ধারাবাহিক বড় গল্প
২য় পর্ব
ম্যানেজার-বাবু বললেন,সাধারণ ভাবে গঙ্গার ধারে বা নদীর পাড়ে অনেকখানি জায়গা জুড়ে এই
ইট-ভাঁটাগুলো গড়ে ওঠে। গঙ্গার পলিমাটি দিয়েই তো ইট তৈরি হয়।
আমি বিস্ময় নিয়ে বললাম আচ্ছা অমন কাদা কাদা পলিমাটি দিয়ে এমন
অসাধারণ ইট তৈরি হয়!.....
উনি বললেন হ্যাঁ ম্যাডাম………
মেশিনের সাহায্যে ওই পলিমাটি মেখে ইট তৈরির উপযোগী মণ্ড তৈরি
করা হয়। তারপর ওই পলিমাটির মণ্ড ইট তৈরির কাঠের ছাঁচে বা ফর্মায় ফেলে ইটের আকার দেওয়া
হয়। তবে ফর্মায় বা ছাঁচে মণ্ডটা ফেলার আগে ফর্মার মধ্যে গঙ্গার সাদা বালি রাখা হয়,তারপর ছাঁচের সঙ্গে মাটিটাকে সমান করে লেপে দেবার পর,আবার ওপর থেকে একমুঠো সাদা বালি মাখিয়ে দিতে হয়।
আমি বললাম কেন?!!!!
উনি বললেন যাতে সহজে ফর্মার ভেতর থেকে অক্ষত ইট উঠে আসে।
আমি বললাম বাঃ! তারপর…….
উনি আবার বলতে শুরু করলেন…..
তারপর এই কাঁচা ইটকে দিন-দশেক রোদে শুকনো করা হয়। এবার শুকনো
ইটকে ফায়ারিং চেম্বারে বিশেষ পদ্ধতিতে সাজানো হয়,যাতে ইটগুলো সম্পূর্ণ পুড়তে পারে। ফায়ারিং প্লেসে আগুন লাগানোর
পর ইট পুড়তে থাকে বেশ কয়েক দিন ধরে। পুড়তে থাকা ইটের ধোঁয়া চিমনি দিয়ে বেরিয়ে যায়।
দীর্ঘ দিন কাজ করতে করতে এই শ্রমিকরা খুবই দক্ষ হয়ে গিয়েছে।
তাই যখন ওরা বুঝতে পারে ইটের পোড় ঠিক হয়েছে,তখন ফায়ারিং বন্ধ করে দেয়। পোড়া ইট আবার ঠাণ্ডা হতেও দিন দশ-বারো
সময় লাগে। ফায়ারিং বন্ধ করার পরেও ওই তপ্ত লাল ইট ভেতরে ভেতরে বাকি টুকু পোড়ে।
ইট ঠাণ্ডা হলে ফায়ারিং প্লেস থেকে উপরে তুলে আনা হয়।
তারপর পোড় অনুযায়ী ১নম্বর,২নম্বর এবং ৩নম্বর ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। নম্বর অনুযায়ী ইটের
দামও আলাদা আলাদা হয়। এছাড়া,যে ইটগুলো একেবারে বেশি পুড়ে নীলচে কালো রং হয় সে গুলোকে ঝামা-ইট
বলে। ওগুলো বেশি পোড় পেয়ে কালো হয়ে যায় এবং একেবারে হালকা হয়। তা দিয়ে কোনও গাঁথনি
হয় না কিন্তু সেগুলো দিয়ে ইটের খোয়া তৈরি হয়,যা রাস্তা তৈরিতে কাজে লাগে। আগে পোড় খাওয়া স্ক্রাব-ইট ভেঙে
ঢালাই এর কাজ হতো,তাতে ঝামা
ইটও থাকতো। বাড়ি তৈরির সময় ভীত তৈরি করতে এইসব স্ক্রাব-ইট,ঝামা-ইট সবই কাজে লেগে যায়।
ইটের কোনও অংশই ফেলা যায় না। ইট ভাঙতে ভাঙতে যে গুঁড়োগুলো বেরোয়
সেগুলো হল সুরকি। তাও কাজে লাগে। তবে গাঁথনিতে সুরকির ব্যবহার এখন অনেক কমে গিয়েছে।
আমার খুব ভালো লাগছিল
শুনতে। মনে মনে ভাবছিলাম, সত্যিই! কত কিছুই জানার আছে!
