Advt

Advt

atmanash-story-galpo-2ndpart-by-nityaranjan-debnath-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-আত্মনাশ-নিত্যরঞ্জন-দেবনাথ

atmanash-story-galpo-2ndpart-by-nityaranjan-debnath-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-আত্মনাশ-নিত্যরঞ্জন-দেবনাথ

 ২য় পর্ব

তীন কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে বললেন," জটিল সমস্যা।সম্পর্কগুলো টিকিয়ে রাখাই মুশকিল দেখছি। মেজ বৌমা-তো বাবা-মায়ের একমাত্র আদরের সন্তান। যা হুকুম করেছে তাই পেয়েছে। এখন হুকুম করতে গিয়ে ছোট-বড় জ্ঞানটুকুও লোপ পেয়ে গেছে। দেখি, অসিতের সঙ্গে কথা বলি।চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে পারলেই ভাল হয়।"

"অসিতের সঙ্গে কথা বলে কিছু হবে না।  মেজ বউয়ের উপর কথা বলার সাহস ওর নেই। যা করার আমাদেরকেই করতে হবে। আমাদের বয়স হয়েছে। তেল,ঝাল,মশলা বেশি খাওয়া বারণ। এতদিন বড় বৌমা কম মশলা দিয়ে রান্না করে আমাদেরটা তুলে নিয়ে আবার মশলা দিত। সেটাও ওর হুকুমে বন্ধ হয়ে গেছে। এইভাবে মান খুইয়ে বাঁচতে পারব না বলে দিলাম। শিগগির ওদের আলাদা খাওয়ার ব্যবস্থা করো।"

" এক বাড়িতে বাবা-মা বেঁচে থাকতে ছেলেরা আলাদা খাবে,সেটা কি ভাল দেখাবে? পাড়ার লোক, আত্মীয়স্বজন কি বলবে?  দাঁড়াও, অসিত অফিস থেকে ফিরুক। আজই কথা বলে একটা ব্যবস্থা করছি।"

সম্পর্ক যে তিক্ততায় পৌঁছে গেছে সে অবস্থা থেকে সুষ্ঠু সমাধান করা কঠিন। তবু মান-সম্মানের কথা ভেবে অতীন আলাদা করে দিতে চাইছেন না। মেজ পুত্রকে ডেকে আলোচনা করলেন। সিদ্ধান্ত হল, একজন রাঁধুনি রাখা হবে। অফিসের রান্না হয়ে যাওয়ার পর অর্থাৎ দশটা নাগাদ রাঁধুনি এসে কম তেল, ঝাল মশলা দিয়ে তাদের জন্য তরকারিগুলো রান্না করে দিয়ে যাবে। রাঁধুনির টাকাটা অতীনই পে করবে।

যৌথ সংসারের ভাঙ্গন রুখতে গেলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তি স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়। যা বাস্তব ক্ষেত্রে কঠিন। অনিমা বাধ্য হয়ে মেনে নিলেও মেজ বউকে সহ্য করতে পারছেন না কিছুতেই। কারণ তার আচার-আচরণ এতটুকু বদলায় নি।অন্যায় করেও নত হতে নারাজ। ইগো। ফলে অনিমার প্রেশার দিন দিন বেড়েই চলেছে।কয়েক মাস অন্তর অন্তর প্রেশারের ডোজ বাড়াতে হচ্ছে।

এর মধ্যেই একটি ঘটনা। অতীন সেন বিকেলে সূর্য ডুবে গেলে একটু হাঁটতে বের হন। আরও কয়েকজন বন্ধু পা মেলান। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই অবশ্য ফিরে আসেন। একটু রেস্ট নিয়ে ফ্রেস হয়ে তারপর চা বিস্কিট খান। প্রতিদিনই একই রুটিন। সেদিন ফিরে এসে দেখেন বাড়িতে হুলস্থূল কাণ্ড। অনিমা নাকি অজ্ঞান হয়ে চেয়ার থেকে মেঝেতে পড়ে গেছেন। ইতিমধ্যে ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখছেন।  ছোট-খোকা বাড়িতে ছিল বলে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে কল করে আনতে পেরেছে। প্রেশার অত্যন্ত হাই। কাছেই একটি  নার্সিং হোমে ভর্তি করানো হল। কিন্তু অনিমা আর কথা বলল না। কোমায় আচ্ছন্ন থেকে তিন দিন পর অমৃত লোকে চলে গেলেন।

