১ম পর্ব
উপক্রমণিকা
বাংলা কথ্য ভাষা প্রাচীন
সিন্ধু-সরস্বতীর সাহিত্যে তাম্রসভ্যতার সময়ের । ভাষায় সিন্ধু-সরস্বতী ও নীলনদী
সভ্যতা অনেক এগিয়ে ছিল। ভাতেও সিন্ধু- সরস্বতী অনেক বেশি এগিয়ে গেল সংকেতে
প্রাচুর্যের ও বিপদের স্থিরতা প্রতীকে বলে। তারপর অতি দ্রুত একমাত্র
সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা অক্ষর- লিপির উদ্ভাবন করল। কিন্তু ২৫০ লিপিতে বড়সড় কিছু রচনা
হচ্ছিলনা, নামমুদ্রা, দিগ্
নির্দেশনে ইত্যাদিতেই আটকে ছিল।
এই সমস্যার সমাধান হলো
আর্যগোষ্ঠীগুলি আসার পর এবং প্রায় পাঁচ দশক ধরে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যুদ্ধ চলার
শেষে সরস্বতী নদীর শাখা অদীনা ও দূদ্বোতীরমাটিতে । এই ভয়াবহ যুদ্ধের শেষে এই ভাষার
উদ্ভাবন হলো, আর ভাতে ঋকবেদ লিপিবদ্ধ হলো
সর্বপ্রথমে। ভাযাটি ১০টি অক্ষর লিপির। যদিও আর্যরা কোনো
অক্ষর- লিপি নিয়ে আসেনি তবুও এই বৈদিক ভাষা দুই সম্প্রদায়ের যৌথ প্রয়াসে উদ্ভাবিত
(অতুলকৃষ্ণ সুর ১৯৮৮)। রচনায় বেদ বাড়তে থাকল
অন্তর্ভুক্তিকরণ ও সম্প্রসারণ প্রথমে সিন্ধু-সরস্বতীতে পরে সমস্ত ভারতবর্ষে। বেদ
যেমন সবার শব্দ নিতে থাকল রচিত বেদের প্রভাবও সব কথ্য ভাষা ব্যাপক হতে দেখা গেল।
এই প্রণালী বোধহয় বাংলা তামিল ভাষায় সমসাময়িক ভাবে চালু হলো। ধীরে ধীরে অক্ষর-লিপি
উদ্ভাবিত হয়ে লিখিত বাংলা সাহিত্য শুরু হয় রাজা শশাঙ্কর সময়ের গৌড়ীয় কাব্য
দিয়ে, উন্নত হলো ১৮ পালরাজাদের কালে চর্যাপদ রচনাতে।
বখতেয়ার খিলজীর আক্রমণের পরে অনিশ্চিত সময়ে লোক প্রবাদে, ছোট
বাক্যর রসালু বচনে লোক সাহিত্য বেঁচে ছিল। খনা, রামায়া পণ্ডিত হলধর
মিশ্রর লিখনে উন্নত হলো। কিন্তু সর্বত্রই লোকগীতি,উচ্চবর্গের
সাহিত্য রচনা উল্লেখযোগ্য নয় । উন্নত ফারসী সাহিত্য ফকির-পীরের উদ্দার
আধ্যাত্বিকতা ও প্রেমের সুরেলা সুফি গান স্থানীয়কে জানতে থাকে
সাধু-সন্ত-তান্ত্রিকদের সহজ সরল মিঠে প্রবাদে ও ছন্দে অনুগীতি বা কবিগানের মধ্য
দিয়ে। বহিরাগত মুসলমান আক্রমণকারীরা এসেছেন লুঠ করে নিয়ে যেতে সোনা রূপা, হীরা
মূল্যবান পাথর, মন্দির প্রাসাদের দরজায়
দেয়ালে লাগানো সুন্দর কারুচার্য সাথে দামী পাথর জহরৎ। আরো কিছু আকর্ষণীয় জিনিস ও
মানুষ নিয়ে গেছেন । যদিও অধিকাংশ স্বদেশে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছেন এবং বেশকিছু মানুষেরা
নিজের শাসন কায়েম করে থেকে গেছেন। বাঙলায় আঞ্চলিক নবাবীর ইচ্ছা, ন্যূনতম
দিল্লির সুলতানের ভাতা মেনে নিয়ে, ধীরে ধীরে
স্বাধীন নবাবীর রূপ নেয়। তখন তাঁদের প্রয়োজন হলো স্থানীয়কে জানার বোঝার এবং
স্থানীয়দের সহযোগীতা আদায় করা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে। ফারসী ভাষা শিষ্ট স্তরে
