ধারাবাহিক বড় গল্প
৩য় পর্ব
(৬)
ওই অতক্ষণ ধরে কার সঙ্গে কথা
বলছে ছেলেটা । মোবাইলটা ধরে ধরে ডান হাত ব্যাথা হয়ে গেলে, কানে দুটি ইয়ার ফোন
লাগিয়ে কথা বলছে । অন্ধকার ঘরটির ওপ্রান্তের জানলায় যাচ্ছে , আবার ফিরে আসছে
। সন্দেহ হচ্ছে , তবু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে
করছে না । মাকে ওদিকে দাঁড়িয়ে ওর দিকে
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখেও বাণীপ্রিয়ের ভাবের কোন পরিবর্তন হল না। কথায় সে এতটাই ডুবে গিয়েছে ।
ছেলে বর্ণালীর সঙ্গে কথা বলছে
এটি মাথায় চকিত খেলে গেলেও তক্ষুণি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল না । নন্দিনীর
মন স্বভাবতই একটু সন্দিগ্ধ প্রকৃতির । তিনি
মুখ নাড়া দেখে , মুখের ভাব দেখে আন্দাজ করতে চেষ্টা করেন , মন বুঝতে চেষ্টা
করেন । কেমন একটা অসহায়ভাব লাগে নন্দিনীর
। যেন সেনাপতির নজরের আড়ালে যোদ্ধারা অপ্রিয়
কিছু করে বসল । কিন্তু কিছু করার নেই ।
বাণীপ্রিয় যখন ফোন নামায় তখন তার চোখ চকচক করছে । এই চোখ আরো
অস্বস্তি দেয় নন্দিনীকে । কী করবে? পরিচয় বিনিময়ের উদ্যোগটা যে তারই । ঘরটি থেকে বেরিয়ে মাকে টেবিলে
ভর দিয়ে দাঁড়াতে দেখে বাণীপ্রিয়ে বলে ওঠে
,
-
একি মা , এখানে ?
-
তোকে আমি জিজ্ঞেস করব না কার
সঙ্গে কথা বলছিস, কেবল যে সব পাত্রীদের বাড়ির সঙ্গে কথাবার্তা চলছে , তাদের আগ
বাড়িয়ে ফোন করিস না । বড্ড অশোভন দেখায় ।
অপ্রস্তুত হয়ে বাণীপ্রিয় গম্ভির ভাবে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে
। যেন তার বদমেজাজ ফিরে আসছে । তারপর
অকারণে বেসিনে গিয়ে মুখ প্রেক্ষালন করে ।
মুখে জল দেয় । মুখে একটা ঠান্ডা ভাব পেয়ে মাথার অস্বভাবিক উত্তাপটা কোনমতে
শান্ত করে ।
তবে তাঁর আশঙ্কা অমূলক নয় ।
বাণীপ্রিয় ফের মশগুল থাকে সোশাল মিডিয়ায় ।
অরুণের এখন ওঠার অবস্হা নেই ,
পা জড়িয়ে যাচ্ছে , অথচ বলবার খুব ইচ্ছে । মনে হচ্ছে তিনিই পৃথিবীর একমাত্র
স্পষ্টবক্তা পুরুষ । মা-ছেলের মধ্যে এই
আন্দোলনে তাঁর কিছু বলা দরকার ।
-
শোন প্রিয়র ইচ্ছে হয়েছে, ফোন করেছে । তোমার আড়ি পাতার কী দরকার । যখন
ও সাত সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে তখন? তখন ওকে নজরে রাখতে পার? আর ওই মেয়েটির দুটির একটিও
বেশী চোখ দেখিনি । যত সব অ্যাবসার্ড গল্প ।
একসঙ্গে কথাগুলি বললে অরুণ ।
জড়িয়ে জড়িয়ে ।
পাত্রের মায়ের উৎসাহ একদম চলে গিয়েছে । কিন্তু পাত্রের উদ্যমের অন্ত
নেই ।
--------------------------------------------------------------------------------------------
আজ অনেকক্ষণ থেকে এসে বসে আছে
বাণীপ্রিয় । হাতে কয়েকটি কার্ডের নমুনা । কী একটি দুর্বোধ্য কারণে আর এগোতে নিষেধ
করেছিলেন নন্দিনী , কিন্তু সেসব অগ্রাহ্য
