Advt

Advt

rekha-nather-duti-anu-galpo-aamdani-ebong-upahar-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-রেখা-নাথের-দু'টি-অণুগল্প-আমদানী-ও-উপহার

 

rekha-nather-duti-anu-galpo-aamdani-ebong-upahar-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-রেখা-নাথের-দু'টি-অণুগল্প-আমদানী-ও-উপহার

আমদানী

রেখা নাথ

 আপনিই লেখিকা পূর্ণিমা রায়?

পূর্ণিমা একটু লজজা পেলেন। সংকোচে বললেন এই একটু-আধটু লিখি আর কি!

তিথি বলল--একটু আধটু! আপনার লেখা তো আমি দিল্লির সমস্ত বাংলা পত্র-পত্রিকায় পড়ি। আপনার গল্পগুলি আমার খুব ভাল লাগে। আপনার কোনও গল্প সংকলন আছে কি?

তার গল্প কারো ভাল লেগেছে জেনে পূর্ণিমার মন প্রাণ এক ভাল লাগার আবেশে ভরে উঠল। পাঠকের কাছ থেকে পাওয়া এই পুরস্কার তিনি সানন্দ চিত্তে গ্রহণ করলেন। স্মিত হেসে পূর্ণিমা বললেন-ধন্যবাদ, না, এখনও সেটা হয়ে ওঠেনি। তুমিও কি লেখার জগতে আছো!

না, না, আমি একজন শ্রোতা মাত্র। বেঙ্গল এ্যাসোসিয়েশানের আমি একজন মেম্বার। আমি আপনাদের এই গল্প পাঠের আসরে এসেছি আপনাদের গল্প শোনার জন্য।

পূর্ণিমা রায় একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। আজকাল কাকে নিজের বিষয়ে বলতে লজ্জা পান। লেখিকা শুনলেই হাজারটা প্রশ্ন অবধারিত ভাবে ধেয়ে আসে। আপনার লেখা কোথায় কোথায় প্রকাশিত হয়? আপনার লেখা কি প্রকাশিত হয় 'দেশে','সানন্দায়'? বাংলায় লিখে আপনার কত আমদানী হয়? ইত্যাদি, ইত্যাদি। তিনি কখনই নিজেকে লেখিকা হিসাবে জাহির করেন না। তবু ঘরে বাইরে সব জায়গায় এই সব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। হঠাৎই কালকের ঘটনাটা চোখের পর্দায় ভেসে উঠল।

মা ও মা এদিকে একটু আসবে।

-একটু দাঁড়া বাবা, আসছি। এই হাতের কাজটা সেরে আসছি।

মা ওমা তোমার কতক্ষণ লাগবে। তাড়াতাড়ি এসো আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। ছেলের গলায় অধৈর্য ও অসন্তোষ ঝরে পড়ে।

কর্তাও ডাক দিলেন -- শুনছো তোমার ওই কাজটা পরে করলেও হবে। খোকার দেরী হয়ে যাচ্ছে।

পূর্ণিমা লেখাটা তাড়াতাড়ি সম্পূর্ণ করে খামে ভরে রাখলেন। আর একবার পড়ে দেখার ফুরসৎ নেই। পরে-পরে করে আজ চারদিন হয়ে গেল। লেখাটা সম্পূর্ণ করতে। পৃথাকে কথা দিয়েছেন লেখাটা তিনি আজই দেবেন। মেয়েটা চার দিন ধরে ঘুরছে লেখাটার জন্য। রাজধানী থেকে মহিলা গল্প লেখিকাদের নিয়ে একটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হচ্ছে তারই জন্য একটি গল্প চেয়েছিল পৃথা। পূর্ণিমা দেখলেন আজকের ডাকে একটা চিঠিও এসেছে কিন্তু ইচ্ছে সত্ত্বেও খুলে আর দেখলেন না। ওদিকে ছেলে সমানে তাড়া দিচ্ছে। খোকা বাড়ি এলে তিনি আর সময় পান না। তার ফাই-ফরমাশ পুরো করতে-করতেই কোথা দিয়ে যে সময় কেটে যায় টেরই পান না।

কেন ডাকছিলিস্ খোকা? নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন পূর্ণিমা।

...আমার স্যুটকেসটা ঠিকমত বন্ধ হচ্ছে না। তুমি জিনিষগুলো গুছিয়ে দাও। আমি এক্ষুণি বেরিয়ে যাব।

একটা ছোট্ট স্যুটকেস বন্ধ করতেই খোকা হিমসিম খেয়ে গেছে। ছেলের কাণ্ড দেখে পূর্ণিমা হেসে ফেললেন। কে বলবে এই ছেলে এক বিশাল মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে আসীন। এখনও নিজের ছোটখাটো কাজগুলি ঠিকমত গুছিয়ে করতে পারে না খোকা।

পূর্ণিমা হাসতে-হাসতে বললেন---তোর স্যুটকেসটা তো আমি ভাল করে গুছিয়ে দিয়েছিলাম। আবার ঘাঁটাঘাঁটি করল কে?

