১ম পর্ব
এলাকার স্বনামধন্য শিক্ষক অতীন সেন চলে গেলেন। সকাল সাতটা একান্ন মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বয়স হয়েছিল একাত্তর বছর কয়েক মাস। তিন পুত্র, এক কন্যা, দুই পুত্রবধূ ও দুই নাতি বর্তমান। অনেকে বলছেন তিনি ভাগ্যবান। মৃত্যুকালে পরিবার পরিজন সকলকেই পাশে পেয়েছেন। এমনকি তাঁর প্রাতঃভ্রমণকারী পাঁচ-বন্ধু শিয়রে বসে আছেন এখনও। শোকে মুহ্যমান সকলেই। তবে কান্নার রোল নেই। একমাত্র কন্যাটি এবং ছোট ছেলেটির চোখ ছলছলে। অর্থাৎ দু'জনের মর্মবেদনা বোধহয় একটু গভীরে।
বড় ছেলে অলোক, সেটেলমেন্ট অফিসের হেডক্লার্ক। সে ডাক্তারের
কাছ থেকে ডেথ সার্টিফিকেট লিখিয়ে নিচ্ছে। আর কি কি করণীয় শলা-পরামর্শ করছে। মেজ ছেলে
অসিত, ইনকাম ট্যাক্স অফিসার। দায়িত্বপূর্ণ
পদ। অফিসে আর্জেন্ট কাজ রয়েছে। এই অবস্থায় যে অফিস যাওয়া সম্ভব নয় সে জ্ঞানটুকু আছে।
তাই ফোনাফুনি করে ম্যানেজ করল। এবার শববাহী গাড়ির জন্য ফোন লাগাচ্ছে। ছোট ছেলে অনিল
ইংলিশে এম.এ., বি-এড করে
বসে আছে। বেকার। চাকরির চেষ্টা করতে করতে হতাশ। এতদিন বাবা যা পেনশন পেতেন তার অর্ধেক সংসারে দিতেন। অনিল ও বাবার ভরণপোষণের খরচ। বাকিটা
থেকে নিজের ডাক্তার, ঔষধ-পত্র ইত্যাদির খরচ চলত। অতীনবাবু হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের হেড মাস্টার
ছিলেন। পেনশন পেতেন। মৃত্যু সবকিছু স্তব্ধ
করে দিয়ে গেল। আজ থেকেই পেনশন বন্ধ। এরপর অনিলের কী পরিণতি কী হবে ভাবছে।দাদা বৌদিদের
যা মতিগতি, আলাদা হয়ে
যাওয়াটা শুধু সময়ের অপেক্ষা। দুই বৌদির মধ্যে খিটিমিটি লেগেই থাকে। একমাত্র বাবার জন্য
সিদ্ধান্ত নিতে সাহস পায়নি। অনিলের দায়িত্ব যে কেউ নেবে না সে নিশ্চিত। হয়তো নিজের
ব্যবস্থা নিজেকেই করে নিতে হবে। সমূহ সমস্যাগুলোই ভেতর গভীরে গিয়ে নাড়া দিচ্ছে। একমাত্র
কন্যা অনামিকা কারও প্রতি যে ক্ষোভ পোষণ করে আছে তা নয়। ভাল পাত্র দেখে বিয়ে দিয়েছে।
মনের মত বর, ঘরও পেয়েছে।
দাদারাও বোনকে খুব ভালবাসে। মেয়েদের বাপের বাড়ি বলে শক্ত একটা খুঁটি থাকে। সেই খুঁটি
অনেক বলভরসা, সাহস যোগায়।
সেটা বোধহয় এবার আলগা হয়ে গেল। বছর খানেক আগে মা চলে যেতেই প্রথম উপলব্ধি হয়। জামাইষষ্ঠীর
আমন্ত্রণ পেল না। অবশ্য মা নেই জামাইষষ্ঠী কে করবে? পুজোর সময়
অবশ্য বাবা আমন্ত্রণ করেছিল বলে দু'জনেই এসেছিল। এবার তিনিও নেই। ছেলেরা এসব নিয়ে কবে ভেবেছে?