মৃত্যুর শোক বেশি দিন স্থায়ী হয় না। ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসে। তিনদিন, সাতদিন,দশদিন বড়জোর এক বা দু'মাস পর মানুষ স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসে। না হলে বাঁচবে কি করে? কিন্তু অতীন সেনের ক্ষেত্রে তা ঘটল না। পরিবারের  কারও কোনও অসুবিধা না হলেও স্ত্রীর মৃত্যুতে অতীন সেনের চরম ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। কারণ তিনি অনিমার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিলেন। পদে পদে তার অভাব টের পাচ্ছেন। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের অভ্যাস পরিবর্তন করা প্রায় দুঃসাধ্য ব্যাপার। যেমন সকালে ঘুম থেকে উঠেই তিনি এক গ্লাস জল খান। তারপর এক কাপ লিকার চা। চা খেয়েই বাথরুম করে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে ছ'টার আগেই প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। প্রায় এক ঘণ্টা পর ফিরে আসেন। একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার এক কাপ চা ও হালকা টিফিন। এইভাবেই সারাদিন থেকে রাতে শুতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত নির্দিষ্ট রুটিনে চলতেন। অনিমা হাতের কাছেই তা যোগান দিতেন। কোনোদিনই অন্যথা হয় নি।এবার এত হ্যাপা কে সামলাবে? বড় বৌমা কিছুটা করে ঠিকই। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে নানা কাজের ঝামেলায় করতে পারে না বলেই অতীন সেন বিপাকে পড়েছেন। দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তারপরেও লক্ষ্য করছেন,  এই পরিবারের কারো ব্যবহারই আন্তরিক নয়। এখনও বাড়ির সর্বময় কর্তা তিনি। অথচ তাকেই অবলীলায় অবজ্ঞা করছে সবাই। ভাবছেন,অনিমা হয়তো সেই কারণেই সংসার থেকে বিদায় নিয়েছে।আলাদা সংসার করে দেওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত বলত। তিনি কান দেননি। মেনে নিলে হয়তো এভাবে প্রাণ দিত না। শুনেছে সেদিন নাকি মেজ বৌমার সঙ্গে উচ্চস্বরে তর্ক বেঁধেছিল। চিৎকার করতে করতেই ধপাস করে চেয়ার থেকে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। আলাদা থাকলে সে সুযোগ হত না। তিনি যদি স্ত্রীর প্রতি আরেকটু যত্নবান হতেন, তাহলে হয়তো এমন পরিণতি হত না।

 একদিন সকালের দিকে মেজ বৌমা এল অতীন সেনের ঘরে।  এসেই বলল," বাবা, আপনার সঙ্গে একটা কথা ছিল।"

" বলো বৌমা, কি বলবে?"

" আপনার ঘরটা অনেকটা বড়। তুলনায় আমাদের ঘরটা খুবই ছোট, প্রায় এর অর্ধেক হবে। এত ফার্নিচার হয়ে গেছে, হাঁটা-চলার জায়গা পর্যন্ত নেই। আপনিতো একা থাকেন, যদি আমাদের সঙ্গে ঘরটা  চেঞ্জ করে নেন, খুব সুবিধা হয়।"

অতীন সেন বললেন,"  তা হয় না বৌমা। এই ঘরটায় তোমার শাশুড়ি মায়ের সব স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আমি মনে করি তিনি এখনও এই ঘরেই আছেন। এই ঘর ছাড়তে পারবো না।"

মেজ বৌমা রাগত সুরে বলল," যত সব ভড়ং।ফালতু সেন্টিমেন্টাল কথাবার্তা। তেমন মনে হলে ওনার ছবি ওই ঘরে টাঙিয়ে জপ করুন গে।কে বারণ করবে?  দেবেন না স্পষ্ট বলে দিলেই তো হয়। বাজে অজুহাত দিচ্ছেন কেন?"

অতীন সেন রাগে কাঁপছেন। বললেন, " না, দেব না।অসুবিধা হলে তোমার স্বামীকে বল, বড় বাড়ি করে দিতে। নাহলে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে। এই বাড়িতে থাকতে হলে ওই ছোট ঘরেই থাকতে হবে এবং আমার কথামত চলতে হবে। এখন যাও, আমাকে বিরক্ত করো না।"

সেদিন রাতেই মেজ ছেলে এসে অতীন সেনকে অনেক রূঢ় কথা শোনাতে এল। তিনিও অবশ্য ছেড়ে কথা বলেন নি। যাকে বলে উত্তপ্ত বাগবিতণ্ডা। অতীন সেন সন্তানদের সঙ্গে কোনোদিনই এমন ভাবে কথা বলেন নি। অনেক ক্ষোভ পুঞ্জীভূত ছিল। সমস্ত উগরে দিলেন।

পরদিন থেকে ঔষধ-পত্র, প্রেশারের ট্যাবলেট খাওয়া বন্ধ করে দিলেন। কি হবে বেঁচে থেকে?

*   *   *

শ্মশানে পৌঁছে সকলে অবাক। হাজার হাজার লোক চারিদিকে গিজগিজ করছে। দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত নেই। অতীন সেনের গুণমুগ্ধ সব ছাত্র, অভিভাবক তাদের প্রিয় স্যারকে একবার চোখের দেখা দেখতে এসেছে। মৃতদেহ নামানোর সঙ্গে সঙ্গে বিশাল লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ল সবাই। সকলের হাতে পুষ্প স্তবক, ফুলের মালা। সারাদিনেও এই লাইন শেষ হবে কিনা সন্দেহ। এদিকে মেজ ছেলে বিরক্ত। সারাদিনটাই নাকি মাটি।

 

সমাপ্ত

লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

লেখক পরিচিতি -

নিত্যরঞ্জন দেবনাথ পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়ার পানুহাটে ১৯৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন।কাটোয়া কলেজ থেকে বাণিজ্যে স্নাতক। বর্তমানে থাকেন হুগলির চুঁচুড়ায়। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী ছিলেন।অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল-এর অধীন ডিভিশনাল অ্যাকাউন্টস অফিসার পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম গল্প " চেতনা " ছোটদের পত্রিকা শুকতারায় ১৯৯৬ - এর এপ্রিলে প্রকাশিত হয়। এরপর দেশ, শিলাদিত্য, কালি ও কলম,মাতৃশক্তি, তথ্যকেন্দ্র, কলেজস্ট্রিট, কথাসাহিত্য, দৈনিক স্টেটসম্যান, যুগশঙ্খ, একদিন,,সুখবর ইত্যাদি এবং বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে নিয়মিত তাঁর সাহিত্যকীর্তি অব্যাহত। ইতিমধ্যে পাঁচটি গল্প সংকলন ও চারটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক "শতানীক " পত্রিকাটি দীর্ঘদিন ধরে সম্পাদনা করে আসছেন।