Advt

Advt

kiriteswari-mandir-travel-vramon-feature-by-biswajit-chakraborty-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-কিরীটেশ্বরী-মন্দির-ভ্রমণ-বিশ্বজিৎ-চক্রবর্তী

kiriteswari-mandir-travel-vramon-feature-by-biswajit-chakraborty-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-কিরীটেশ্বরী-মন্দির-ভ্রমণ-বিশ্বজিৎ-চক্রবর্তী

পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের অন্যতম প্রাচীন এবং এক পবিত্র হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম তীর্থস্থান হল এই মুর্শিদাবাদ জেলার " কিরীটেশ্বরী মন্দির " । হিন্দুদের পবিত্র একান্ন সতী পিঠের অন্যতম এই কিরীটেশ্বরী মন্দির। বলা হয় এখানে সতীর মুকুট বা কিরীট পড়েছিল।

মুর্শিদাবাদের নবগ্রাম ব্লকে অবস্থিত এই মন্দিরের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। এই মন্দিরের নাম পাওয়া যায় ভবিষ্যপুরাণে। কারও কারও মতে গুপ্ত যুগেও এই মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল । তখন এর নাম ছিল কিরীটকনা। বর্তমানেও অবশ্য এই গ্রাম কিরীটকনা নামেই পরিচিত। যেহেতু এখানে সতীর কিরীট পড়েছিল, তাই দেবী এখানে কিরীটেশ্বরী।

কিংবদন্তী অনুসারে,একদিন এক শাঁখা বিক্রেতা এখানে মন্দির নিকটস্থ এক জলাশয় থেকে জলপান করতে গিয়েছিলেন। তিনি পুকুরের কাছে পৌঁছতেই দেখতে পেলেন পুকুরের জলে এক অসামান্য রূপসী কন্যা স্নান করছেন। সেই কন্যা শাঁখা বিক্রেতার কাছে তাঁর পরার জন্য শাঁখা কিনতে চাইলেন। শাঁখা বিক্রেতা কন্যাটির দুই হাতে শাঁখা পরিয়ে দিয়ে শাঁখার মূল্য চাইলে কন্যা বলেন, তাঁর পিতা,যিনি কিরীটেশ্বরী মন্দিরের একজন সেবায়েত,তিনি শাঁখার মূল্য দেবেন। কন্যাটি এও জানান যে সেবায়েতের ঘরের কোথায় অর্থ রাখা আছে। সেই কথামত শাঁখা বিক্রেতা সেবায়েতের কাছে গিয়ে শাঁখার মূল্য চাইলে সেবায়েত তো রীতিমতো চমকে উঠলেন। তিনি শাঁখা বিক্রেতাকে প্রতারক ভেবে বকাবকি করতে শুরু করলেন। তখন শাঁখা বিক্রেতা সেবায়েতকে জানালেন কন্যাটি তাঁকে এও জানিয়েছেন যে সেবায়েতের ঘরের কোথায় অর্থ রাখা আছে। শাঁখা বিক্রেতার কথামতো সেবায়েত ঘরে ঢুকে দেখতে পেলেন যে ঠিক সেই স্থানেই শাঁখার মূল্য রাখা আছে। সেবায়েত এবার আরও বিস্মিত হলেন। কারণ সেখানে খানিকক্ষণ আগেও কোনও অর্থ রাখা ছিল না। তাহলে এই অর্থ এখানে এলো কীভাবে ?

কিন্তু তাতেও তাঁর পুরোপুরি সংশয় কাটেনি। কারণ তিনি খুব ভালো করেই জানেন তাঁর কোনও কন্যাই নেই। তাহলে শাঁখা বিক্রেতা যে কন্যাকে শাঁখা পরিয়েছেন তিনি কে বা সত্যি-সত্যি কার কন্যা?

শাঁখা বিক্রেতা পড়লেন আর এক সমস্যায়। কীভাবে তিনি তাঁর কথার সত্যতা প্রমাণ করবেন এই ভেবে তিনি আকুল হয়ে পড়ে মায়ের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন। সেবায়েত এবং শাঁখা বিক্রেতা দুজনেই তখন সন্দেহ নিরসনের জন্য সেই পুকুরের পাড়ে গিয়ে উপস্থিত হলেন। আর কি আশ্চর্য,হঠাৎই তাঁরা দুজনই দেখতে পেলেন পুকুরের একেবারে মাঝখানে, গভীর জলের মধ্য থেকে জেগে উঠেছে  অপরূপ সুন্দর,জ্যোতির্ময়ী দুটি হাত ,আর সেই দুটি হাতে পরা দুটি নতুন শাঁখা।

আবার আর একটি কাহিনীও আছে এই মন্দির নিয়ে। নাটোরের রানী ভবানীর সুন্দরী কন্যা তারা কুনজরে পরেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার । সিরাজ তারাকে বলপূর্বক ধরে আনার জন্য তার গৃহে হানা দেন । কিন্তু হঠাৎই ঠিক সেই মুহূর্তেই তারা আক্রান্ত হয়ে পরেন বসন্ত রোগে । বাধ্য হয়ে ফিরে যেতে হয় সিরাজের লোকজনের। আশ্চর্যের বিষয়, সিরাজের বাহিনী ফিরে যেতেই অলৌকিক ভাবে তারার শরীর থেকে উধাও হয়ে যায় বসন্তের সব চিহ্ন। অনেকেই মনে করেন মা কিরীটেশ্বরীর আশীর্বাদেই নাকি এই অসম্ভব বিষয়টি সম্ভব হয়েছিল।

