ধারাবাহিক বড় গল্প
৩য় পর্ব
ম্যানেজার-বাবু আবার বলতে শুরু করলেন....মঙ্গলের মা ললিতার বছর
বছর ভরা পেট কিন্তু তার একটাও বাঁচত না। সেবার একটা মেয়ে হল এবং সে বেঁচেও গেল। তার
পাঁচ বছর পর মঙ্গলের জনম দিতে গিয়ে ওর মা টা মরে গেলো! সবার কোলে কোলে মঙ্গল বেড়ে উঠলো।
আর ওর দিদিটাও বড় হয়ে উঠলো। জানেন,বস্তির জীবন! যত তাড়াতাড়ি মেয়ে পার করা যায় ততই ভালো। চোদ্দ-পনেরো
বছর বয়সেই ওদের বিয়ে হইবে যায়।
ইট ভাঁটার লেবাররা এখানেই
থাকে। ভোর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত খাটুনি চলে। সন্ধ্যে হলেই সবাই নেশায় চুড় হয়ে যায়।
বিরজু কিন্তু তেমন ছিল না। ছেলে-মেয়ে দুটোকে কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজেই সামাল দিতো।
তারপর একবার দেশের থেকে
খবর এলো বিরজুর বাপ মরে গিয়েছে। ছেলেটাকে এখানে রেখে দিয়ে সে মেয়েটাকে নিয়ে দেশে চলে
গিয়েছিল। মঙ্গল অন্য সবার সাথে থেকে গিয়েছিল এখানে। বছর পাঁচেক পর বিরজু মেয়ের বিয়ে
দিয়ে একা ফিরে এসে আবার কাজে যোগ দিয়েছিল।
কিন্তু বছর দুয়েক পর,হঠাৎ একদিন ভাঁটায় কাজ করতে করতে পেটে জনতরনা (যন্ত্রণা) শুরু
হল। সবাই মিলে অনেক চেষ্টা করলাম। মালিক-বাবু শেষে হাসপাতালে পাঠাল বিরজুকে। সুঁই দিলো,জল চালাল তবুও
জনতরনা (যন্ত্রণা) কমলো না। ভোর রাতের দিকে বিরজু মরে গেলো। শেষ সময়ে ওর চোখ দুটো মঙ্গলকে
খুঁজেছিল কিনা জানিনা!
ম্যানেজার-বাবু বলে চললেন……
ততদিনে মঙ্গল কাজ শিখে গিয়েছে। ফর্মায় তৈরি ইটগুলো একটা একটা
করে সাজিয়ে শুকোতে দিতো সেই পাঁচ-বছর বয়স থেকেই। এরপর এটা কর ওটা কর করতে করতে ওইটুকু
বয়স থেকেই ও ভালোই কাজ শিখেছে।
আমার খুব ভালো লাগছিল ম্যানেজার-বাবুর কাছ থেকে ইট ভাঁটার গল্প
শুনতে.......
জানেন ম্যাডাম,ইট ভাঁটার
কাজে পরচুর (প্রচুর) লেবার লাগে। হামেশাই লেবার আসা-যাওয়া করে। বিরজু দেশে চলে যাবার
পর,বিল্লা হরিজন এলো ইট ভাঁটার কাজে। সঙ্গে তিনটে ছেলেমেয়ে। একটা
বিল্লার কাঁধে,আর একটা হাতে! একটা মায়ের হাত ধরে। সবথেকে বড় মেয়েটা রূপমতি
তখন চার-পাঁচ বছরের। এখানে কেউ কেউ দীর্ঘ বছর থাকে,কেউবা কিছুদিন
কাজ করে ছেড়ে চলে যায়। আবার সেই জায়গায় অন্য কেউ আসে।
বিল্লা হরিজনও এলো কাজের জন্য। মালিক-বাবু ওকেও বহাল করলো। বিল্লা
বলল,আমার বউয়ের আবার বাচ্চা হবে। বাচ্চাটা হয়ে গেলে আমরা দুজনেই
এখানে কাজ করবো।
সেই সময় থেকেই মঙ্গল ওদের সঙ্গে মিশে গেল।
একটু বড় হতেই সবাই লক্ষ্য
করতে লাগলো মঙ্গলের সঙ্গে রূপমতির একটা ভালোবাসা তৈরি হচ্ছে। আড়ালে-আড়ালে ওরা মিশতে
শুরু করেছে। ব্যাপারটা আমারও নজর এড়ায়নি।
জানেন,খুব মিষ্টি
স্বভাবের মেয়ে রূপমতি। নিজের কাজটা তো করেই,আবার সবার কাজ কেড়ে নিয়েও করে দেয়। মঙ্গলও একই স্বভাবের। ইট
ভাঁটার সকলেই ওদের খুব ভালোবাসে,পছন্দ করে। ওদের এই ভালবাসা তাই সহজেই সবাই মেনে নিয়েছে।
আমি বললাম,বাঃ খুব ভালো! তারপর কি হল?..
