ধারাবাহিক বড় গল্প
৮ম এবং শেষ পর্ব
সারাদিন স্বাতী ভাবল,কোনদিন ও কোন ছেলে ওর সাথে ভাব করতে আসেনি। সব মেয়েদের দেখেছে কলেজে ছেলে বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়াতে। একদিন রাজা নামের একটি ছেলে ওর সাথে অনেকক্ষণ গল্প করেছিল। জিজ্ঞেস করেছিল কেন ওকে এত ফ্যাকাসে দেখায়? থ্যালাসেমিয়া শোনার পর সেই যে চলে গেল তারপর আর কোনদিন আসেনি।
স্বাতীরও খুব ইচ্ছে হত অফ পিরিয়ডে ছেলেদের সাথে
মাঠের রোদ্দুরে বসে আড্ডা দিতে। কিন্তু কি মেয়ে কি ছেলে ওর দিকে এমন করুণার
দৃষ্টিতে তাকাত যে স্বাতীর হাড়-পিত্তি জ্বলে যেত। কেন রে,তোরা
আমার সাথে গল্প করলে কি বা ছুলে কি তোদেরও থ্যালাসেমিয়া হয়ে যাবে? এটা তো ছোঁয়াচে রোগ নয়। লেখাপড়া শিখেও এই মানসিকতা কেন? হঠাৎ মরে যাব তখন কি তোদের বন্ধু বলেও আমাকে মনে পড়বে না? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে দিন কাটল। দুপুরে পিসি ডিউটি থেকে বাড়ী ফিরলে স্বাতী
শ্রাবণের আসার কথা বলল। পিসি শুনে বলল, "ভালই তো,
তোর ত কোন বন্ধু ছিল না। তবে আমাদের যা বাড়ী ঘরের ছিরি, তা আমার ঘরেই বসতে দিস। আমিও থাকব তো বিকেলে চা না খাইয়ে ছাড়ব না। ওরা
প্রদ্যোৎদার আত্মীয়,ওরা খুব
বড়লোক। তবে ওরা মানুষ খুব ভাল।
বিকেল সাড়ে পাঁচটার সময় শ্রাবণ এলো। ভেতরে আসতে বলতেই
বলল,
চল না, কাছেই নদী-বাঁধ, সেখানে
গেলে তোমারও ভাল লাগবে।
-
যাবে আমার সঙ্গে? আপত্তি আছে?
-
মোটেই না, আমার আপত্তি কেন হবে? তবে আমার সঙ্গে ঘুরতে দেখলে তোমাকে তোমার বন্ধুরা কিংবা তোমার বাড়ীর লোক
কিছু বলবে না তো? আমি থ্যালাসেমিয়ার পেসেন্ট কিন্তু!
শ্রাবণ এগিয়ে এসে স্বাতীর হাতদুটো ধরে বলল, "এ কথা
ভবিষ্যতে আর কখনো বলবে না, প্রমিস কর,তবেই
তোমার সঙ্গে কথা বলব।”
স্বাতী অবাক হয়ে শ্রাবণের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,ভেতরে চল,একটু বসবে। আমি আমার মাথার জটাগুলো একটু সামলে নেই তারপর বেরুচ্ছি। ভেতর
এসে পিসির সঙ্গে শ্রাবণের আলাপ করিয়ে দিয়ে অন্য ঘরে গেল মায়ের খোঁজে। কোনরকমে
চুলগুলো একটু আটকে নিয়ে মাকে ডেকে বলল, মা ওঠ, বিকেল হয়ে গেছে,আমি একটু বেরুচ্ছি।
তারপর শ্রাবণের সাথে বেরিয়ে এলো রাস্তায়, তারপর পাশের
গলি দিয়ে ওরা বাঁধে উঠে গেল। তারপর মহানন্দার উঁচু পাড়ে এসে দাঁড়াল।
-
বলো,কি বলবে?
শ্রাবণ হো হো করে প্রাণখোলা হাসি হেসে বলল,
-
কিছুই না,তোমার সাথে বন্ধুত্ব করব তাই তোমাকে
বাইরে বের করে আনলাম। সত্যি করে বলতো তোমার ভাল লাগছে না?
স্বাতী তার ফ্যাকাসে বড় বড় চোখদুটো শ্রাবণের চোখের পর
স্থির রেখে বলল,সত্যি বিনা কারণে ডেকে আনলে,অন্যকোন মতলব নেই তো?
- মতলব আবার কি? বাঁ দিকে ঘুরে তাকাও একটা মন্দির দেখতে পাবে।
- ঘুরে তাকাতে হবে না,আমি জানি ওটা একটা কালী মন্দির,আমি রোজ প্রণাম করি।
- এত দূরে এসে?
- মা কালীর মন্দির কি একটা নাকি?