বহুমুখী হতে থাকে, আবার পীর-ফকিরের আর
সন্ত-সাধু-তান্ত্রিকের বলা কওয়ার মিশ্রণে নতুন লোক সাহিত্যের সৃষ্টি হয়ে চলল। এতে
বাংলা সাহিত্যের বুনিয়াদ ধর্মচর্চ্চা ও রাজপ্রশস্তির
গন্ডি পেরিয়ে সামাজিক বিষয়েতে বিস্তার করে। এটা ফারসী সাহিত্য ও ফারসী শব্দের মিশ্রণে
হয় নাই অনেক ব্যক্তিগত চেষ্টাতে বাংলা নতুন স্বকীয় ধারাতে। এই পরিবেশে ঋষিতুল্য চন্ডীদাসের রচনায় বাংলা
সাহিত্য উদারতায় ও ভালোবাসাতে মানবতা মুখী এবং সমৃদ্ধ হয়।
শিষ্ট লোকেরা ভরসা পেলেন
মনের কথা বলতে জনসাধারণের সাথে আনন্দ ভাগ করে নিতে।
তাই যখন ইলিয়াস নবাবী শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ্ -এর নেতৃত্বে শুরু হলো বাংলা ভাষা
ফারসীর সাথে দরবারে আদৃত হলো। নবাব আলাউদ্দিন উৎসুক হলেন জানতে লোক-বাংলা রচনা এবং
প্রোৎসাহিত করলেন লেখকদের। আড়াইশত বছরে
হিন্দু সংস্কৃতি মিশ্রিত হলো প্রশাসনে যেখানে কিছু হিন্দু কবি প্রশাসনিক কাজে
নিযুক্ত হলেন।
বহু প্রচলিত নানা গল্প থেকে
তাদের কেউ কেউ দায়িত্ব পেলেন রামায়ণ,
মহাভারত ও চন্ডী অনুবাদ করতে সংস্কৃত থেকে। শিষ্ট রচনার পাশে ফারসী ও
বাংলায় লোক রচনা চলতে থাকলো। দুই স্রোতের মিশ্রণ দেখা যায় ব্যাতিক্রমী হিন্দু রাজা
আর তাঁর ছেলে ধর্মান্তরিত জালালদ্দিন ইলিয়াস শাহ্-এর সময় থেকে। পরবর্তী শতাব্দীতে
এলেন বিজয় গুপ্ত-বিপ্রদাস- কেতুকী দাস-ক্ষেমানন্দ- কানাহরি প্রভৃতি। মঙ্গলকাব্যের
ধারাতে ধর্ম ও রাজ প্রশস্তি ছাতা সাধারণ মানুষের শোষণ, নিপীড.ন এবং ঘটালো ভালো
মাত্রায় গণজাগরণ। এলেন মহাপ্রভু,জাত পাতের
বেড়া ভেঙ্গে,
দরিদ্র দলিতদের সাথে নিয়ে আনোখা অপ্রতিরোধ্য বৈষ্ণব পদাবলী কীর্তন।
অনেক সামন্ত ও স্বীয় প্রয়াসে
পন্ডিত ব্রাহ্মণরা সাধারণের আনন্দ ও পরস্পরে মিলেমিশে শান্তিতে থাকার জন্য লিখনে
নামলেন এবং কৃত হলেন যেমন ভবাননন্দের হরিহর গল্প পদাবলী, রামেশ্বরের শিবায়ন ও
সত্যনারায়ণ- সত্যপীরের ব্রতকথা। আরো পরে রাষ্ট্রীয়,
ধর্মীয় ও সমাজিক পেষণে নানা শ্রেণীদ্বন্দ্ব রদ করার জন্যে শিষ্টও লোক-রচনার
মিশ্রণে কাব্য লিখলেন যেমন রামগতি সেন, তার ভাই
জয়রাম সেন ও কন্যা আনন্দময়ী সেন,
ভারতচন্দ্র ও রামপ্রসাদ। ভারতচন্দ্রের
নানাভাষীদের মিসাল ভাষায় লেখা ব্রতকথা পাঁচালি এবং পুঁথি আর এক সাহিত্যের ধারা,হয়তো কবি ও গায়কেদের
কাছে আদরণীয় ছিল।
এই সময় অবকাশে লোক সাহিত্যও
এগিয়েছে বেশ দ্রুত। দুই স্রোতের মিশ্রণে তারা সব বিষয়ে লিখলেন। সবচেয়ে পুরানো হলেন
রঘু-মতে- নন্দে। তার পরে এলেন গৌজলা গুইই,
হরু ঠাকুর বা হরেকৃষ্ণ দীর্ঘাডি,
রাম বসু, রাসু-নৃসিংহ, নীলমণী ঠাকুর, নিতাই বৈরাগী, যজ্ঞেশ্বর ধোপা ভোলা ময়রা, এন্টনি ফিরিঙ্গি, কেষ্ট মুচি, রমরূপ ঠাকুর, দাশরথি রায়, যজ্ঞেশ্বরী-প্রথম মহিলা