ম্যাডাম,রাত আটটার
মধ্যেই এখানের বস্তি পুরো শান্ত হয়ে যায়। কখনো-কখনো রাতে বাইরে বেরোলে হালকা-মিষ্টি
হাসি-ঠাট্টার আওয়াজ পেয়েছি,ভালো করে লক্ষ্য করে দেখেছি দুজনে হাসি-মজায় একে অন্যের গায়ে
ঢলে পড়ছে। ম্যাডাম,ওদের এই ভালোবাসা-বাসি আমার ভারী ভালো লাগতো। এমনিতে এখানে সারাদিন
পরচুর কাজ থাকে। তখন সবাই যে যার মতো কাজে ব্যস্ত। আর সন্ধ্যে নামলেই অন্ধকার,ঘরে কম বাতির
আলো। সারাদিন হাড় ভাঙা খাটুনির পরও কি ছটফটে,প্রাণোচ্ছল ওরা। ওদের মতো আরও দুটো জুটি আছে এখন। আমরা সবাই
মিলে তদেরও চার হাত এক করবো। মালিক-বাবুরও সায় আছে তাতে।
ওনার সঙ্গে হাঁটছি,কখনও দাঁড়াচ্ছি আর একের পর এক ইট ভাঁটার বিভিন্ন গল্প শুনছি।
এখানে এসে যে এতো কিছু পাবো ভাবিনি!
ম্যাডাম,এই ইট-ভাঁটায়
মালিক-বাবুর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খুব ভালো। আমাদের সবার অন্ন দিচ্ছে এই ইট-ভাঁটা।
তাই আমরা যত ভালো কাজ করবো তত ভালো থাকবো। মালিক-বাবু সবসময় আমাদের পাশে থাকেন। উনার
ইস্তিরিও (স্ত্রী) খুব ভালো। উনি বলেন,এই ইট-ভাঁটা তোমাদের। তোমরা নিজেদের শ্রম দিয়ে একে বাঁচিয়ে রেখেছ!
আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি,একে শুধু আগলে রেখো।
তারপর একটু হেসে ম্যানেজার
বাবু বলল.........
ম্যাডাম দূরে তাকিয়ে দেখুন,ওই বড় শিরীষ
গাছটার নীচে কোনও ভরা-চাঁদের রাতে (পূর্ণিমা) দেখতাম,মঙ্গলের কাঁধে
মাথা দিয়ে রূপমতি বসে আছে। আবার কখনও অন্ধকার রাতে দুটো ছায়া শরীর মিলে যেতো। আমি দূর
থেকে দাঁড়িয়ে দেখতাম,ভারী ভালো লাগতো। মনে মনে বলতাম,ইট ভাঁটার
প্রতিটা ইটের ভাঁজে সদ্য বেড়ে ওঠা দুটো ছেলে-মেয়ের ভালোবাসা লেখা হয়ে থাকুক।
এখানকার মানুষগুলো তো
অশিক্ষিত,গাওয়ার। তবু,রূপমতি-মঙ্গলের প্রেম ওরাও খুব ভালো মনে নিয়েছে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম,আপনার বাড়ি
কোথায় ছিল?
ম্যানেজার বাবু বলল,আমি কাটিহার থেকে এখানে এসেছিলাম আমার কাকার হাত ধরে। তখন ওখানকার
গ্রামের ইশকুলে ছয়-কেলাসে পড়ি। বাড়ির অন্য সবাই বিড়ি বাঁধতো। আমার কাকা সেই সময় কাটিহার
ছেড়ে এদিকে কাজে এসেছিল। মাঝে মাঝে দেশে ফিরতো। একদিন কাকা বলল,চল তোকে আমার
সঙ্গে কাজে নিয়ে যাবো। লেখাপড়া আর হল না। এখানে এসে কাকার হাতে হাতে কাজ করে দিতাম।
আগের মালিক-বাবুও আমাকে
খুব ভালবাসত। একদিন কতকগুলো বই এনে বলল তুই পড়া করবি,আমি তোকে শেখাবো।
সেই থেকে একটু একটু শিখেছি। তারপর অঙ্ক কষে হিসেব করতে শেখাল। পড়তে আমার খুব ভালো লাগতো!