করে বাণীপ্রিয় কলেজস্ট্রিটের একটি দোকান থেকে গোটা পাঁচেক নমুনা নিয়ে এসেছে। বিয়ে আর বৌভাত , পাত্রপক্ষ আর
পাত্রীপক্ষ একসঙ্গে করলে সময় আর খরচ দুইই বাঁচে ।
আজ এই অগ্নিমূল্য বাজার আর স্বল্পছুটির জামানায় এমন প্রস্তাব বাণীপ্রিয়
দিতেই লুফে নিয়েছিলেন কন্যার পিতা । আশুতোষ এই বিশেষ কাজটি অর্থাৎ বিয়ে বাড়িভাড়া
করার প্রক্রিয়াটিতে বেশ অভিজ্ঞ । তিনি
একটি বাড়ি ঠিকও করে ফেলেছেন । শীতকাল
হওয়ায় ট্যাঁকে এসির কামড়ও লাগছে না ।
চটির শব্দে তাকিয়ে দেখে বর্ণালী ঢুকছে । সে বোধহয়
অনেক সকাল পর্যন্ত ঘুমিয়েছে ।
এলোমেলো চুল পিঠ পর্যন্ত এসে পড়েছে । গায়ে একটি
হলুদ নীল ডোরাকাটা হাউসকোট ।
তার ওপর নীল সোয়েটার । বর্ণালী
হাসতে হাসতে বললে ,
-
বেশ , কার্ডের এতগুলি নমুনা ! কোনটা
ছেড়ে কোনটা নি ।
তবে আমার পিঙ্ক রঙের কার্ডটা পছন্দ ।
কার্ডগুলি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া
করতে থাকে বর্ণালী । তারপর একটি কার্ড
নিয়ে নিজেকে হাওয়া করার ভঙ্গিতে নাড়াতে থাকে ।
-
গরম লেগে গেল ! আপনার স্পীড
ফ্যান্টাস্টিক ।
বর্ণালীকে দেখে বাণীপ্রিয়র বুকের ভিতর তোলপাড় হয় । সে সব
অনুভুতি ভাষায় বোঝানো যায় না । কেবল
সামুদ্রিক ঝড় শেষ হয়ে ভোরে এক
চিলতে ডাঙা দেখতে পাওয়ায় যে আনন্দ তার কথা মনে পড়ে যায় । বছরের অধিকাংশ সময় নারীসঙ্গ বিবর্জিত বাণীপ্রিয় কার্ড ধরে থাকা হাতদুটির দিকে তাকায় ।
তার যে নেশা লেগেছে , এটুকু আর
নিজের থেকেও গোপন রইলে না ।
আশুতোষ আজ সাদা একটা পাজামা আর
আকাশি নীল রঙের একটি জামা পড়েছেন। কার্ডগুলি উল্টেপাল্টে দেখে বললেন ,
- লাল রঙের ওপর সোনার রঙে লেখা
, এই কার্ডটা ভাল । প্রজাপতায়ঃ নমঃ কথাটা
অবশ্য আর একটু বড় হরফে হলে ভাল হত । তবে নেগোশিয়েট করলে দাম কমতে বাধ্য । কিছুটা অ্যাডভান্স দেবে , কিছু টাকা বাকি রাখবে
। নাহয় আমি যাব । কবে যেতে চাও ? কাল
? সব দেখেশুনে নিতে হবে । এটা সমুদ্র নয়
যে সবাই দিলদরিয়া ।
বর্ণালী বাবার দিকে তাকিয়ে দেখে
ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে বললে ,
- বিয়ে তো একবারই হবে ড্যাডি । তাতে একটু না হয় খরচই করলে । আই অ্যাম ইয়োর ওনলি ডটার ।
কথাটা যেন লুফে নেয় বাণীপ্রিয়
। বর্ণালীর দিকে চেয়ে গদগদ চোখে বলে ,
- একদম ঠিক কথা বলেছেন । মার্চেন্ট নেভিতে একটানা তিনমাস এমন বোরিং গেছে
, একটু জাঁকজমক করা দরকার ।
(৮)
কিন্তু তিনটি চোখের
রহস্যটা জমাট বেঁধে ভারাক্রান্ত করে
রেখেছে নন্দিনীর মন । তাঁর দুশ্চিন্তার
আরো কারণ - কার্ড ছাপা হয়ে গিয়েছে , রেজিস্ট্রির দিনক্ষণ স্থির । কানাঘুষোয় শুনতে
পেয়েছেন , মেয়ে মৃগির ওষুধ খায় । নিজের অদৃষ্টকে দুষতে থাকেন নন্দিনী । তাঁর