কবিয়াল। দেশজ ভাষা এবং অলঙ্করণে-অনুপ্রাস ও অনুরণনে গীতি কথা ও কবিতাগীতি অনেক
উৎকৃষ্ট হলো। তার পরে ইংরেজ ব্যবস্থাপনাতে থিয়েটার,
বহুবাদনের ঐক্যতানে পরিবেশন করিগানের বাজার কেরে নিল বিশেষ করে শহরে,বন্দর বসতিতে। মর্মান্তিক আর্থিক সমস্যা অনেককে
সস্তা আনন্দ দেওয়ার জন্য
অশালীনতার আশ্রয় নেয়। যদিও তখনও অধিকাংশ কবিগান উচ্চমানের ছিল তাই ১৮৫১ সালের এক
সাংবাদিক বিশ্লেষণে লিখলেন -
"Our
enumeration of the amusement of the Bengalis would be incomplete if we made no
mention if the Kavis, which deserve a place in this list, not because of their intrisic
importance, but because of the vast influence they exert, and the attraction
they possess for nine-tenths of the people of Bengal." (সন্দীপ
দেব ২০১৫)
এই অনিশ্চিত সময়ে অনেক
প্রথিতযশা কবিসায়করা জমিয়ে আসর বসাচ্ছিলেন
সব জেলাতে। কবিগানগুলো গায়ে মাটির গন্ধ, মাটির
কাঁচা সুর ও স্বরগ্রাম সাধাতে গ্রামের শিষ্ট অশিষ্ট রসিকদের মুগ্ধ করছিল। এনাদের
মধ্যে উল্লেখনীয় হলেন আবুল কাসেম, আব্দুল জলীল, জসীমউদ্দিन, অসিত কুমার
বন্দোপাধ্যায় আরো অনেক সমালোচক প্রশংসা করেছেন। বলেছেন -
-" আর্থ-সমাজিক
পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষার তাগিদে করিওয়ালারা অনিবার্যভাবেই
সমকালীন জনরুচিকে মেনে নিতে বাধ্য হন। মনে হয় কবিগায়ক এই অস্তিত্বের সংকটকে ধারণ
করে রাখেন। দেব বন্দনার ছলে কোন তীর্থ ধামে পালাতে চান নি। একটা ভাঙ্গা-চোড়া সময়।
একটা বিধবৃত্ত পথভ্রষ্ট সমাজ-মনকে আশ্রয় দিয়েছেন
নিজেদের গানে, ভাবে ও সুরে
দুঃখের ব্যাপার একটাই, কবি সংঙ্গীতের সুচিহ্ণিত
পরিচায়ন সময়োচিত অনুসন্ধানের অভাবে,আজও
দুঃসাধ্য প্রায়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কবিসংগীত কেবলমাত্র
নিষ্ফল সাধনার ফসল নয়, তা ঐতিহ্যাশ্রয়ী।"
(সন্দীপ দেব ২০১৫)
এই অরাজকতার মধ্যে কবি, গানের উপর
পড়লো এক কঠিন দায়িত্ব- আধ্যাত্বিক সময়ণ্বতা আনা
সাম্প্রদায়িক সহবাসের বাস্তবতা স্থির করা তাছাড়া বহু
শতকের বোঝা আভ্যন্তরীণ ধর্মীয় শ্রেণীদ্বন্দ্বের অসাধু প্রথার অবসান ঘটানো।
পরবর্তী শতকগুলিতে কবিগায়করা অনেক বাধা, আগ্রাসী
হামলার মুখোমুখি হয়েও বহু আসরে কৃত হয়েছেন।
ডামাডোলের মধ্যে সদ্যযুগের শুরু হলো প্যারী চাঁদ মিত্র, রামমোহন
রায়, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাসসুন্দরী
দেবী, লাল বিহারী দে, রাজনারায়ন বসু, রমেশ
চন্দ্র দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র, আরো
অনেকের হাত দিয়ে। তাঁরাও ভাষা এবং দেশজ অলঙ্করণে-অনুপ্রাস ও অনুরণনে, নতুন দিক