আমাদের পাশের বাড়ীতেই আছে,সেখানেই প্রণাম করি।
আমি রোজ স্নান করে উঠে মই দিয়ে চালে উঠে সেখান থেকেই প্রণাম করি।
- তুমি রোজ ঘরের চালে উঠে কালী
ঠাকুর প্রণাম করো,প্রণাম ভারী মজার তো, বলেই শ্রাবণ আবার হাসতে আরম্ভ করল,হাসি আর থামেই না,ওর হাসিতে স্বাতীও সংক্রমিত হল- দুজনে মিলে হাসতে লাগল।
হাসি থামলে শ্রাবণ বলল,তোমার মধ্যেও যে
এমন মজা লুকিয়ে আছে কে বুঝবে! তা শোন, তোমাকে যেদিন প্রথম
দেখি,তোমার টিকটিকির মত রোগা শরীর হলেও একঢাল অযত্ন বিন্যস্ত
চুল আর বড় বড় মায়াময় চোখদুটো,পারিপাট্যহীন চেহারা আমাকে
মুগ্ধ করেছিল। তারপর থেকে দূরে দূরে থেকেই তোমাকে লক্ষ্য করেছি -কাছে আসলে পাছে
তুমি ভুল বোঝ তাই আলাপ করিনি। তবে তোমার মনে আছে এম.এ. রেজাল্ট জানতে যেই তুমি এলে,সাইকেল থেকে নামতেই আমি সামনে এগিয়ে এসে বললাম, 'কনগ্র্যাচুলেশনস্',
মনে পড়ে? তুমি কেমন বোকার মত চেয়ে রইলে একটা
ধন্যবাদ ও দিলেনা।
- আমার সাথে কেউ কথাই বলে না যে।
তাই খুব অবাক হয়েছিলাম অচেনা একজন আমার সামনে এসে কনগ্র্যাচুলেশন বলাতে। তাই বোকার
মত ভেবলু হয়েই থেকে গেলাম। কিছু মনে কোরো না।
- কি আবার মনে করব! তবে এখন
তোমাকে বেশ স্বাভাবিক লাগছে।
- তোমরা তো চলে যাবে। আর দেখা
হবে কিনা জানিনা, আমার জীবন তো অনিশ্চিত।
- কার জীবন নিশ্চিত বলতে পারো?
শোন, তোমার কথা আমি আমার বাবা মাকে জানিয়েছি,কোথায় তোকে কবে কবে দেখেছি সব বাবাকে বলেছি। মা,বাবা
দুজনেই তোমার সাথে আলাপ করতে চেয়েছে, কাল সকালে তোমাকে আমি
আমার বাবা মার কাছে নিয়ে যাব। সকাল আটটা নাগাদ আসব। বাড়ীতে বলে রেখো।
- তোমার মা তো বাংলা বুঝবেন না,
আমার সাথে আলাপ করবেন কিভাবে?
- আমার মা তোর আমার মতই বাংলা
বলে।
- আশ্চর্য তো! আচ্ছা যাব,চলে এসো।
পরদিন সকালে স্বাতী শ্রাবণের সাথে ওদের বাড়ীতে গেল।
শ্রাবণের বাবা এমন ভাবে কথা বললেন যেন স্বাতী ওদের কতদিনের পরিচিত। আর শ্রাবণের
মা! স্বাতীকে দেখেই 'কি মিষ্টি মেয়ে আমার'বলে
স্বাতীকে একেবারে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন। স্বাতী ওদের আন্তরিকতায় একেবারে যেন
বোবা হয়ে গেল। ভদ্রমহিলার বুকের মধ্যে যেন একটা মা মা গন্ধ পেল। যেন কতকালের চেনা!
বুকের থেকে মুখ তুলে ওনার দিকে তাকিয়ে কেন যেন স্বাতীর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল ঝরতে
লাগল। চোখের জল সযত্নে মুছিয়ে দিয়ে বললেন,কেঁদো না,সব ভাল হয়ে যাবে। কোন দুঃখ থাকবে না। তুমি খুব সুন্দর। স্বাতী অবাক হয়ে
সজল চোখে মহিলার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল শুধু।
সমাপ্ত
লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখিকার পরিচিতি –
যুথিকা চক্রবর্তীর
জন্ম ১৯৪২-এ । মালদায় বেড়ে ওঠেন। সেখানে তার পড়াশোনা
শুরু হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও বাংলায় স্নাতকোত্তর বর্ধমান
বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে। ১৯৬২-তে মালদহ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার
পবিত্র কর্মযজ্ঞে প্রবেশ করে পরবর্তীতে ১৯৭১ থেকে ২০০২ পর্যন্ত সেই বিদ্যালয়ের
প্রধান শিক্ষিকার গুরুদায়িত্ব পালন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন। শুধু তাই
নয়, লেখালেখিতেও তার
সহজাত অধিকার। তিনি সেতার বাদন ও বই পড়তে ভালোবাসেন। বর্তমান ভ্রমণকাহিনীটি তার
অন্যান্য পরিচয়কে সমুন্নত করে তুলেছে।
বিভিন্ন
পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত বই একটি।