৩য় ও শেষ পর্ব
"ধর্মভাবের
উদ্দীপনাতেও নহে, রাজার সন্তোষের জন্যও, কেবল
সাধারণের অবসর রঞ্জনের জন্য গান রচনা বর্তমান বাংলায় কবিওয়ালারই প্রথম প্রবর্তন
করেন।"
আমি যদি পরী কৃষকের ঘরে
জন্মাতাম, কিংবা মাঝি মালো কর্মকার বা
তন্ত্রবায়ের মরে, আর আমার যদি থাকত সহজাত
কবিত্বশক্তি, তাহলে আমি বড়. জোর একটা
কীর্তনের বা পাঁচালির দল খুলতাম, অথবা
কবিয়াল রূপে গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে বড় হতাম। সমাজের প্রতিকূল পরিবেশই আমাকে
প্রতিহত করতো, আমার এর চেয়ে বেশি কিছু
সম্ভাবনা ছিল না। আমি জানি অনেক সম্ভাবনীয়তার কুঁড়ি-ই এভাবে অকালে ঝরে যায়, ফুল হতে
পারে না। দেখেছিও তেমন মানুষ দু-দশজন।"
" যাত্রা, পাঁচালী, কথকতা, কবিগান, কীর্তন
মুখরিত করে রেখেছিল সমস্ত বাংলাদেশকে। লোকসংগীতের এত বৈচিত্র্য আর কোনও দেশে আছে
কিনা জানি না।
"আমি হইনি
সর্বত্রগামী। আমি কান পেতে আছি তার লাগি যে আছে মাটির কাছাকাছি। যখন নমঃশূদ্র, জুতার মুচি, ভূঁ ইমংলী
প্রভৃতি কুলে উৎপন্ন বাউলদের কথা ও রচনা দেখি তখন আমাদের মনে হয় এমন সব কথা বলিতে
পারিলে আমরাও ধন্য হইতাম। ইহাই খাঁটি, শাশ্বত ও
সার্বভৌম প্রসাহিত্য। আধুনিক এ দেশি কৃত্রিম গান-সাহিত্যগুলি তো বিদেশের উচ্ছিষ্ট
ও অধম অনুকরণ মাত্র। ভারতীয় চৌষট্টি কলার অনেক কলাই আর্যপূর্ব সংস্কৃতির। গান
বাদ্যকে পুরাণে নারী ও শূদ্রদের বিদ্যাই বলিয়াছে (রবীন্দ্রনাথের" কবি
সঙ্গীত" প্রবন্ধ থেকে, সমুদ্র বিশ্বাস ২০১৬-১৭)।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে
রবীন্দ্রনাথ ও হরিচরণ সমসাময়িক অর্থাৎ ১৮৬১ হতে ১১৪১ সালের মধ্যে দুজনের জীবনীই
বাধা । রবীন্দ্রনাথ বাঙলার ইংরেজ শাসনের সর্বোচ্চ মহানগর কলকাতাতে জন্মেছেন।
হরিচরণের জন্ম হত গৌরব মুঘল সাম্রাজ্যের বাণিজ্যের সবচাইতে বন্ড, বন্দর
ঢাকা শহরের উপকণ্ঠে নরসিংদী গ্রামে।
রবীন্দ্রনাথ শৈশব ও
বাল্যকালে বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় উদাসীন। সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবার, তাই
বাড়ীতে নানা বিষয়ের শিক্ষকের কাছে পাঠ নিতেন। জমিদারীতে বাঙলার ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে
যাওয়া ও থাকার সুযোগ ছিল, বিদেশেও গিয়েছেন বিদ্যার্থী
হতে। প্রকৃতি ডাকতো, সহজাত কবিত্ব থাকায় ছোট ছোট
কবিতা লিখত, গাইত আঁকত। বয়স্করা হতাশ হয়ে