মৃতদেহ
বাড়ির সম্মুখে শায়িত। বাবার স্কুলের শিক্ষক মশাইয়েরা অনেকেই উপস্থিত। অবসরপ্রাপ্ত ও
বর্তমান মিলে বারোজন। এক-এক করে পুষ্প স্তবক দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানালেন। পাড়াপ্রতিবেশি
আট-দশজন বাবাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। বাবার সঙ্গে দীর্ঘদিনের আন্তরিক সম্পর্ক। আত্মীয় স্বজন
জনা চার-পাঁচ।প্রাক্তন ছাত্র অনেককে দেখা যাচ্ছে। কি করে খবর পেল, কে জানে। হেড মাস্টার বলে নয়, তাদের প্রিয় অংকের স্যার। এমন ভাবে অংক বোঝাতেন, মগজে গেঁথে থাকত। সবচেয়ে বড় পরিচয় দরাজ হৃদয়।
অনেক মেধাবী দুস্থ ছাত্রদের বিনা পয়সায় পড়িয়েছেন। বহু ছাত্রকে অর্থ দিয়েও সাহায্য করেছেন।
তারা অনেকেই এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। তারা স্যারকে কি করে ভুলবে?
শববাহী
গাড়ি এসে গেছে। অযথা দেরি করার ইচ্ছে নেই। ঝলমলে আকাশ হলেও রোদের তেজ ক্রমশ বাড়ছে।
দু'টি টাটা সুমো ভাড়া করে আনা হয়েছে।
শ্মশানযাত্রী হিসেবে কেউ যদি যেতে চায়। এদিকে বাড়ির বউ দু'জন তাদের স্বামীদের জোর করে খাবার টেবিলে বসিয়েছে।
ডেড বডি বাড়ির বাইরে বের হওয়ার পর নাকি ভাত খাওয়া বারণ। অফিসের রান্না একপ্রকার হয়েই
গিয়েছিল। তাহলে কেন অভুক্ত থাকবে? ছোট ছেলে অনিল অবশ্য কিছু খেল না। তার
মন ভার।কোনও খাবারই গলা দিয়ে নামবে না।
বেলা এগারোটা
দশ মিনিটে মৃতদেহ গাড়িতে তোলা হল। বাবার পাশে একমাত্র ছোট ছেলে অনিল। বাকি সবাই টাটা
সুমোতে। বাবার আকস্মিক মৃত্যু অনিল এখনও মেনে নিতে পারছে না।গত কয়েক মাস ধরে বাঁচার
স্পৃহা দ্রুত কমে আসছিল। মাস খানেক আগে তার নামে একটি পাঁচ লাখ টাকার চেক লিখে বলেছিলেন, "তোর অ্যাকাউন্টে জমা করে রাখ। কাউকে
বলার দরকার নেই। তোকে নিয়েই আমার যত রাজ্যের চিন্তা। আমি চোখ বুঝলে দাদারা যে তোকে
দেখবে না, স্পষ্ট
বুঝতে পারছি। কি করবি তুই? চাকরির যা বাজার, আদৌ কিছু হবে কিনা ভরসা পাচ্ছি না। টাকাটা যত্ন করে রাখিস। আমার সন্তান হয়ে
যেন অসামাজিক কিছু না করতে হয়। ভাবনা চিন্তা করে খরচ করিস।" তখনই অনিলের বোঝা
উচিত ছিল, বাবা বেশি
দিন নেই। তবে কী ইচ্ছামৃত্যু? আত্মহত্যা !
