১ম পর্ব
ইংরেজিতে ‘ বড় গল্প’ বা ‘ লং স্টোরি’-র কোন আলাদা সংজ্ঞা নেই কাজেই বাংলায় আমরা যাকে ‘বড় গল্প’ কিংবা ‘উপন্যাসোপম বড় গল্প’ বলে থাকি তা ‘ short story’ বা ‘ছোট গল্প’-র অন্তর্ভুক্ত বলা যেতে পারে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে
প্রচুর সাময়িক পত্র পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে আর এই পত্রিকাগুলোর চাহিদা মেটাতেই
ছোট গল্প লেখা শুরু হয়েছিল। এডগার এ্যালান পো, গী দ্য মঁপাসা এবং আন্তন চেকভ ছোট গল্পের ভাষা, রীতি ও প্রকরণে অনেক নতুনত্ব এনে এটিকে গদ্য
সাহিত্যের একটি বিশিষ্ট শিল্পের মর্যাদা দিয়েছেন। কিন্তু ছোট গল্পের দৈর্ঘ্য কতটা
হবে সে ব্যাপারে আজ পর্যন্ত কেউ কোন সুষ্পষ্ট মতামত দেননি। আমেরিকান গল্পকার এডগার
এ্যালান পো তাঁর ‘The Philosophy of Composition’ গ্রন্থে ছোট গল্প কত বড় হতে পারে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বলেছেন ‘One should be able to read it in one sitting’. অর্থাৎ ছোট গল্প এতটাই হবে যে ওটা একবার বসে পড়ে শেষ
করা যায়। কিন্তু পো-র এই ঢিলে ঢালা সংজ্ঞায় সময় বা শব্দ সংখ্যার কোন উল্লেখ নেই।
এক হাজার থেকে চার হাজার শব্দের মধ্যে বেশির ভাগ ছোট গল্প লেখা হলেও বিশ্ব
সাহিত্যে দশ থেকে পনের হাজার শব্দে লেখা গল্পের সংখ্যা কম নয়। চেকভ তাঁর জীবনের
শেষ পর্বে যেসব গল্প লিখেছেন তার মধ্যে অনেকগুলোই কুড়ি হাজার কিংবা তার থেকেও বেশি
শব্দের। পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যে এই গল্পগুলোকে ‘ছোট গল্প’ হিসেবে ধরলেও আমরা এগুলোকে
‘বড় গল্প’ হিসবে আলাদা একটি শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ
দুই দশক থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত লেখা এরকম ছয়টি গল্পকে
বেছে নেওয়া হয়েছে এই প্রবন্ধের জন্য। বহুচর্চিত ও বহুপঠিত এই গল্পগুলোর শৈল্পিক
উৎকর্ষতা অবিসম্বাদিত এবং এই গল্পগুলোর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে পরবর্তী যুগের
গল্পকারদের রচনায় তাই এদের সেরা গল্পের আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
১৮৮০ সালে
লেখা মঁপাসার এই গল্পটির প্রেক্ষাপট ১৮৭০ সালের ফ্রান্স ও প্রুশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ।
১৯ বছরের তরুণ মঁপাসা ফ্রান্সের সেনাবাহিনিতে নাম লিখিয়ে যুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন। এক
বছরের মধ্যে ফ্রান্স প্রুশিয়ার কাছে হেরে গেল এই যুদ্ধে কিন্তু যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়
করে নিয়ে এসেছিলেন মঁপাসা তারই ভিত্তিতে লেখা ‘Boule de Suif’ বা ‘ চর্বির
গোলা’ মঁপাসার প্রথম গল্প। এটি ফ্রান্সের আরও পাঁচজন বিখ্যাত লেখকের গল্পের সঙ্গে
অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ‘ Les Soires de Medan’ (Evening at Medan) নামক একটি গল্প সংকলনে। এই গল্পটিই মঁপাসাকে ফ্রান্সের একজন প্রথম সারির
লেখক হিসেবে পাঠকদের সামনে নিয়ে আসে।
গল্পের সারাংশ
রুয়েন শহরটি
প্রুশিয়ার হস্তগত হলে যাঁরা শহর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন তাদের মধ্যে
রয়েছেন দশ জন যাত্রী যাদের অনেকেই এসেছেন সমাজের উপরতলা থেকে। এদের মধ্যে
আছেন একজন মদ বিক্রেতা ও তাঁর স্ত্রী, একজন কাউন্ট ও তাঁর স্ত্রী, একজন সুতোকলের মালিক ও তাঁর স্ত্রী, একজন দেশপ্রেমী, দু’জন সন্ন্যাসিনী এবং একজন বারবনিতা যার মেদবহুল, গোলগাল চেহারার জন্য তার আসল নাম এলিজাবেথ রুসো হলেও
শহরের লোক তাকে ‘ চর্বির গোলা’ নামেই উল্লেখ করে থাকে। তুষারপাতে রাস্তার অবস্থা
খারাপ হয়ে যাওয়ায় গাড়ির গতি অত্যন্ত শ্লথ হয়ে গেলে যাত্রিরা নিজদের মধ্যে কথা বলতে
শুরু করেন। চর্বির গোলা নিচু তলার মানুষ, তাই অন্যান্য যাত্রীরা ওর সম্পর্কে নানা বক্রোক্তি করে ওকে বুঝিয়ে দেয় যে
সহযাত্রী হিসেবে সে ওদের সঙ্গে যাবার উপযুক্ত নয়। রাস্তায় অনেক দেরী হয়ে যাওয়ায়
এবং অভিজাত যাত্রীরা সঙ্গে কোন খাবার নিয়ে না আসায় খিদেয় কষ্ট পান। চর্বির গোলা
তার নিজের জন্য আনা খাবার খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখে তার নিন্দাকারী সম্ভ্রান্ত
যাত্রীদের। শেষ পর্যন্ত যাত্রীরা যখন রাতের দিকে তোতে নামক একটি গ্রামের সরাইখানায়
গিয়ে হাজির হয়, ওঁরা আবিষ্কার
করেন ওঁরা প্রুশিয়া অধিকৃত এলাকায় ঢুকে পড়েছেন। ওই সরাইখানায় তখন জাঁকিয়ে বসেছেন
এক তরুণ প্রুশিয়ান অফিসার যে ওদের আদেশ দিলেন সরাইখানা ছেড়ে না যেতে। খোঁজ নিয়ে
জানা গেল ওই অফিসার ওঁদের আগে যাবার অনুমতি দেবেন যখন ও একরাতের জন্য কাছে পাবে
এলিজাবেথ নামের সেই বারবনিতাকে। দেশভক্ত এলিজাবেথ শত্রুর দেশের একজন অফিসারের
শয্যাসঙ্গিনী হতে রাজি না হলে ওর সহযাত্রীরা ওকে প্রথমে সমর্থন জানালেন। কিন্তু
তিন দিন সরাইখানায় আটকে থাকার পর তাঁরা নানা কৌশলে, এমনকি দু’জন সন্ন্যাসিনীর সাহায্য নিয়ে এলিজাবেথকে রাজি করাল ওই কামুক, বিজাতীয় অফিসারকে খুশি করতে। কিন্তু পরের দিন মুক্তি
পেয়ে যখন ওঁরা আবার গন্তব্যস্থলের দিকে এগিয়ে যায়, সম্ভ্রান্ত যাত্রীরা তাঁদের নিজস্ব রূপ ধারণ করেন। চর্বির গোলাকে শুধু
বাক্যবাণে বিদ্ধ করেই ক্ষান্ত হননা ওঁরা, ক্ষুধার্ত মেয়েটিকে নিজদের খাবারের অংশ দিতে পর্যন্ত ভুলে যান তাঁরা।
গল্পের শেষে আমরা দেখি রাতের অন্ধকারে ঘোড়ার গাড়ি ছুটে চলেছে। ভরা পেটে দেশপ্রেমি
মনের আনন্দে উচ্চস্বরে গেয়ে চলেছেন জাতীয় সঙ্গীত মার্সেলেজ আর খিদেয়, অপমানে আত্মসন্মান খোয়ানো চর্বির গোলা কান্নায় ভেঙে
পড়ছে।