--- না, মানে আমিই একটা অফিসের ফাইল রাখতে ভুলে গিয়েছিলাম। সেটা রাখতে গিয়েই সব ওলট-পালট হয়ে গেছে। আচ্ছা,মা,তুমি যে এই সব লেখালেখি করো এতে তোমার কিছু আমদানী হয়,না স্রেফ বেগার খাটা!

স্রেফ বেগার খাটা। এক পয়সারও আমদানী নেই উপরন্তু নিজের গাঁটের পয়সা খরচা করে লেখা পাঠায়। ঠাট্টার সুরে স্বামী সুনন্দ বললেন।

নিজের মনোব্যথা চেপে রেখে পূর্ণিমা স্মিত হেসে বললেন --খোকা, সংসারে তো আমি অহরহ বেগার খাটি, তাই নয় কি? কখনও দায়বদ্ধতায় কখনও নিজের ভাল লাগে বলে। সব কাজ, সব জিনিষই কি টাকার মাপদণ্ডে মূল্যায়ন করা যায়!

খোকার যাওয়ার পর পূর্ণিমা চিঠিটা খুললেন --বারাণসী থেকে 'আভাস' পত্রিকার তরফ থেকে তাঁকে অভিনন্দন ও সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছেন পুরস্কার গ্রহণ করার জন্য। তাঁর গল্পটি গল্প প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে। তাঁর প্রথম আমদানী। ভাবলেন ছেলেকে খবরটা মোবাইলে দেবেন। কিন্তু পরক্ষণেই মত পাল্টালেন। টাকার অঙ্কটা খোকাদের কাছে খুবই নগণ্য। কিন্তু তাঁর কাছে অমূল্য। তাঁর এই ভাল লাগাটা নিজের মণিকোঠায় গচ্ছিত রাখলেন সযত্নে।

 -------------------------------------------------------------------------------------------

উপহার

রেখা নাথ

ওমা আপনি খাচ্ছেন? তাহলে থাক্। আমি পরে আসব। মেয়েটি লজ্জিত হয়ে বলে।

---না, না, আপনি নিয়ে যান। আমি বরং পরে খাব। আপনি অন্য দোকানে পেয়ে গেলে, আবার কি আমার দোকানে ফিরে আসবেন? অবশ্য এই ভর দুপুরবেলা অন্য কোনও দোকান খোলা পাবেন না। আমি নতুন খুলেছি তো,তাই দুপুরবেলাও খুলে রাখি।

---ঠিক আছে ততক্ষণ আমি এমব্রয়েডারির সুতোগুলো দেখছি। আপনি খেয়ে নিন।

ছেলেটি বলে ওঠে, না, না, কাস্টমারকে অপেক্ষা করানো আমার নীতি বিরুদ্ধ। আমি পরে খাব।

---দেখুন, খেতে-খেতে উঠতে নেই। আমার মা বলেন। আপনি খেয়ে নিন। ততক্ষণ আপনার দোকানের জিনিষ-পত্তরগুলো দেখি। আর আপনি যদি অচেনা কাস্টমারের সামনে খেতে লজ্জা পান, তাহলে আমি বাইরে শোকেসে সাজানো জিনিষগুলো দেখছি।

---মাফ করবেন, আমার জন্য, রোদ্দুরে দোকানের বাইরে কষ্ট করে দাঁড়াতে হবে না। আপনি ভেতরেই বসুন। আমি আরাম করে খেয়ে নিচ্ছি। এরকম কাস্টমার পাওয়া পরম ভাগ্য যে দোকানীরও দুঃখ-কষ্ট বোঝে।

---ছেলেটি খেতে খেতে জিজ্ঞেস করে, আপনি কলকাতায় বেড়াতে এসেছেন?