বলেছিলেন- আমাদের রবিটার কিছু হল না। বড় শহর দিশি বিদেশি মানুষের মেলা, ভাষার
সংযোজন শিল্প কলার কৃষ্টির আসরে জমজমাট। রবীন্দ্রনাথের মনের আকাশ ছড়াতে রইল। তাই
গোঁড়ার জীবনে বয়স্কদের হতাশা ভ্রান্ত করে রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে
সর্বত্র চরণচারী, চরণাঙ্কিত হয়ে উঠলেন।
ছোট্ট হরিচরণেরও পাঠশালার
শিক্ষা সুখপ্রদ ছিল না। আচার্য রক্ষণশীল পণ্ডিত পরিবারের ছেলে। বাড়ীতে বা অন্যত্র
আয়োজিত পাঠের ও গানের আসরে আর সকলের মত থাকতো। ওখান থেকে যা ভালো লাগতো তারই উপর
গান বানাতেন। তাকেও প্রকৃতি ডাকতো, আর সহজাত
কবিত্ব ছিল। নদীর শাখা প্রশাখা ধরে আছে সুদূর প্রসারিত সমতল নিয়ে অগুনতি বিল খাল, দিয়েছে
সুজলা সু-শ্যামলা প্রাকৃতিক শোভা মন ভোলানো কাব্যিক লাচারি আর স্রোতের সাথে ভেসে
যায় গানের সুর। জ্ঞানে ও সংস্কৃতিতে সম্ভ্রান্ত পরিবারে পাঠশালা বিদ্যালয়ের বাইরের
আসরে বসার আসরে গুণীজনের সান্নিধ্য। নানা আসবে নানা ধরণে পরিবেশনের সুযোগ করে
নিলেন।
এই সময় পরিসরে বা পরিসীমাতে
এই দুই পুরুষের দেখা হয়নি। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন সু-চিহ্নিত অঞ্চলে
রাড়-বারেন্দ্র, পদ্মা ধৌত পূর্বাঞ্চলে, বরাক
উপত্যকা এবং ত্রিপুরা-আরাকান অঞ্চলে যেমন শিষ্ট গদ্য পদ্ম লেখকরা সক্রিয় তেমনি লোক
কাব্য সাহিত্য কবিগান রচক ও গায়করাও । কলকাতার রবীন্দ্রনাথ ও ঢাকার হরিচরণ আচার্যও
সুপরিচিত এই সব অঞ্চলে। শহর অঞ্চলে, রবীন্দ্রনাথ
যিনি পরিবারের হতাশা মিথ্যা করে-হঠাৎ সবাই কে চমকে দিয়ে বিশ্ব করিল জয়-হলেন
বিশ্বকবি, অতি বিশিষ্ট। হরিচরণও সম্মান
পেতে থাকলেন আধ্যাত্মিক ভারতীয় বোধিতে, কাব্যিক
প্রাচীন কথ্যভাষার ছন্দ গীতিকবিতায়, সহজাত
সঙ্গীতের সুর তাল মূর্ছনা, পরিবেশনে শব্দের অনুপ্রাস
অনুরণনের সাথে শরীর দোলন এনে দিয়েছে বহু মাননীয় সম্ভাষণ ।
দীর্ঘ জীবনে মিললেন
কুমিল্লার মহেশে কবিগানের লড়াইয়ের আসরে (রবীন্দ্র কুমার দত্ত, ২০১৫)। এই
সাক্ষাৎকারটা নানা বাবে ব্যাখ্যা অনেকে। বিশ্বকবি বিশেষ করে আমন্ত্রিত অতিথি। শেষ
লড়াইটি ছিল আচার্য হরিচরণ ও তাঁর শিষ্য অর্জুন দেবনাথের মধ্যে (জগদীশ চন্দ্র
আচার্য, অগ্নিকুমার আচার্য ও প্রণব বর্ধন ২০১৫)। আচার্যের
"ওজস্বিনী
ভাষার মাধুর্য, ত্রিপদী, ত্রিপদী, চৌপদী, চৌপদী, ভোটকদি তো
ছন্দের প্রাচুর্য, ভাবের গাম্ভীর্য ও
অনুপ্রাসের দ্যোতনায় বিশ্বকবি অভূতপূর্ব ভাবরসে আপ্লুত হয়ে পড়লেন।"
