শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব
(১৮৩৫-১৮৮৬) এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১- ১৯৪১) বাংলা তথা ভারতীয়
সমাজ-সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে দুই উজ্জ্বল মহাপুরুষ, দুই
উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। মানবকল্যাণ তথা মানববিকাশের উদ্দেশ্যে এঁরা নিজস্ব পথে
হেঁটেছেন, সনাতনী ভারতীয় দর্শনের
ভিত্তি ভূমির উপর দাঁড়িয়ে। মানুষের উত্তরণের মাধ্যম যে ভক্তি ও প্রেম- দুই
জ্যোতির্ময় পুরুষের স্ব স্ব কর্মপ্রকৃতির মাঝে তা সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে কথোপকথন বা চিন্তার বিনিময় তেমন ভাবে হয়নি। কারণ খুঁজতে যাওয়া কিংবা অনুধাবন করার চেষ্টা বৃথা। তবে এটুকু বলা যায় যে, দু'জন দু'জনের অন্তরপ্রকৃতির সমচিত্রের আভাস অনুভব করতেন। সম্ভবত সেকারণে অত্যন্ত কাছের জন হিসেবে বাহ্যিক পরিচয়ের প্রয়োজন দু'জনের কারোর কাছেই অনুভূত হয়নি। শ্রীরামকৃষ্ণ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে অনেকবার
গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫)-এর সঙ্গে বেশ কয়েকবার তাঁর কথাবার্তা হয়েছিল। এছাড়া, ব্রাহ্মসমাজের অনুষ্ঠানেও যেতেন তিনি। সেখানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর দেখাও হয়েছে। কিন্তু, সেভাবে কথা হয়নি।
বৈষ্ণব চন্দ্র বসাকের সঙ্গে যৌথভাবে নরেন্দ্রনাথ দত্ত (পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দ) 'সঙ্গীত কল্পতরু' নামে একটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করেন। সেখানে রবীন্দ্রনাথের আটটি গান স্থান পায়। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম 'কালী কালী বলো রে আজ' গানটি সাকার মায়ের উপাসক শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জন্যেই লেখা হয়েছিল বলে গবেষকদের ধারণা। উল্লেখ্য, নরেন্দ্রনাথ তথা স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২)-এর গুরুদেব ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের জীবদ্দশায় তাঁর সঙ্গে তরুণ রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিয়ে অপার রহস্য সৃষ্টি হলেও ওই তরুণ কবির লেখা গানের বিশেষ ভক্ত ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। নরেন্দ্রনাথ বা নরেন একাধিকবার রবীন্দ্রনাথের একাধিক গান রামকৃষ্ণদেবকে গেয়ে শুনিয়েছেন। নরেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণকে যে রবীন্দ্র সঙ্গীতগুলো শুনিয়েছিলেন সেগুলো হল- 'গগনের থালে রবিচন্দ্র-দীপক জ্বলে...', 'দিবানিশি করিয়া যতন, হৃদয়েতে রচেছি আসন...', 'তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা...' ইত্যাদি। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভালভাবেই জানতেন তাঁর চেনাগায়ক নরেন্দ্রনাথ ওরফে নরেন দত্ত দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে যাতায়াত করেন এবং অন্যান্য গানের পাশাপাশি তাঁর লেখা গানও ঠাকুরকে গেয়ে শোনান। গবেষকদের ধারণা- নরেন্দ্রনাথ তথা বিবেকানন্দ বিভিন্ন সময়ে প্রায় ত্রিশটি রবীন্দ্রনাথের গান শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে শুনিয়েছিলেন। স্মর্তব্য, নরেন্দ্রনাথ বা নরেনের কণ্ঠবাহিত হয়ে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি সঙ্গীতরূপে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে নিঃসন্দেহে এক গভীর সংযোগ ঘটাত। এভাবেই হয়তো এক দার্শনিক অনুভূতির আবহও নির্মিত হত।