-কি করে জানলেন? আমার বাংলা শুনে। হাসি ভরা মুখে মেয়েটি। জিজ্ঞেস করে।

ঠোঁটে,চাপা হাসির আভাস টেনে,ছেলেটি বলে আপনার বাংলায় হিন্দীর টান আছে ঠিকই কিন্তু আপনি কলকাতার মেয়েদের মত নন। 

-তাই বুঝি। (মেয়েটির কৌতুক ভরা চোখে বিদ্যুৎ ঝিলিক দেয়) আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমি এলাহাবাদের মেয়ে। কলকাতায় মামার বাড়ি,গরমের ছুটি কাটাতে এসেছি। দুপুরে মামীর কাছে এমব্রয়েডারি শিখি তাই আপনার লেডিস্ করনারে দারস্থ হয়েছি। এই তো কাছেই বাড়ি।

আপনার নাম?

ইচ্ছান।

বাঃ খুব সুন্দর, আনকমোন্ নাম।

আপনার?

অপূর্ব।

সময় দ্রুত দৌড়ায়। সেই তালে কথার খেলও দৌড়তে থাকে। সব নদী গতিপথ হারায় মোহনায়। একদিন কথার নদী নিস্তব্ধতার সমুদ্রে ডুব দেয়।

-------------------------------------------------------------------------------------------

সুন্দর এমব্রয়েডারি করা রুমালের কোণে A লেখা ৬ খানি রুমালের প্যাকেট হাতে নিয়ে অপূর্ব বলে---চলে যাচ্ছ? যেতে তো হবেই। (শিশির বিন্দুর মত নিঃশব্দে ঝরে পড়ে এক রাশ বিষণ্ণতা)

-উপহারটি খুবই সুন্দর।

- না, না, উপহার তো নয়। রুমালের দাম তো আমি নিয়ে নিয়েছি।

৬টি রুমালের দাম পঞ্চাশ পয়সা। এরকম বিজনেস্ করলে আপনি রাতারাতি লাখপতি হয়ে যাবেনদেখছি। সকৌতুকে অপূর্ব বলে।

রুমাল উপহার দিলে তার সঙ্গে বিচ্ছেদ হয় কিংবা ঝগড়া হয়। তাই রুমালের দাম আমি আপনার থেকে নিয়ে নিয়েছি। রুমালগুলি নিজে তৈরী করেছি তাই আপনাকে দেওয়ার ইচ্ছে সামলাতে পারলাম না।

- বিচ্ছেদ তো হয়েই গেল । তাই না!

দৃষ্টির বাইরে চলে গেলেই বুঝি বিচ্ছেদ হয়ে যায়? প্রশ্ন খচিত চোখে ইচ্ছান তাকায়।

ইচ্ছান, ইচ্ছান তুমি তো আমার হৃদয় মাঝে সাম্রাজ্য গড়ে নিয়েছো, তাই তো তোমায় দৃষ্টির সীমায় আবদ্ধ করে রাখতে চাই। কথাগুলি ভাবল অপূর্ব, কিন্তু বলতে পারল না। অস্ফুট উচ্চারণে শুধু বলল-ষ্টেশনে যাব। আবার কবে আসবে?

লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।

 লেখিকার পরিচিতিঃ 

যদিও জন্ম পলাশীপাড়ানদিয়া জেলাপশ্চিমবঙ্গকিন্তু তাঁর শৈশববেড়ে ওঠাশিক্ষা-দীক্ষা সব এলাহাবাদেই। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থশাস্ত্রে এম.এ.। ১৯৮১ সালে এলাহাবাদ থেকে একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা "তূণীর" প্রকাশ করতেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় (দেশে ও বিদেশে) লেখা প্রকাশিত হয়। হিন্দী ও ইংরাজিতেও লেখা প্রকাশিত হয়েছে। পানামার কবিরোখেলিও সিনান এর দশটি স্প্যানিশ কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেছেন। 'অনুশীলন পত্রিকা'সুইডেন থেকে রাইটার্স অ্যাওয়ার্ড ২০১৩ সালে পেয়েছেন। ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছে "ঈশ্বর ও মানুষ" ( অণু গল্প ও ছোট গল্প সংকলন)। লেখিকার অভিজ্ঞতাজাত কোভিড  সংক্রান্ত বই "কোভিড-১৯ আমার জীবন আমার লড়াই" গাঙচিল থেকে প্রকাশিত হয়েছেডিসেম্বর ২০২২ সালে।