ম্যানেজার বাবুর সঙ্গে
কথা বলে খুবই ভালো লাগলো। উনি এতো সুন্দর ভাবে ইট তৈরি নিয়ে বলছিলেন যে আমার ভীষণ ভালো
লাগছিল! কিছু মানুষ আছে যারা অল্প সময়ে মনে অনেকখানি জায়গা করে নেয়। ম্যানেজাবাবুও
তেমনই একজন।
অলকেশের বাড়ি থেকে ওর গিন্নি রুপা লোক দিয়ে চা পাঠিয়ে দিয়েছে।
ম্যানেজার বাবু বললেন,ম্যাডাম আপনারা চা খেয়ে নিন,আমি একটু ওদিকটায় ঘুরে দেখে আসি। আমি বললাম ম্যানেজার-বাবু,আজ তো শুক্রবার,ভাঁটি হবার দিন। হবে না!
উনি বললেন,হ্যাঁ ম্যাডাম হবে,তিনটের পর। মালিক-বাবু ফেরার পর ভাঁটি চড়বে। আপনারাও খাওয়া-দাওয়া
করে আসুন। নিশ্চয়ই দেখতে পারবেন। আমার একটুও ইচ্ছে করছিল না এসব ছেড়ে যেতে। মনীশকে
বললাম,এখন আর খেতে
যেতে ইচ্ছে করছে না। ও বলল ঠিক আছে,অলকেশ ফিরে আসুক তারপর দেখা যাবে।
দেখতে দেখতে বেলা গড়িয়ে গেল। ইট তৈরি,ইট সাজানো এবং তা ফায়ারিং প্লেসে দেওয়া পর্যন্ত আমি সাক্ষী হলাম।
কিন্তু…….
ইট তৈরির গল্প লেখা
আমার উদ্দেশ্য নয়! আমার এই লেখা ওদের নিয়ে,যারা তাদের শ্রম দিয়ে অন্যের স্বপ্ন বুনে দেয়।
একটা সুন্দর বাড়ির স্বপ্ন
সব মানুষের মনেই গাঁথা থাকে। সেই সঙ্গে রাস্তা-ঘাট,দোকান-বাজার,শপিং-মল,হাসপাতাল,ইত্যাদি ইত্যাদি।
যুগ-যুগ ধরে আধুনিক-অত্যাধুনিক সকল উন্নতির সোপান হল ইট। সেই
স্বপ্নের কারিগর যে মানুষগুলো তাদের কিন্তু নিজেদের কোনও ঘর বাড়ি নেই!
ম্যানেজার বাবুর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে আমি ওদের সকলের সঙ্গে আলাপ
করলাম। এগিয়ে এসে মাথা ঝুঁকিয়ে নমস্কার জানালো ওরা। মালিকের বন্ধু পরিচয় পেয়ে সমীহ
করলো আরও অনেক বেশি।
আমি অবাক চোখে ওদের শিল্পকর্ম দেখতে লাগলাম। (আমার চোখে এটা
শিল্পকর্ম) নাম জিজ্ঞাসা করে জানলাম ওদের নাম দুর্গা,লছমী,সরস্বতী,হরিন্দর ভানুমতী,কালী,গণেশ,ভোলা,ভীম,শিবু, কলাবতী,পার্বতী,রূপমতি,মঙ্গল আরও কত নাম কানে এলো মনে রাখতে পারিনি। শুনলাম,বাংলায় থাকতে থাকতে এদের ছেলে-মেয়েদের নামও বাংলায় হয়ে গিয়েছে।
দেখতে পেলাম বেশ কিছু
মহিলা-পুরুষ এবং ছোট ছোট বিভিন্ন বয়সের ছেলে-মেয়ে সবাই মিলে হাত লাগিয়ে ফর্মায় তৈরি
কাঁচা ইট বয়ে শুকোতে দিচ্ছে একটা একটা করে,তারই মাঝখানে যে যার উনুন জ্বালিয়ে হাঁড়িতে ভাত বসিয়েছে,কাজের ফাঁকে হাতা নিয়ে ভাত নাড়িয়ে দিয়ে তাতে জল ঢেলে দিচ্ছে।
ওখানেই নিজেদের জামা-কাপড় কেঁচে শুকোতে দিচ্ছে,বাচ্চাদের খেতে দিচ্ছে। তারই মাঝে নিজেদের মধ্যে হাসি-ঠাট্টাও
করে নিচ্ছে লক্ষ্য করলাম।
এত পরিশ্রম! এত না পাওয়া!
