন্দির থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৮ কিমি। চারদিকে পাহাড়, জঙ্গলের মাঝে এক অনাবিল সবুজের দেশ এই শঙ্করদা পোটকা ।
নামের মাঝেই লুকিয়ে আছে এক আদিবাসী সারল্যের ছাপ । শঙ্করদা থেকে মাত্র ৩-৪ কিমি
দূরে পাহাড় ভাঙা। একদিকে সুবর্ণরেখা নদী , অপর
দিকে পাহাড়ের শ্রেণী, মাঝে
পলাশ,শাল,শিমুল আর পলাশের জঙ্গলে ছাওয়া এই স্থানটি ক্রমেই জনপ্রিয়
হয়ে উঠছে । তবে শঙ্করদা যাওয়ার জন্য সবচাইতে ভালো টাটানগরগামী ট্রেনে এসে টাটানগর
নেমে সেখান থেকে প্রায় ১৮ কিমি দূরে শঙ্করদা গাড়ি নিয়ে যেতে হবে ।
রাতমোহনা
– এখান থেকেও সামান্য দূরত্বে রঙ্কিণী মন্দির। এমনিতে রাতমোহনা নিজের অপরূপ
নৈসর্গিক সৌন্দর্য দিয়েই আকৃষ্ট করতে পারে পর্যটককে ।
এখান থেকে সিদ্ধেশ্বর হিল ও
ফরেস্ট , পাটকিতার পাহাড় ও জঙ্গল রানীফলস, সিদ্ধেশ্বর পাহাড়ের সৌন্দর্য,এক কথায় অসাধারণ। এর সঙ্গেই রয়েছে সুবর্ণরেখা নদীর কিশোরীর চপলতায় বয়ে
যাওয়ার উচ্ছল উপল সৌন্দর্য । রাতমোহনায় রয়েছে একটি সুন্দর ঝর্না।
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি এই রাতমোহনায় সুবর্ণরেখা
নদীর ধারে একটি পাথরের উপর বসে থাকতেন অমর কথা শিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ।
এখানে বসেই তিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর অসংখ্য কালজয়ী উপন্যাস।
রাতমোহনা থেকে রঙ্কিণী দেবীর
মন্দির প্রায় ৪০- ৪৫ মিনিটের পথ। আর এখান থেকে শঙ্করদা মাত্র ৩০ কিমি , গাড়িতে যেতে সময় লাগে প্রায় ৪০- ৪৫ মিনিট, আর সরাসরি রাতমোহনা যেতে হলে টাটানগরগামী যেকোনোও ট্রেনে
এসে নামতে হবে ঘাটশিলা ষ্টেশনে,এখান
থেকে অটো বা গাড়িতে মাত্র ৫ কিমি পথ
রাতমোহনা ।
হাতে সময় ও ইচ্ছে থাকলে একই
সঙ্গে ঘুরে নিতে পারেন ঘাটশিলার জনপ্রিয় স্পট,যেমন
বুরুডি লেক,গালুডি
ড্যাম,বিভূতিভূষণের বাড়ি,ফুল ডুংরি টিলা পাহাড় প্রভৃতিও।
থাকা খাওয়া-
যেহেতু রঙ্কিণী মন্দিরের আশেপাশে থাকার তেমন ব্যবস্থা নেই , তাই শঙ্করদা বা রাতমোহনা অথবা ঘাটশিলা থেকে ঘুরে নেওয়াই
শ্রেয় ।
শঙ্করদাতে থাকা খাওয়ার জন্য আছে
উইক এন্ড রিসোর্ট ( ফোন- ০৯২৩৪৬৪৩৫৪০, ০৮৭৫৭৭৮০৯১০
) এখানে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে ।
রাতমোহনাতে থাকার
জন্য আছে রিসোর্ট –
রাতমোহনা ইন (ফোন – ০৮৪০৯২১১৫৫৫
) একদম সুবর্ণরেখা নদীর ধারে অবস্থিত এই রিসোর্টে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে ।
আর ঘাটশিলাতে থেকে ঘাটশিলার
স্থানীয় স্পট গুলি ঘুরতে ঘুরতেও দেখে নেওয়া যায় এই রঙ্কিণী মন্দির। ঘাটশিলাতে
থাকার জন্য আছে হোটেল জে.এন.প্যালেস ( ০৮৭৫৭৪৪৩৫৪০ , ০৯২৩৪৬৪৩৫৪০),সুহাসিতা
রিসোর্ট ( ০৯৭৭১৮৩১৮৭৭ ) রামকৃষ্ণ মঠ গেস্ট হাউস প্রভৃতি ।
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
ছবি - সংশ্লিস্ট সংস্থার সৌজন্যে