সদাজাগ্রত দৃষ্টি এড়িয়ে কী করে এমন একটা মাল গছিয়ে দিলে ! এই রকম একটি অপ্রাকৃত
অনুচ্চমনস্কতাপূর্ণ বাক্য তাঁর মন,থুড়ি
তাঁর ইনার মাইন্ডে মুহুর্তের জন্যে খেলে যায় । কিন্তু বলার কোন উপায় নেই নন্দিনীর। এখন আর বাবা মা বিয়ে দিচ্ছে
বলার জায়গা নেই , স্বীকার করতেই হচ্ছে , বাণীপ্রিয়র এমন উদ্যমী আর স্তিতধী রূপ
তাঁর জানাই ছিল না । দশচক্রে ভগবানেরও যে কেমন অবস্হা হয় , সেই সম্পর্কিত প্রবাদটি
মনে পড়ে নন্দিনীর ।
দেখতে দেখতে রিসেপশানের দিন
এগিয়ে এসেছে । খুবই
জাঁকজমকপূর্ণ রিসেপশান । আলোকিত ফোয়ারা ,
বড় লন , নানা রকমের বাতি ঝাড়লন্ঠন । ইউনিফর্ম পরা ক্যাটারার থালায়
করে স্ন্যাক্স নিয়ে ঘুরছে। একটিই
রিসেপশান হওয়ার ফলে উপচে ওঠা ভিড় , ঘামের গন্ধ , মহিলাদের লেপটে যাওয়া প্রসাধন ।
বাইরের পার্কিং-এ জায়গা প্রায় নেই । পাঞ্জাবী
পায়জামা পরা পুরুষ আর নানা পোষাকের নানা সুঘ্রাণে আবৃত নারীরা । রান্নার জায়গা
থেকে মশলার গন্ধ গুমোট হয়ে আছে।
খাওয়াদাওয়ার পালা সাঙ্গ করতে
করতে রাত্রি হয়ে গেল ।
----------------------------- -------------------------------------------------------------
ক্লান্ত কিন্তু ভরপুর মন নিয়ে
যখন বর্ণালী দোতলায় উঠল
তখন প্রায় একটা বাজে । শরীর ক্লান্ত। তবু প্রতিটি অঙ্গে সুর লেগে । বাইরেটা নিঝুম হয়ে এসেছে
। কেবল রাস্তায় কুকুরেরা খাবারের ছিটেফোঁটা নিয়ে লড়াই করছে । তাদেরই
শব্দ পাওয়া যাচ্ছে । কেমন একটা ভয় ভয় করছে
। পরিবেশটি অপরিচিত । নিকটতম মানুষটিও । এরকম ভয় কি সব নববধূরাই পায় , অনেকটা নতুন
ইস্কুলে যাবার মত ?
দোতলায় উঠতে উঠতে কেমন যেন ঝিম
ঝিম করছে মাথাটা । বাসরঘরে ঢুকে ফুলে সাজানো খাটে বসতে বসতেই যেন মাথার ভিতরটায়
আগুন লেগে গেল । পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে বাণীপ্রিয় । কারুকাজ
করা পাঞ্জাবীর দুটি হাতা সে টেনে নিলে । ভাবে
পাঞ্জাবীর উজ্জ্বলতা খুলে সে আরাম করে বসবে ।
ঠিক তখনই ঘটে গেল ঘটনাটি । একটি আর্ত চিৎকার করে মূর্চ্ছা যায় বর্ণালী ।
সারা শরীর কাঁপতে থাকে, কপালে একটা চোখ বেরোয় ।
ফুলে ফুলে কান্নার মত শরীরটা দোমড়াচ্ছে মোচড়াচ্ছে । এটা
কি খিঁচুনি বলে ? এই সব কথা ভাবতে থাকে বাণীপ্রিয় । বেনারসীটা যায় এলিয়ে । লাল
শাড়িটা মাটিতে লুটোয় । সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় । খিঁচুনি সে প্রথমবার দেখছে । জলের জন্যে
ছুটোছুটি করে অ্যাটাচড বাথরুম থেকে মগ নিয়ে আসে । মুখে চোখে জলের ঝাপটা দিচ্ছে সে
। হচ্ছে না কিছুই । আশ্চর্য একটা ব্যাপার – শরীর বেঁকে বেঁকে খিঁচুনি হচ্ছে , আর
কপালে ফুলের মত ফুটে উঠেছে তৃতীয় নেত্রটি ।
আর্তস্বরটি অনেকের কানে গেছে ।
সিঁড়িতে বহু মানুষ উঠে আসার দুদাড় শব্দ । কী
হল ? কী হল কেউ পড়ে গেল নাকি ?