অতীন সেনকে
বাইরে থেকে রাশভারী মনে হলেও ভেতরটা তুলোর মতো নরম। অত্যন্ত বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ
কিন্তু কিছুটা স্পর্শকাতরও। সংসারের সমস্ত দায়ভার স্ত্রী অনিমা দক্ষতার সঙ্গে
সামলাতেন। ফলে সেদিকটা নিয়ে তিনি মাথা ঘামাতেন না। মাসের প্রথমদিকে সংসার খরচের টাকাটা
অনিমার হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতেন। তিনি
নিজের স্কুল, সামাজিক
কাজ এবং কিছু দুস্থ মেধাবী ছাত্রদের পড়ানো ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। সন্তানদেরও
দায়িত্ব নিয়ে নিজে পড়িয়েছেন। একাগ্রতা ও চেষ্টা থাকলেও মেধা সবার সমান হয় না। তাঁর মেজ ও ছোট ছেলেটি মেধাবী।
বড়টি আবার অতি সাধারণ। ইচ্ছাশক্তি ও নিরন্তর চেষ্টার ফলে ইউনিভার্সিটির সিঁড়ি টপকাতে
পেরেছে। ছোটটি মেধাবী হলেও আজও একটি চাকরি জোটাতে পারেনি।বর্তমান পরিস্থিতির শিকার।
ভাগ্যও বড় অন্তরায়। ডাবলু.বি.সি.এস পরীক্ষায় রিটিনে পাশ করে ইন্টারভিউ দিয়েও চাকরি
হল না। তাকে নিয়েই অতীন সেনের দুশ্চিন্তা। একমাত্র মেয়ে হিস্ট্রিতে এম.এ করেছে। পাশ
করার সঙ্গে সঙ্গে এক লেকচারার পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দিতে পেরে মানসিক স্বস্তি।
স্কুল থেকে
অবসর নেওয়ার পর এক রাতে সব ছেলে বৌমাদের নিজের ঘরে ডাকলেন অতীন সেন।মা অনিমা বললেন," তোদের ডাকা হয়েছে একটি বিশেষ কারণে।
তোরা নিশ্চয়ই জানিস উনি এই মাসেই চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। এতদিন সংসার খরচের জন্য
তোদের কাছ থেকে একটা পয়সাও নিই নি। দরকার হয়নি বলেই চাই নি। এবার দরকার হবে। আমরা চাই, আগামী মাস থেকে সংসারের দায়িত্বটা তোরা নে। কে
কত দিবি তোরাই ঠিক করে নিবি। অবশ্য আমাদের দু'জন ও ছোটখোকার খাওয়ার খরচটা প্রতিমাসে
তোদের দিয়ে দেব। আমাদের দায়িত্ব তোদের নিতে হবে না। তোদের কোনও আপত্তি নেই তো?"
বড় খোকা
বলল," আপত্তি
থাকবে কেন মা? আমরাওতো
চাকরি করি, নাকি? তোমাদের কোনও টাকা দিতে হবে না। বাবা-মাকে কি
খাওয়াতে পারি না?"
