কোচবিহার রাজবাড়ী দেখবার আশায় মধ্যাহ্নভোজন সেরে " তিস্তা তোর্সা " এক্সপ্রেসে চেয়েছিলাম। পরের দিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা নিউ কোচবিহার স্টেশনে নেমে রাজবাড়ীর নিকটে একটি হোটেলে আশ্রয় নিয়েছিলাম । জলখাবার সেরে পায়ে পায়ে চলে যাই কোচবিহার রাজবাড়ী।
১৮৮৭ সালে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ রাজবাড়ী তৈরি করেছিলেন । কিন্তু সেই
প্রাচীন রাজবাড়ীর সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য অমলিন । বর্তমানে রাজারা না থাকলেও সরকার এই
রাজবাড়ীর দেখাশোনা করে । রাজবাড়ীর পাঁচটি ঘর দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত __ যেখানে
রাখা আছে রাজাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র । ঐ বংশের রাজারা খুব শিকার প্রিয়
ছিলেন । শিকারে ব্যবহৃত অনেক অস্ত্র একটি ঘরে সুসজ্জিত রাখা আছে । এই সব দেখে
আমাদের মন ইতিহাসের পাতায় ডুব দিয়ে আসে
।
বিকেলে কোচবিহার শহরের বিখ্যাত মদন মোহন
ঠাকুরের মন্দির দর্শন করতে যাই । মন্দিরের গায়ে খোদাই করা অপূর্ব ভাস্কর্য , রাস-মঞ্চ
দেখে মনের মধ্যে মধ্যে আধ্যাত্মিক ভাব
জেগে ওঠে । আমরা ভক্তিভরে ঠাকুরের সন্ধ্যা রতি দেখি । মন্দিরের ভেতরে অনেক ফুল
ফুটে রয়েছে ।
পরের দিন সকালে আমরা যাই বিখ্যাত
" রসিক বিল " দেখতে । এই বিল দেখতে শহর থেকে অনেক দূরেই আমাদের যেতে হয়
। সেই সুযোগে গাড়িতে কোচবিহার শহর ভ্রমণ হয়ে যায় । এই বিলটি অনেকটা বন জঙ্গলে ঘেরা থাকায় খুব
নির্জন । দূর দূরান্ত থেকে অনেক রকম পাখিরা এখানে আশ্রয় নেয় । পাখিদের বিভিন্ন
রকম ডাকে কল মুখরিত । এছাড়াও এখানে অনেক হরিণ , দুটি বাঘ
দেখতে পাই । সারাদিন এখানে আমরা জঙ্গলের ভেতর স্বাধীন ভাবে ঘুরে বেড়াই ।
পর দিন কোচবিহার ছেড়ে লাটাগুড়ির
উদ্দেশ্যে যাত্রা করি ।
যাবার পথে ড্রাইভার আমাদের
" লাল ঝামেলা " নামে একটি জায়গায় নামায় । ছোটো একটা পাহাড়ের তলা
দিয়ে একটা নদী বয়ে চলেছে । এই পাহাড়ের গায়ে মেঘেরা জমে রয়েছে । জঙ্গলের
গাছেদের ভিড়ে মেঘের আনাগোনায় এক অপূর্ব দৃশ্য
আমরা ফ্রেমবন্দী করি । এরপর আমরা চলে যাই সোজা লাটাগুড়ির "গরু মারা
" জঙ্গলের বন বাংলোতে । মধ্যাহ্নভোজন সেরে পায়ে পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াই
জঙ্গলে । বর্ষায় জঙ্গলের অপূর্ব রূপ । অজানা অচেনা অনেক রকম গাছেদের ভিড়ে আমরা
যেন হারিয়ে যাই । অনেক রকম পশু পাখির দেখা পাই ।হাতি , গণ্ডার
দূরে ঘুরে বেড়াচ্ছে । আকাশে মেঘ জমায় ময়ূরের পেখম তুলে নাচ আমাদের চক্ষু সার্থক
করেছে। আর একদিন থাকবার ইচ্ছা থাকলেও আমরা থাকতে পারিনি , চলে যাই
"কোলাখাম"।
কোলাখাম পাহাড়ের অনেক ওপরে । পাহাড়ি
রাস্তায় রঙ বেরঙের ফুলেরা ফুটে রয়েছে ।
আমরা ফুল দেখতে বারবার গাড়ি থেকে নামায় কোলাখাম হোমস্টেতে পৌঁছতে সন্ধ্যা
হয়ে যায় । রাস্তায় আলো নেই , তাই
চারপাশ অন্ধকার । গল্পগুজব করে রাত নটাতেই আমরা ঘুমিয়ে পড়ি । পরের দিন ভোরে
জানলা থেকেই দেখতে পাই দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘার কোলে সূর্যোদয় । চারিদিক ফাঁকা থাকায় , আকাশ
পরিষ্কার হওয়ায় , প্রকৃতি আমাদের এই সুযোগ করে
দিয়েছে । এরপর আমরা প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়ি " ছাঙ্গে " নামে একটি
ঝর্ণা দেখতে । গাড়ি থেকে নেমে প্রায় কুড়ি মিনিট হেঁটে হেঁটে পাহাড়ের অনেকটা
তলায় গিয়ে ঝর্ণার দেখা পাই । পাহাড়ের ওপর থেকে অজস্র জলধারা নিয়ে সাদা হয়ে
লাফিয়ে পড়ছে মাটিতে । সেই সৌন্দর্য ব্যাখ্যাতীত । বৃষ্টিতে ভিজে গেলেও এই
সৌন্দর্য আমাদের মনকে মুগ্ধ করেছে ।
কোলাখামের প্রকৃতিকে বিদায় দিয়ে আমরা
নেমে যাই বিদ্যাঙ নদীর কোলে ভ্যালিতে । বর্ষায় এই নদী ফুলে ফেঁপে উঠেছে । আমরা
নদীর তীরে একটি হোম স্টেতে ছিলাম । নদীর ওপর একটি ঝুলন্ত সেতু রয়েছে , ওপারে
যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ।
এই সেতুর ওপারে কয়েকটি
বাড়ি আছে । নদীর ওপর এই সেতুটি বিনি সুতোর মালা গেঁথেছে । এই সেতুর ওপর দিয়ে
হাঁটার সময় নীচে তাকিয়ে শিহরিত হচ্ছিলাম । আস্তে আস্তে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো ।
রাতের অন্ধকারে গাছে গাছে জোনাকির আলোর এক অপূর্ব রূপ উপভোগ করছিলাম । ওখানে কোনও
ইন্টারনেট সংযোগ নেই । প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাদের এই অভাব পূরণ করেছে ।
ইচ্ছা না থাকলেও অবশেষে পরের দিন
প্রকৃতির কোল থেকে ফিরে আসতে হয় বাড়ির উদ্দেশ্যে । কয়েকদিনের এই উত্তর বঙ্গ
ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমার মনকে দীর্ঘদিন আচ্ছন্ন করে রাখবে ।
লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখিকার পরিচিতি –
শিক্ষকতা ও সংসার সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে সাহিত্য চর্চার সময়ে টান পড়েছিল এক সময়ে। মনের সুপ্ত বাসনা মনেই লুকিয়ে ছিল । সময় পেলেই খাতা, কলম নিয়ে বসে যান লিখতে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখেন। মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অনুভূতিগুলো বেড়িয়ে আসে কবিতা হয়ে। কবিতাকে ভালবেসে ফেলেছেন।