মাটিতে পড়ে গিয়ে বর্ণালী
অচৈতন্য । গলা কাটার পর মুর্গীর ঠ্যাং যেমন
নড়ে তেমনই পাটা কাঁপছে ওর । এক আশ্চর্য উপস্হিত বুদ্ধিতে বাণীব্রত দরজা
বন্ধ করে দিয়েছে শোবার ঘরের । একবার কলঙ্ক
রটে গেলে বিপদ । অবস্হাটা তো গুজব ছড়ানোর মতই । বাসরঘরেই তবে বরের সামনেই মৃগি ।
এপিলেপ্সি । কী নিষ্ঠুর পরিহাস । সকলের সামনে ডাক্তার
বদ্যি আসাও যথেষ্ট জল্পনার কারণ হতে পারে
।
কপালের চোখটাও বড় বেশী প্রাঞ্জল
– কেমন একটা অস্বস্তি লাগিয়ে দেয় । বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাণীব্রত – ঠিক করতে
পারছে না কী করবে । শরীরটা কাঁপতে কাঁপতে আস্তে আস্তে কাঁপুনি কমে যাচ্ছে । আর দিনের আলোয় যেমন চাঁদটা মিলিয়ে যায় তেমন
ভাবে মিলিয়ে যাচ্ছে তৃতীয় নেত্রটি । যেন
কোন দেবী ভর করেছিলেন , সেই দেবী এখন চলে যাচ্ছেন । মানবীতেই ফিরে যাচ্ছে মানবীর শরীর । বেনারসীতে সেজে – অপার্থিব লাগছে বর্ণালীকে
। মুগ্ধ বিষ্মিত চোখে চেয়ে থাকে বাণীব্রত
।
যাক , কেউ ঘরে ঢোকার আগেই
খিঁচুনি ঠিক হয়ে গিয়েছে । মিলিয়ে গিয়েছে চোখটি । বিদ্ধস্ত শরীরটা পড়ে আছে সাধারণ
বালিকার মত । যেন ক্লান্ত একটা শরীর । বাকরুদ্ধ
হয়ে গিয়েছে বাণীপ্রিয় । কিন্তু এতটুকু সাংসারিক বুদ্ধি তার আছে যে সে বুঝতে পারে
এটি – এই রোগটি তাদের একান্তই পারিবারিক ব্যাপার । ব্যাক্তিগত রাখতে হবে ,
পর্দ্দার আড়ালে রাখতে হবে ।
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
ক্রমশ ………
৪র্থ পর্ব পড়ুন আগামী শনিবার ।
লেখক পরিচিতি –
জন্ম ১৯৭৪ । পেশায় চিকিৎসক , এমডি , ডিএম ( কার্ডিওলজিস্ট ) ।কবি , সমালোচক , রবীন্দ্র অনুরাগী ও শনিবারের চিঠির সম্পাদক সজনীকান্ত দাসের পৌত্র ।
ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে নবকল্লোল , শনিবারের চিঠি ( নবপর্যায় ) , সুদক্ষীণা , গল্পপত্র , কাথাসাহিত্য , শারদীয়া দক্ষীণীবার্তা , কবিতা ও গল্প বারোমাস , কালপত্রী , ইছামতি বিদ্যধরী, অন্ধপক্ষ প্রভৃতি পত্রিকায় ও নানা লিটল ম্যাগাজিনে।
গল্পগ্রন্থ : সৈকত শিল্পী , বনবিহঙ্গ ।
উপন্যাস: সমান্তরাল ।