এত দারিদ্র! তার মাঝেও কি অসম্ভব প্রাণোচ্ছল এই মানুষগুলো! পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে বিন্দুমাত্র
খেদ নেই দেখে মনে হল!
ম্যানেজার বাবু বলল,এই ইট-ভাঁটা অনেক পুরনো। আমি যখন থেকে আছি শুধুমাত্র একবার মালিক
বদল হয়েছে। আর এরা বেশির ভাগই পরম্পরায় থেকে গিয়েছে।
লক্ষ্য করলাম এক অল্প
বয়সী মহিলা একই জায়গায় বসে নিপুণ হাতে কাঠের ফর্মায় একের পর এক ইট তৈরি করে চলেছে।
এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম “তোমার নাম কি”?
লাজুক চাহনিতে আমার দিকে তাকিয়ে নিয়ে,মুখ নিচু উত্তর দিলো… জী,আমার নাম “রূপমতি”।
খুব কালো গায়ের রঙ,কিন্তু ভারী মিষ্টি মুখের আদল। চোখ-মুখ-নাক একেবারে কাটাকাটা।
দেখে মনে হল সদ্য মাতৃত্ব আসন্ন। ম্যানেজার বাবুকে জিজ্ঞাসা করলাম,উনি বললেন ঠিকই ধরেছেন! ওদের বিয়েটাও আমরা দাঁড়িয়ে থেকেই দিয়েছি।
ওদের সম্পর্কটাও ভারী সুন্দরভাবে গড়ে উঠেছিল,তাই ইট ভাটার সবাই দাঁড়িয়ে থেকে চার হাত এক করে দিলাম।
আমি বললাম বাঃ বাঃ,শুনে বেশ ভালো লাগছে।
ম্যানেজার বাবু বলে চললেন,জানেন ম্যাডাম রূপমতি আর ওর বর মঙ্গলকে আমি জন্মাতে দেখেছি।
নয় নয় করে প্রায় চল্লিশ বছর আমি এই ইট ভাঁটাতে আছি। আমি যখন এখানে ম্যানেজার হয়েছি,তখন মঙ্গলের বাবা-মা বিহারের প্রত্যন্ত গ্রাম পাটুয়া টোলি (তাঁতী
গ্রাম) থেকে সবে এসেছে এখানে কাজের জন্য। প্রথমে তো ওদের কোনও কথা বুঝতে পারছিল না
কেউ। আগের মালিকের সময় তখন। মালিকের পা ধরে কেঁদে পড়লো বিরজু আর ওর বউ ললিতা,মানে মঙ্গলের মা আর বাবা। ভোজপুরী,মৈথিলী মেশানো খিচুড়ি ভাষায় কেঁদে কেঁদে কি বলছে কেউ বুঝতে না
পেরে মালিক-বাবু ডেকে পাঠালেন আমাকে। আমি ওদের সঙ্গে কথা বলে মালিক-বাবুকে তা বুঝিয়ে
বললাম। বাবু ওরা বলছে,”বাবু আমাদের মাঈ-বাবা! এখানে আমাদের একটা কাজ দাও বাবু,সারাজীবন তোমার কেনা হয়ে থাকবো”।
সে সময় দিন ছিল অন্যরকম,মালিক-বাবুও খুবই দয়ার মানুষ ছিলেন। কারোর চোখের জল উনি দেখতে
পারতেন না। বললেন,ঠিক আছে ওরা
এখানেই কাজে লেগে যাক। সেই থেকে এখানে লেবার বস্তিতেই ওদেরও জায়গা হল।
ম্যানেজার-বাবু বলল,এরপর একদিন বিরজুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,তোরা দেশ ছেড়ে এখানে কেন এলি কাজ করতে?