দিশা দিলেন। পাশাপাশি কাব্য সাহিত্যও উন্নত হয়ে চলল বাংলার স্বকীয় দেশজ শব্দ
ভান্ডার ও অলঙ্করণকে বলিষ্ঠ করে। কবি,গায়কও
অনেক শহর গ্রমের উচ্চ নিম্ন মধ্য বর্গের মধ্যে আবির্ভাব হলেন 1 বিশেষ
উল্লেখনীয় হলেন রামগতি শীল (ময়মনসিংহের), সীতানাথ
ঠাকুর (ঢাকা), করিম বখশ (চট্টগ্রাম), রমেশ শীল
(চট্টগ্রাম)। তাঁরা কবিগান, গীতিকবিতা এবং ছড়া লিখলেন
সর্বস্তরের ও বয়সের লোকের
জন্য, ঐতিহ্যানুসারে ও আত্মীয়করণের মধ্য দিয়ে, গৌড়ীয় কাব্য
দিয়ে প্রবাহমান নিজস্বতা ঠিক রেখে, সরল
শৈলীতে হৃদয়ের গভীরে আলোড়ন তুললেন। শক্ত
হাতে তাঁরা বাংলা সাহিত্যের ক্রমবর্দ্ধমান পাশ্চাত্য রীতি বা মননশীলতার অনুকরণ
করেন নি।
তথ্যসূত্র
১) অতুল কৃষ্ণ প্রেক্ষাপট, ভাষার সুর
ভারতের নৃতাত্ত্বিক ও পরিচয়ঃ প্রাগৈতিহাসিক জাতিভেদ। সাহিত্য লোক, কলকাতা, ১৯৮৮।
যাদুঘর, সমাজ ও
জাতিভেদ । সাহিত্য লোক, কলকাতা 1988
২) Dinesh
Chandra Das Man's Tryst with Destiny in World and India: Part-A: Food to Religion.
BUUKS, Chennai, 2020.
৩) জ্যোতির্ময় রায়: লোক
কবিয়াল কপিল কৃষ্ণ ঠাকুর, হিমদল রায় ও সমুদ্র বিশ্বাস
গ্লাস। অলংকৃত তীর, লোক কবিগান , ষান্মাসিক, ১৭ বর্ষ
সংখ্যা, অক্টোবর- জানুয়ারি, কলকাতা, ২০১৬-২০১৭।
৪) রবীন্দ্র কুমার দত্ত
বাংলা কবিগান ও কবিয়াল হরিচরণ আচার্য: দীনেশ চন্দ্র সিংহ, অগ্নিকুমার
আচার্য, স্মৃতি চক্রবর্তী, অমিতা চৌধুরী, আশিষ
কুমার বৈদ্য, প্রণব বর্ধন, খেলন দাস
(হালদার), সন্দীপ দেব ও স্বয়ং রবীন্দ্র
কুমার দত্তের ভূমিকা এবং বাংলা সাহিত্যে কবিয়াল ও কবি গানঃ সেকাল-একাল, অক্ষর
পাবলিকেশন্স, আগরতলা, ২০১৫।
ক্রমশ ………………
২য় পর্ব পড়ুন আগামী মঙ্গলবার
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক পরিচিতি –
স্কুল-কলেজ পেরিয়ে উচ্চশিক্ষা পান আই টি খরগপুর, নেডারল্যান্ডস্ ও জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ইউ এস এ -তে । কর্মক্ষেত্র উত্তর প্রদেশ-এর তরাই অঞ্চলের গ্রাম, ভারত সরকার-এর অধীনে অরুণাচল-এ,
(শিলং-এ থেকে), উটি (তামিলনাড়ু), দেরাদুন-এ (উত্তরাখণ্ড) , কৃষি এবং পরিবেশ মন্ত্রালয়, দিল্লি-তে।
দিল্লির ৩৪ পল্লীর কালীবাড়ির সাথে যুক্ত আছেন বিগত ৩০ বছর ধরে। ১৯৪৮ সাল থেকেই লেখেন কিন্তু প্রথম প্রকাশন ২০১৫-তে। কবিতা , গল্প, ভ্রমণ কাহিনী ও প্রবন্ধ ছাপতে থাকে দিল্লির পত্র-পত্রিকাগুলোতে। কলকাতা এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রথম বই ' অনুভূতি বহুরূপে'। অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে দিল্লিথেকে প্রকাশিত ম্যাগাজিন ' কলমের সাথ রঙ' পত্রিকার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত এবং উচ্চপদে আছেন।