কিছুদিন পর কাকা আমাকে
এখানে কাজে দিয়ে গ্রামে চলে গিয়েছিল। আমার আর ফেরা হয়নি দেশে! বাবা-মা ছোটবেলায় মরে
যাবার পর কাকা ছাড়া আমার কেউ ছিল না। ছোট একটা ভাই ছিল সেও এক রাতের জ্বরে মরে যাবার
পর কাকা আমাকে এখানে নিয়ে চলে এসেছিল। তারপর থেকে এতগুলো বছর এদের সঙ্গেই জীবনটাকে
ভাগ করে নিলাম। ইট-ভাঁটাও আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠলো। মালিক-বাবু একটু শিখিয়ে পড়িয়ে সেইসময়
থেকেই আমাকে ম্যানেজার করে দিয়েছিলেন।
আমি বললাম,আপনি বিয়ে-থা সংসার..........?
উনি কথা কেটে নিয়ে বললেন,সে আর হয়ে
ওঠেনি! এদের নিয়ে সুখ-দুখে ভালোই আছি।
আপনি কাটিহারের মানুষ,বাঙালি নন।কিন্তু
আপনার কথা শুনে একবারও মনে হয়নি।
উনি বললেন,আসলে দীর্ঘদিন এই বাংলায় থাকতে থাকতে কখন যেন মনে প্রাণে বাঙালি
হয়ে গিয়েছি। এই বাংলার সব কিছুর সঙ্গে নিজেকে মনের অজান্তেই জড়িয়ে ফেলেছি। তবে ম্যাডাম,আমি কাকার
হাত ধরে যে বাংলায় এসেছিলাম,সেই বাংলা আর আজ বাংলার বিস্তর ফারাক।
যাইহোক,যা বলছিলাম…..
ওরা দুজনে রূপমতি আর মঙ্গলের বছর দেড়েক হল বিয়ে হয়েছে। বেশ সুখেই
আছে ওরা। মঙ্গল ভাঁটির কাজ করে। প্রতিদিনের রোজ পায়। রূপমতির বাচ্চা হবার পর মাস-দুয়েক
ওর কাজ বন্ধ থাকবে।
তবে আমাদের মালিক-বাবু
খুবই ভালো মানুষ। এই সময় উনি মাস মাহিনা দিয়ে দেন এবং বাচ্চা হওয়ার খরচ,বাচ্চা হওয়ার
আগে পরে মায়ের খাওয়া-দাওয়া,ওষুধ-পথ্য সবই দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন। সেইজন্যই এরাও মন
দিয়ে কাজ করে। ম্যানেজার বাবু বললেন এদের সঙ্গে থাকতে থাকতে আমিও এদেরই সুখ-দুঃখের
অংশীদার হয়ে গিয়েছি। এই মানুষগুলো খুবই সরল,সাদা সিধা। একটু ভালোবাসা,ভালো ব্যবহার
পেলে ওরা অনেকটাই দেবার চেষ্টা করে।
অলকেশ কাজ সেরে ফিরে
এসে আমাদের ডাকল। বলল,রূপা ফোন করেছিল,তোরা নাকি এখনও ভাত খেতে যাসনি! তিনটে তো বাজতে যায়।
আমি বললাম,”তুইও তো খাস নি”!
ও বলল,”এটা আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে রে”।
তবে চল,ভাঁটি সাজানো হয়ে গিয়েছে। এবার ফায়ারিং করা হবে। একেবারে দেখে বাড়ি ফিরবো।
ক্রমশ ………
৪র্থ পর্ব পড়ুন আগামী শনিবার।
লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
লেখিকার পরিচিতি –
লেখিকার জীবনের সঙ্গে গল্প অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িয়ে আছে। যা
দেখেন, যা শোনেন, যা শোনেন, যা কিছু স্মৃতির পাতায় জড়িয়ে আছে মনের সাথে,তাই নিয়ে লিখতেই বেশি পছন্দ করেন।
লেখা শুরু স্কুল-ম্যাগাজিন, কলেজ -ম্যাগাজিন দিয়ে। বর্তমানে কিছু লেখা প্রকাশিত হচ্ছে কয়েকটি মাসিক-ত্রৈমাসিক পত্রিকায়। পাখিদের নিয়ে অনেক লিখেছেন। গল্প, ভ্রমণ, ফিচার, কবিতা নিয়মিতভাবে লিখে থাকেন। দিল্লি থেকে প্রকাশিত কলমের সাত রঙ এবং তাৎক্ষণিক ডট কম-এর নিয়মিত লেখিকা।