ওরা বলল,হোই জু (ওই খানে)ঘর ঘর মে তাঁতো কা কাম চলতা (তাঁত বোনা হয়)। হ্যমর বাপ-দাদা (ঠাকুরদা) হোনে তাঁতো কা কাম করত্ করত্ দিন গুজরতে
বানি সন। রূপয়া-পয়সা যাদা নই খে মিলল। (বেশি পাওয়া যায় না) । গাঁও কা হর আদমি-মেহেরারু (গ্রামের বর-বউ সবাই) হেনে-হোনে গৈলে
বানি কাম কে খ্যতির (এদিক-ওদিক চলে যাচ্ছে কাজের জন্য)। হ্যমে হোই জু রুখ্ রুখ্ কে কা ফয়দা মিলি (আমাদের ওখানে থেকে
কি লাভ হবে)? উধ্যর,হ্যমর জান-পহেচন এক্ দেশোয়ালি ভাই উও ট্যেইম কলকাত্তা মে কাম
কে খ্যতির আগইল,(কলকাতায় কাজ
করতে এলো),হ্যাতনা রূপয়া-পয়সা
মিলত রোহি লে (অনেক পয়সা জোটাতো)।
সাদি-বিহা ক্যরলি হ্যম,লেকিন কুছু ক্যম্যতে ন্যই খি (বিয়ে করেছি,রোজগার নেই)। বিচো মে ক্যম
কি খ্যতির আওল-যাওল চলতে বানি (মাঝে মধ্যে এদিক ওদিক কাজে যেতাম)। হ্যাতনা ক্যমি রূপ্যয়া সে ক্যাতনো দিন চলোতা (তাতে আর কদিন চলতো)!
বর-বাজার ক্যাইমে ক্যরেম (দোকান বাজার)। একদিন হ্যমর মেহেরারু ক্যহি কি চল্ (একদিন আমার বউ বলল) গড়ি
পাকড় কে চলি (গাড়িতে চেপে পড়ি),ঢুঁডতে ঢুঁডতে হেন্যে-হোন্যে ক্যম মিল য্যই (খুঁজতে খুঁজতে
ঠিক কোথাও কাজ জুটে যাবে)। ইধ্যর আকে
ঘুমতে ঘুমতে হেনে আ গ্যইলে বানি (এদিকে এসে নেমে পড়ে ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়লাম এখানে।
ম্যানেজার-বাবুর মুখে দেহাতি ভাষা শুনতে বেশ ভালো লাগছিল,তবুও বললাম আপনি বাংলায় বলুন। উনি বললেন,ঠিক আছে ম্যাডাম।
ক্রমশ ………
৩য় পর্ব পড়ুন আগামী শনিবার।
লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
লেখিকার পরিচিতি –
লেখিকার জীবনের সঙ্গে গল্প অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িয়ে আছে। যা
দেখেন, যা শোনেন, যা শোনেন, যা কিছু স্মৃতির পাতায় জড়িয়ে আছে মনের সাথে,তাই নিয়ে লিখতেই বেশি পছন্দ করেন।
লেখা শুরু স্কুল-ম্যাগাজিন, কলেজ -ম্যাগাজিন দিয়ে। বর্তমানে কিছু লেখা প্রকাশিত হচ্ছে কয়েকটি মাসিক-ত্রৈমাসিক পত্রিকায়। পাখিদের নিয়ে অনেক লিখেছেন। গল্প, ভ্রমণ, ফিচার, কবিতা নিয়মিতভাবে লিখে থাকেন। দিল্লি থেকে প্রকাশিত কলমের সাত রঙ এবং তাৎক্ষণিক ডট কম-এর নিয়মিত লেখিকা।