নিখুঁত, ভাবাবেগ বর্জিত, বাস্তবসম্মত কাহিনি, ফরাসি বুর্জোয়া সমাজের প্রতি ব্যঙ্গের তীব্র কশাঘাত আর অবহেলিত, তথাকথিত নিচু তলার সমাজের একটি চরিত্রের প্রতি গভীর
সমবেদনা মঁপাসার এই গল্পটিকে উন্নীত করেছে মহৎ শিল্পের পর্যায়ে। মঁপাসার সাহিত্য
জীবনের গুরু মাদাম বোভারি খ্যাত গুস্তভ ফ্লবের মঁপাসার এই গল্পটিকে একটি মহান
কীর্তি (Masterpiece) বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। বিদগ্ধ সমালোচকেরাও মঁপাসার এই
প্রথম গল্পটিকেই তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ গল্পের মর্যাদা দিয়েছেন। আধুনিক ছোট গল্পের
অন্যতম স্রষ্টা মঁপাসা তিনটি উপন্যাস, তিনশোর মত গল্প এবং একটি কবিতার বই প্রকাশিত করেছিলেন তাঁর স্বল্পায়ু
জীবনের সবচাইতে সৃষ্টিশীল দশটি বছরে, ১৮৮০ থেকে ১৮৯০ সালের মধ্যে। ফ্রান্সের শীর্ষ স্থানীয় লেখক গুস্তভ
ফ্লবের-এর কাছ থেকেই তিনি শিক্ষা নিয়েছিলেন কীভাবে সংক্ষেপে, স্বল্প পরিসরে, বর্ণিত বিষয় থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখে গল্প বলা যায়। গল্পের শেষে ‘whipcrack ending’ বা ‘চাবুক হাঁকড়ানো পরিসমাপ্তি’ মঁপাসার একটি বড় অবদান যা পরবর্তীকালে ও
হেনরি, সমারসেট মম
এবং আরও অনেক গল্পকার তাঁদের গল্পে ব্যবহার করে পাঠকদের প্রশংসা লাভ করেছেন।
জেম্স জয়েস (
১৮৮২ -১৯৪১) দ্য ডেড ( মৃতরা)
বহুচর্চিত এবং
উচ্চ প্রশংসিত ‘ইউলিসিস’ (১৯২২) এর স্রষ্টা জেমস জয়েস তাঁর সাহিত্যিক জীবনে একটি
মাত্র গল্পের বই প্রকাশিত করেছিলেন। আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনের নানা চরিত্র
এবং ঘটনা নিয়ে লেখা ১৬টি গল্পের এই সংকলনের নাম ‘ ডাবলিনার্স’ (১৯১৪)। দ্য ডেড এই
গল্প সংকলনের শেষ এবং সবচাইতে বড় গল্প। নোবেল জয়ী বিশ্ববিখ্যাত কবি টি. এস. এলিয়ট
এই গল্পটির অতি উচ্চ প্রশংসা করে বলেছেন ‘ One of the greatest short stories ever written.’
ক্রমশ ……………………
২য় পর্ব পড়ুন আগামী মঙ্গলবার
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক পরিচিতি
জন্ম এবং শিক্ষা কলকাতায়; কর্মজীবন দিল্লিতে, কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রালয়ে। গল্প লেখার শুরু ষাটের দশকের শেষ দিকে। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে আসছেন গত পঞ্চাশ বছর ধরে। ইংরেজিতে দেশে এবং বিদেশে ওঁর কিছু গল্প এবং তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। বিবিসি থেকেও ওঁর কয়েকটি গল্প প্রচারিত হয়েছে। বাঙলায় চারটি উপন্যাস এবং দু’টি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। দেশ, আনন্দবাজার, সাপ্তাহিক বর্তমান, নবকল্লোল, পরিচয়, কালি ও কলম(বাংলাদেশ) এবং দিল্লি ও কলকাতার অনেক সাহিত্য পত্রিকায় গল্প লেখেন নলিনাক্ষ। দিল্লি থেকে প্রকাশিত ‘ কলমের সাত রঙ’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত আছেন।