আসন ছেড়ে, দুজনে
আলিঙ্গন আবদ্ধ হয়ে আনন্দাশ্রু নয়নে বললেন-
ভাই হরি, তুমিই করি, বাগদেবীর
বরপুত্র, আমি বিশ্বকবি, আমি কী পারব তোমাদের মতো
মানসের হতে কাব্য রসের ধারায় সপ্তর্ষি রথ ছোটাতে।"
উপসংহারে
এই নিবন্ধে বলেছে"
কথন-কাব্য-গীতি কথা ও কবিতা-গীতি" একটা বাস্তব সাহিত্যের বন্ড, অংশ।
ইতিহাসের পাতা থেকে অকাট্য প্রমাণ এনে দেখানো হয়েছে। লেখক এই প্রমাণগুলিকে
বক্তাদের কথাতেই রেখেছেন ।
তথ্যসূত্র
১) অতুল কৃষ্ণ প্রেক্ষাপট, ভাষার সুর
ভারতের নৃতাত্ত্বিক ও পরিচয়ঃ প্রাগৈতিহাসিক জাতিভেদ। সাহিত্য লোক, কলকাতা, ১৯৮৮।
যাদুঘর, সমাজ ও
জাতিভেদ । সাহিত্য লোক, কলকাতা ১৯৮৮
২) Dinesh
Chandra Das Man's Tryst with Destiny in World and India: Part-A: Food to
Religion. BUUKS, Chennai, 2020.
৩) জ্যোতির্ময় রায়: লোক
কবিয়াল কপিল কৃষ্ণ ঠাকুর, হিমদল রায় ও সমুদ্র বিশ্বাস
গ্লাস। অলংকৃত তীর, লোক কবিগান, ষান্মাসিক, ১৭ বর্ষ
সংখ্যা, অক্টোবর- জানুয়ারি, কলকাতা, ২০১৬-২০১৭।
৪) রবীন্দ্র কুমার দত্ত
বাংলা কবিগান ও কবিয়াল হরিচরণ আচার্য: দীনেশ চন্দ্র সিংহ, অগ্নিকুমার
আচার্য, স্মৃতি চক্রবর্তী, অমিতা চৌধুরী, আশিষ
কুমার বৈদ্য, প্রণব বর্ধন, খেলন দাস
(হালদার), সন্দীপ দেব ও স্বয়ং রবীন্দ্র
কুমার দত্তের ভূমিকা এবং বাংলা সাহিত্যে কবিয়াল ও কবি গানঃ সেকাল-একাল, অক্ষর
পাবলিকেশন্স, আগরতলা, ২০১৫।
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক পরিচিতি –
স্কুল-কলেজ পেরিয়ে উচ্চশিক্ষা পান আই
টি খরগপুর, নেডারল্যান্ডস্ ও
জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ইউ এস এ -তে ।
কর্মক্ষেত্র উত্তর প্রদেশ-এর তরাই অঞ্চলের গ্রাম, ভারত সরকার-এর অধীনে অরুণাচল-এ, (শিলং-এ থেকে), উটি (তামিলনাড়ু), দেরাদুন-এ (উত্তরাখণ্ড) , কৃষি এবং পরিবেশ
মন্ত্রালয়, দিল্লি-তে।
দিল্লির ৩৪ পল্লীর কালীবাড়ির সাথে
যুক্ত আছেন বিগত ৩০ বছর ধরে।
১৯৪৮ সাল থেকেই লেখেন কিন্তু প্রথম প্রকাশন ২০১৫-তে। কবিতা , গল্প, ভ্রমণ কাহিনী ও প্রবন্ধ ছাপতে থাকে দিল্লির
পত্র-পত্রিকাগুলোতে। কলকাতা এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখেন।
প্রথম বই ' অনুভূতি বহুরূপে'। অনেক বই প্রকাশিত
হয়েছে। বর্তমানে দিল্লিথেকে প্রকাশিত ম্যাগাজিন ' কলমের সাথ রঙ' পত্রিকার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত এবং উচ্চপদে আছেন।