শ্রীরামকৃষ্ণের উপস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ কোনও অনুষ্ঠানে সঙ্গীতে অংশ নিয়েছেন এমন দৃষ্টান্তও আছে। যেমন, ১৮৮৩ সালের ২ মে কাশীশ্বর মিত্রের বাড়ির ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে। কলকাতার নন্দনবাগানে অবস্থিত এই মন্দিরে চৈতী কৃষ্ণাদশমী তিথিতে ব্রাহ্মসমাজের অনুষ্ঠানে শ্রীরামকৃষ্ণসহ পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী (১৮৪৭-১৯১৯) প্রমুখের সামনে সমবেত সঙ্গীতে নেতৃত্বে দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এ সম্পর্কে ৫ মে (১৮৮৩) স্টেটসম্যান পত্রিকায় একটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। এছাড়াও, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মাঘোৎসবে, অন্যান্য জায়গায় ব্রাহ্মসমাজের অনুষ্ঠানে যেখানে শ্রীরামকৃষ্ণদেব কয়েকবার গেছেন, সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সেসব জায়গায় তাঁর দেখা হয়ে থাকতে পারে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুবিশাল সাহিত্যভাণ্ডারে তেমনভাবে স্থান না পেলেও শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে কিন্তু উপেক্ষিত বলা যায় না। ১৯৩৩ সালে লেখা রবীন্দ্র-উপন্যাস 'মালঞ্চ' - তে শ্রীরামকৃষ্ণের উল্লেখ এসেছে নানাভাবে। এই 'আসা'-র ধরণে আঁচ করা যায়, রবীন্দ্রনাথের অন্তরে শ্রীরামকৃষ্ণের গ্রহণযোগ্যতার স্বরূপটি কেমন ছিল। উক্ত উপন্যাসের কাহিনীটি ত্রিকোণ প্রেমের প্রেক্ষাপটে লেখা। অসুস্থ নীরজা তাঁর স্বামীকে অন্য নারীর দুনিয়ায় হারিয়ে ফেলার আশংকায় জর্জরিত। রবীন্দ্রনাথের বর্ণনায় নীরজার ঘরে রয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণের ছবি। একসময় এই নারী ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ছবির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন, "বল দাও ঠাকুর, বল দাও, মুক্তি দাও মতিহীন অধম নারীকে।.." 'মালঞ্চ' উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ হয়ে যান অন্যরকম। যেন অনেকটা অচেনা। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি সাধারণভাবে নীরব থাকা রবীন্দ্রনাথের কলম যখন উক্ত উপন্যাসের নায়িকার মুখ থেকে উচ্চারিত এই প্রার্থনা লিখে ফেলে, তখন অনেক কিছুই যেন আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। তার জ্বলন্ত প্রমাণ শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মশতবর্ষ (১৯৩৪) উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখলেন একটি ১২ লাইনের নিবেদনাত্মক কবিতা- 'পরমহংস রামকৃষ্ণদেব'। তিনি নিজে সেটার ইংরেজি অনুবাদও করেন 'To the Paramhansa Ramkrishna Deva' শিরোনামে। বাংলা কবিতাটি এরূপ: "বহু সাধকের/ বহু সাধনার ধারা।/ ধেয়ানে তোমার/ মিলিত হয়েছে তারা।/ তোমার জীবনে/ অসীমের লীলাপথে। নূতন তীর্থ। রূপ নিল এ জগতে; / দেশ বিদেশের/ প্রণাম আনিল টানি/ সেথায় আমার/ প্রণতি দিলাম আনি।" রবীন্দ্র-অন্তরে থাকা শ্রীরামকৃষ্ণ এভাবেই প্রস্ফুটিত হতে থাকেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ শতবার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৩৭ সালের ১ থেকে ৮ মার্চ কলকাতায় টানা ৮ দিন টাউন হল ও কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে বিরাট ধর্ম মহাসভা হয়। সকাল-সন্ধ্যা মিলিয়ে মোট ১৫ টি অধিবেশনে দেশ-বিদেশের বিদগ্ধ-জনরা ভাষণ দেন। ওই অনুষ্ঠানের সঙ্গে মহাত্মা গান্ধী, রোমা রোলাঁ, ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ, স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, এ. কে. ফজলুল হক, শরৎচন্দ্র বসু, ডা. বিধানচন্দ্র রায়, ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখের নাম জড়িয়ে রয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণ শতবার্ষিকী উপলক্ষে বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনের ৩ মার্চের সায়াহ্নের অধিবেশনের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে ২৫ মিনিটের এক সুললিত ইংরেজি ভাষণ দেন। ৪ মার্চ (১৯৩৭) আনন্দবাজার পত্রিকায় উক্ত ইংরেজি ভাষণের বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সুদীর্ঘ ভাষণ শুরু করেন এভাবে: "বন্ধুগণ। কালকৌলিন্যমণ্ডিত ধর্মমত গুলি ঈশ্বর সম্বন্ধে যে ধারণা শিক্ষা দেয়, ঈশ্বর সম্বন্ধে আমার তেমন ধারণা নাই, কাজেই ধার্মিক বলিতে সচরাচর যাহা বুঝায় সেই হিসাবে আমি ধার্মিক পদবাচ্য কি-না তাহাতে আমার সন্দেহ আছে, সুতরাং আমি যখন এই বিদ্বজ্জন সংসদে বক্তৃতা করিতে অনুরদ্ধ হই তখন স্বভাবতঃই আমি ইতস্ততঃ করিয়াছিলাম। কিন্তু যে মহাত্মার স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই মহাসম্মেলনের আয়োজন তাঁহার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবশতঃ আমি সেই অনুরোধ রক্ষা করিতে সম্মত হই। পরমহংসদেবকে আমি ভক্তি করি। ধর্মনৈতিক ধ্বংসবাদের যুগে তিনি আমাদের আধ্যাত্মিক সম্পদ উপলব্ধি করিয়া উহার সত্যতা প্রমাণ করিয়াছেন, তাঁহার প্রশস্ত মন আপাত পরস্পর বিরোধী (রূপে) প্রতীয়মান বিভিন্ন সাধন পদ্ধতির সত্যতা উপলব্ধি করিয়াছিল এবং তাঁহার আত্মার সারল্যে পন্ডিত ও ধর্মবেত্তাদের আড়ম্বর ও পাণ্ডিত্যাভিমান চিরধিকৃত।...." বিদগ্ধজন সহ সর্বসাধারণ শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কিত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তব্যে অভিভূত হন। তাঁর এই বক্তব্যের মূল সুর সারা বিশ্বে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।
পরিশেষে, শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে চাণক্যের ভাষায় বলা যায়- "অহো বত বিচিত্রাণি চরিতানি মহাত্মানাম্।" অর্থাৎ মহাত্মাদের চরিত্র বড়ই বিচিত্র। তাই এ নিয়ে অতি সরল উপসংহার টানা উচিত নয়।
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক পরিচিতি –
ড.বাসুদেব রায়ের জন্ম ১৯৬২ সালে। কবিতার মাধ্যমে সাহিত্যের জগতে আত্মপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশিত বই মানব' (কাব্যগ্রন্থ), দ্বিতীয় বই রক্তের বাঁধন (উপন্যাস)। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পদচারণা করলেও প্রবন্ধ সাহিত্যের দিকে তার ঝোঁক বেশি। তদুপরি গবেষণামূলক প্রবন্ধ তথা বই লিখতে তিনি অধিকতর উৎসাহী। গবেষণামূলক বইয়ের পাশাপাশি সাধু-মহাপুরুষদের জীবনী-গ্রন্থ, একাঙ্কিকা ইত্যাদি সম্পাদনাও করেছেন তিনি।
ড.বাসুদেব রায়ের বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। হার উল্লেখযোগ্য গবেষণা গুলোর মধ্যে রয়েছে মনসামঙ্গল কাব্যে দেবদেবীর স্বরূপ', চণ্ডীমঙ্গল ও অন্নদামঙ্গল কাব্যে দেবদেবীর স্বরূপ, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে সমাজ-চিত্র ইত্যাদি। তাঁর যৌথ রচনা ও উপেক্ষণীয় নয়।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বাসুদেব রায় নিরলস ভাবে লিখে চলেছেন। এছাড়াও নতুন করে তিনি একক ও যৌথভাবে বেশ কয়েকটি গবেষণামূলক কাজে হাত দিয়েছেন। নিয়মিত বিভিন্ন e magazine-এ লেখেন।