সেদিনও এমনই ঝড় জলের রাত ছিল। ঘরের দাওয়ায় বসে ভাবছিল
মুকুন্দ । সরকার থেকে কয়েকজন লোক এসে তাদের সরিয়েও নিয়ে গিয়েছিলো অন্য জায়গায়,সে আর কেকা,তার বউ ,অন্য আরও গ্রামের
মানুষদের সাথে গিয়েছিলো বেশ কিছুটা দূরের একটা পাকা ইস্কুল বাড়িতে,ঝড় আসার আগেই তাদের
পৌঁছে দেওয়া হয়েছিলো সেখানে,খাওয়ার আর জলের ব্যবস্থাও ছিল সবার জন্য,এমনকি ওষুধপত্রও। গ্রামের অসহায় মানুষগুলোও নিশ্চিন্ত
বোধ করেছিলো একটা নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে,যদিও সেটা সাময়িক কারণ ঝড় তো একসময় থেমে যাবে কিন্তু তাদের ঘরবাড়ি,জমিজমা সেসবের ওপর
যে তাণ্ডব চালিয়ে যাবে তার ক্ষতিপূরণ কতদিনে হবে কে জানে,তবুও ওই যে কথায়
বলে না 'জান হ্যাঁয়
তো জাহান হ্যাঁয় '।
প্রাণটুকু ধড়ে থাকলে লড়তে তাদের গ্রামের মানুষেরা
ভয় পায়না। তবে সে বছরের ঝড়ে শেষ পর্যন্ত শেষরক্ষা করতে পারেনি মুকুন্দ,বাকি সবাই প্রাণে
বেঁচে গেলেও,সে তার প্রাণের প্রিয় জীবন-সাথী কেকাকে হারিয়েছিল সেই সর্বনাশা রাতে,রাত্রিবেলা প্রকৃতির
ডাকে সাড়া দিতে ইস্কুলবাড়ির প্রায় লাগোয়া বাথরুমের দিকে গিয়েছিলো,সঙ্গে পাশের ঘরের
রাধা বৌদিও ছিল,বেরিয়ে স্কুল বাড়িতে ঢোকার আগেই মড়মড় করে সংলগ্ন রাধাচূড়া গাছ ভেঙে তার ওপর পড়ে
যায়, রাধা বৌদির
একটি পা শুধু গাছের একটি মোটা ডালের নিচে পড়ায় পা ভাঙলেও প্রাণে বেঁচে যায় সে,কিন্তু কেকাকে যতক্ষণে
বের করা হয় তার আর প্রাণ ছিলনা দেহে।
কেকাকে হারানোর পর থেকেই মুকুন্দ পাথরের মতো হয়ে
গেছে প্রায়, যন্ত্রের মতো নিত্য নৈমিত্তিক কাজ করে,খায় ,ঘুমোয় কিন্তু নিজের ভেতর যেন কোনও সাড় নেই তার,খুব প্রয়োজন ছাড়া
কারো সঙ্গে কথাও বলেনা সে।বড় ভালোবাসার বড় যত্নের সংসার ছিল তার,কেকা ছিল তার ছোটবেলার
সাথী।মুকুন্দর মা রমার সইয়ের মেয়ে ছিল সে,কেকার বাবা মারা যাওয়ার পর তিন মাসের মধ্যে মাও
চলে যায় হঠাৎ করেই, তখন তার মা কেকার সাথে তার বিয়ে দিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসেন। ছোটবেলায় বাপমরা ছেলে মুকুন্দ,মা খুব কষ্ট করে
তাকে মানুষ করেছে,সেই মাকে কেকা অনেক ভালোবাসা দিয়েছিলো,তবে সেই সুখও তার মায়ের সয়নি বেশিদিন,তাদের বিয়ের এক
বছরের মাথায় সেই এক ঝড় জলের রাতেই মা সাপের কামড়ে চলে যায়,ওই দুর্যোগে কোনও
ডাক্তার পায়নি মুকুন্দ,না পেয়েছিলো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার সময় সুযোগ।
কাল নাকি আবার ঝড় আসছে,'নামটাই শুধু বদলে
যায় আঘাতটা সেই একই থাকে বোধহয়',মুকুন্দ ভাবে।দু'হাত জোড় করে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বিড়বিড় করে বলে
" এবার আর কারো ঘর উজাড় যেন না ঠাকুর,প্রাণটুকু থাক।" এবারে মুকুন্দ কিছুতেই অন্য
কোথাও যেতে নারাজ নিজের বাড়ি ছেড়ে,যারা তাদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছিল তারা খুবই বিরক্ত এই গোঁয়ার লোকটিকে