"সেটা অবশ্যই পারিস। উনি তো প্রতি মাসে পেনশন পাবেন। টাকা নিয়ে আমরাই বা কি করবো? ও নিয়ে তোরা ভাবিস না।"
বড় বলল," ঠিক আছে মা, তবে তুমি যেমন এতদিন ওদের মাথার উপরে ছিলে, এখনও ঐভাবেই বউদের একটু গাইড করো। তাহলে আর অসুবিধা
হবে না।"
"
সেটা তোকে আবার বলে দিতে হবে? আমি যেমন আছি, তেমনই থাকবো। সব সময়ই বৌমাদের পাশে আছি।"
যৌথ সংসার
বড় জটিল জায়গা। স্বার্থচিন্তা মধুর সম্পর্কতেও চির ধরে। ত্যাগ,ভালোবাসার অভাবে সামান্য চির থেকে বড় ফাটল দেখা
দেয়। তখন শত চেষ্টাতেও মেরামত করা দুঃসাধ্য। কয়েক বছর যেতে না যেতেই মেজ বৌমার আচরণে
একটা পরিবর্তনের আভাস স্পষ্ট হচ্ছে। সবকিছুতেই নিজের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা। যেন
সংসারটা তার সম্পূর্ণ নিজের।অন্যকারোর হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। এমন কি শাশুড়ি মায়ের
কথাও তার কাছে গুরুত্বহীন। এমনটা মেনে নেওয়া কষ্টকর। বিশেষ করে যিনি এতদিন ধরে তিল
তিল করে মনের মতো সংসারটিকে গড়ে তুলেছেন, তাকে খণ্ড-বিখন্ড হতে দিতে পারেন না। কীভাবে এর সমাধান সম্ভব ভেবেও কোনও কিনারা
খুঁজে পাচ্ছেন না। রাতের ঘুম উধাও। প্রয়োজনে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভাবছেন।
রাতে স্বামী
অতীন সেনের কাছে কথাটা তুললেন।
অনিমা বললেন, " তোমাকে একটা কথা বলি, এবার ভাবছি সংসার আলাদা করে দেব। দুই বউয়ের মধ্যে
বনাবনি হচ্ছে না। সামান্য ছুঁতোনাতায় দু'জনে লেগে যাচ্ছে।কেউ কাউকে সহ্য করতে
পারছে না। রোজ রোজ অশান্তি ভাল লাগে না।"
অতীন বললেন," কেন? কি নিয়ে অশান্তি করছে একটু খুলে বলো দেখি।"
" আরে মেজ বউটার অত্যাধিক দেমাক । কথায় কথায় ফোড়ন কাটা স্বভাব।বড় বৌমাকে যা নয় তাই বলে অপমান করে যাচ্ছে। সেদিন বড় বউমা, তার ছেলেটা মাছ ভাজা খেতে ভালোবাসে বলে ওর জন্য একটা মাছ ভাজছিল, মেজ এসে বলল, ওসব চলবে না, ওই মাছ ঝোলে দিয়ে দিন।সবার জন্য একরকম খাবারই হবে।" শুনে আমি বললাম, বড় নাতি মাছের ঝোলের মাছও খাবে, মাছ ভাজাও খাবে। তুমি ভাজো বৌমা। আমাকে কি বলল জানো? বলে, আপনি এখানে নাক গলাতে আসবেন না মা। অনেকদিন খবরদারি সহ্য করেছি। আমরা যখন দায়িত্ব নিয়েছি, এবার আমাদের কথায় চলতে হবে। আপনি আর রান্না ঘরে না ঢুকলেই খুশি হব। " কতবড় আস্পর্ধা ! আমার রান্না ঘরে আমাকেই ঢুকতে বারণ করছে !"
ক্রমশ …………
২য় পর্ব পড়ুন আগামী রবিবার।
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক পরিচিতি -
নিত্যরঞ্জন দেবনাথ পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়ার পানুহাটে ১৯৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন।কাটোয়া কলেজ থেকে বাণিজ্যে স্নাতক। বর্তমানে থাকেন হুগলির চুঁচুড়ায়। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী ছিলেন।অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল-এর অধীন ডিভিশনাল অ্যাকাউন্টস অফিসার পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম গল্প " চেতনা " ছোটদের পত্রিকা শুকতারায় ১৯৯৬ - এর এপ্রিলে প্রকাশিত হয়। এরপর দেশ, শিলাদিত্য, কালি ও কলম,মাতৃশক্তি, তথ্যকেন্দ্র, কলেজস্ট্রিট, কথাসাহিত্য, দৈনিক স্টেটসম্যান, যুগশঙ্খ, একদিন,,সুখবর ইত্যাদি এবং বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে নিয়মিত তাঁর সাহিত্যকীর্তি অব্যাহত। ইতিমধ্যে পাঁচটি গল্প সংকলন ও চারটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক "শতানীক " পত্রিকাটি দীর্ঘদিন ধরে সম্পাদনা করে আসছেন।