মন্দিরের পাশেই রয়েছে একটি বিরাট জলাশয়।

কারও কারও মতে এই মন্দিরের জন্য প্রয়োজনীয় জমি দান করেছিলেন মুঘল সম্রাট আকবর। এখানে শিলা-রূপী দেবীকে পুজো করা হয়। মূল মন্দিরটি ছিল বর্তমান মন্দিরের পাশেই। সেই মন্দির বিনষ্ট হলে সম্রাট আকবরের সময়কার কানুনগো ভগবান রায় শিলা বিগ্রহকে স্থানান্তরিত করে অন্য একটি মন্দির গড়ে সেখানে স্থাপন করেন। কিন্তু সেই মন্দিরও বিনষ্ট হয়ে গেলে নাটোরের রানী ভবানী দৈবাদেশ পেয়ে এখানে পঞ্চমুন্ডির আসনে সেই শিলাকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

এখানে এই পঞ্চমুন্ডির আসনে বসে দীর্ঘ সময় ধরে তপস্যা করেছিলেন রানী ভবানীর দত্তক পুত্র রাজা রামকৃষ্ণ রায়।

বর্তমান মন্দিরটি বাংলা ১৩৩৭ সালে পুনঃ-সংস্কার  করেন লালগোলার মহারাজ যোগেন্দ্র নারায়ণ রায়। এই কাজের প্রধান উদ্যোক্তা এবং তত্বাবধায়ক ছিলেন নেহালিয়ার জমিদার রায় সুরেন্দ্র নারায়ণ সিংহ । এখানে শিলাকে দেবী রূপে পুজো করা হয়। স্থাপিত কষ্টিপাথরের শিলার ওপরে যে চিত্র রয়েছে তাকে তন্ত্র মতে যন্ত্র বলে বর্ণনা করা হয় । এই শিলার ওপরে চিত্রিত করা আছে দেবীর ত্রিনেত্র, জিহ্বা। এই মন্দিরের কাছেই রয়েছে গুপ্ত মন্দির। সেখানেই রয়েছে দেবীর আসল মূর্তি। কিরীটেশ্বরী মন্দিরে দেবী হলেন বিমলা। আর তাঁর ভৈরব হলেন সমবর্ত । ইনি দেবীর বাঁ দিকে অবস্থান করেন।

পৌষ মাসের চারটি মঙ্গলবার দুপুর ১ টা থেকে সন্ধ্যা অবধি প্রকৃত মূর্তি দর্শন করা যায়। তবে রোজই এখানে অনেক ভক্ত পুজো দিতে আসেন। মানত করে পাঠা বলিও হয়। অমাবস্যা তিথিতে এবং কালীপুজোর সময় বিশেষ পুজো হয়।

কিরীটেশ্বরী মন্দিরের নিকটবর্তী রেল স্টেশন হল আজিমগঞ্জ। তবে বেশিরভাগ পর্যটক মুর্শিদাবাদ থেকেই ঘুরে নেন। এতে একদিকে যেমন মন্দির দর্শনের পুণ্য লাভ হয় আবার অপরদিকে হাজার দুয়ারী , কাটরা মসজিদ, কাঠগোলা বাগান ও মিউজিয়াম , জগত শেঠের বাড়ি ও মিউজিয়াম , নসীপুরে দেবী সিং - এর প্যালেস ও মিউজিয়াম ইত্যাদি দ্রষ্টব্য গুলোও একসাথে ঘুরে নেওয়া যায়।

সেক্ষেত্রে কলকাতা থেকে হাজার দুয়ারী এক্সপ্রেস, শিয়ালদা স্টেশন থেকে ভাগীরথী এক্সপ্রেস অথবা লালগোলা প্যাসেঞ্জার ট্রেনে এসে নামতে হবে প্রায় ১৯৭ কিমি দূরের মুর্শিদাবাদ ষ্টেশনে।

থাকা খাওয়া --- কিরীটেশ্বরী মন্দিরের কাছাকাছি তেমন হোটেল নেই। সেক্ষেত্রে থাকতে হবে মুর্শিদাবাদেই। মুর্শিদাবাদে একদম হাজার দুয়ারীর কাছেই রয়েছে হোটেল অন্বেষা এবং হোটেল হিস্টোরিকাল ( দুটিরই ফোন নম্বর ৯৪৩৪১১৫৪৭০ ) , হোটেল ফ্রেন্ডস এবং হোটেল পাপিয়া ( এই দুটিরও ফোন -- ৯৭৩২৬০৯০৮৪ ) , হোটেল যাত্রিক ( ৯৭৩৩৯৭৫০২৪ , ৬২৯৬৫১৯৭৩৯ )

ঐতিহাসিক স্থান ঘোরাঘুরি করার জন্য প্রয়োজন হয় অভিজ্ঞ গাইডের । গাইডের জন্য প্রয়োজনীয় যোগাযোগ করতে পারেন ৯৭৭৫৮৫৬৭০৫ , ৯৪৭৫০৬৪৮৮৯ প্রভৃতি নম্বরে  ।

লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

লেখক পরিচিতি -

জন্ম কলকাতায়। দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতা করেন। সাপ্তাহিক বর্তমানে ভ্রমণ নিয়ে নিয়মিত লেখেন। বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে এবং তথ্য সংগ্রহে আনন্দ পান ।    

ছবি - সংশ্লিস্ট সংস্থার সৌজন্যে