নিয়ে,কি করবে
বুঝতেই পারছেনা,মুকুন্দর সাফ কথা " যে জায়গায় গিয়ে আমার কেকাকে হারিয়ে এলাম গত বছর সে জায়গা
আবার কি নিরাপদ,কোথাও যাবনা,মরলে আমি ঘরেই মরবো।" অনেক রাত অবধি দাওয়ায় বসে ঝড়ের আগাম হাওয়ার জোর দেখছিল,বৃষ্টিও পড়তে শুরু
হয়েছে, যত রাত
বাড়ছে বৃষ্টি তত পাল্লা দিয়ে বাড়ছে,রাত আরও নিকষ কালো হয়ে উঠছে, কাল তাহলে কি হবে কি জানি,বেশিরভাগ লোকই নিরাপদ
জায়গায় চলে গেছে,গ্রাম প্রায় ফাঁকা,কিছু লোক যারা রয়ে গেছে কাল ভোরেই তাদের সরিয়ে দেওয়া হবে। মুকুন্দর চোখে একফোঁটা
ঘুম নেই,সে বসে
তার কেকার কথা,মায়ের কথা ভাবছে,হঠাৎ বিদ্যুতের আলো ঝলসে উঠতেই চমকে উঠলো সে,এ কি দেখছে সে? তাদের কঞ্চির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কেকা ! এ কিকরে
সম্ভব? একি তার
চোখের ভুল নাকি সে তার কথা ভাবছে বলে....না না চোখের ভুল কিকরে হবে,আবার ঝলসে উঠলো
বিদ্যুৎ, সে স্পষ্ট
দেখতে পেলো কেকা তাকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে, মোহাচ্ছন্নের মতো সে কেকার পিছনে পিছনে এগোতে লাগলো,হাতের টর্চটা হাতেই
ধরা রইলো তার,কোথায় যাচ্ছে কেন যাচ্ছে কোনও হুঁশ নেই তার,যতক্ষণে তার হুঁশ ফিরল সে দেখল তার সামনে কেকাকে
আর দেখা যাচ্ছেনা, সে খেয়াল করলো সে এসে দাঁড়িয়েছে গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে,জঙ্গলের ধারে,অনাথ কানু বৈরাগীর
কুঁড়েঘরটার সামনে,কানু বেশিরভাগ সময়ই এ গ্রাম ও গ্রামে ঘুরে বেড়ায়,সে পালাগান করে,বেশির ভাগ সময়ই সে গ্রামে থাকেনা,দিন কুড়ি আগে তার
বউ করোনা হয়ে মারা যায়,তখনই বোধহয় সে ফিরেছে।তার আসা যাওয়ার ঠিক নেই বলে আর তার বাড়িটা গ্রামের এক প্রান্তে
হওয়ায় লোকজন তার খবর একটু কমই রাখতো। মুকুন্দ কিছুটা ঘোরের মধ্যে ছিল,একটা বাচ্চার কান্নার
আওয়াজে সে তাড়াতাড়ি টর্চটা জ্বাললো,কান্নাটা কানুর ঘরের দিক থেকে আসছে না? একি! বৃষ্টিতে কানুর ঘরের একটা পাশ চাপা পড়ে,দৌড়ে সেদিকে গেলো
মুকুন্দ। চাপা পড়া ঘরের একটা অংশ থেকে কানুর দুটো পা বেরিয়ে,কোনও রকমে তাকে
বের করলো সে,নাহ ধড়ে প্রাণ নেই আর। কম্পমান পায়ে পাশের ঘরটায় গেলো সে,পাটের দোলনায় শুয়ে
থাকা কানুর ছ'মাসের মেয়েটা তখনও কাঁদছে চিৎকার করে। চোখ থেকে দু'ফোঁটা জল গড়িয়ে
পড়লো মুকুন্দর,মনে মনে সে কেকাকে বললও "তাই তুমি আবার এই ঝড় জলের রাতে ফিরে এলে,এলেই যদি চলে গেলে
কেন",তারপর দোলনা
থেকে কাঁথামোড়া বাচ্চাটিকে বুকে জড়িয়ে ফিসফিস করে বললও "ঝড় আমার যত সর্বনাশই করুক
না কেন তোকে আমি কোনও দিন তোর ক্ষতিটা টের পেতে দেবোনা মা'রে।"
পরের দিন ভোরবেলা যখন বাকি লোকেদের সরাতে গাড়ি এলো,উদ্ধারকারী দলের
লোকগুলো দেখল সেই গোঁয়ার লোকটা একটা বাচ্চা কোলে সবার আগে পুঁটলি হাতে দাঁড়িয়ে,লোকটার মুখে হাসি, চোখে জল।