শরৎকাল নয়
। কিন্তু এত ভিড় কিসের ?
দুর্গাপুজোর
প্যান্ডেলের লাইন নয় । স্লিং এ জড়ানো ভাঙা বাঁ হাত । হয়ত কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে
। মেয়েটির চোখে চশমা । চুলটা টেনে বাঁধা । ওর ঠোঁটে স্বাভাবিক লিপস্টিক দিতে ভুলে
গিয়েছে অন্যদিনের মত । ঠোঁটটা ঈষৎ ফাঁক । ও স্লোগান দিচ্ছে । ওকে আমরা
তনিমা বলে ডেকেছি ।
ও একা
হাঁটছে না ।
রাত্রি
বারোটায় সমস্ত রাস্তা দখল করে হাঁটছে অগণিত মানুষ । ব্রিজে এত মানুষ উঠেছে , যে ভারে মনে হচ্ছে কখন ভেঙে পড়বে ।
ব্রিজের দুমুখে পুলিশের ব্যারিকেড । তাই যানবাহন বলতে কয়েকটি মোটরসাইকেল আর একটা
মানুষ ভর্তি ট্রাক । বাকি সব কেবল চলন্ত মাথার সম্ভার ।
যেন
জীবনের এক নদী চলে যাচ্ছে । একা হাঁটছে না । স্রোতের সঙ্গে সে হাঁটছে । অব্যবহৃত
ট্রামলাইনে হোঁচট খেতে খেতে সে হাঁটছে ।
পোশাক আছে
, কিছু
সচ্ছল , কিছু তেমন
সচ্ছল নয় । মলিন হলুদ কাপড় , মুখে শাঁখ বাজাতে বাজাতে যে মহিলা ওর ঠিক পিছনেই , তিনি মধ্যবয়স্কা ।
ইংরেজিতে
স্লোগান উঠছে – উই ওয়ান্ট জাস্টিস ।
হাতে
মোবাইলের আলো জ্বালা । অন্ধকার রাত্রের অসংখ্য প্রদীপের মত । যেন আরতি হচ্ছে । সবই
যেন স্রোতের তোড়ে চলেছে সামনে । কেউ যেন দাঁড়াতে পারছে না । সহস্র পা যখন হাঁটে
তখন চলার ছন্দই তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় , দ্রুত থেকে দ্রুততর বেগে ।
কোন আবেগ
এতগুলি মানুষকে এক ছন্দে নিয়ে এলো ? কেন হাঁটছে তানিয়া ?
আজ সকালে সে ঘুণাক্ষরেও জানত না সে হাঁটবে । কাল
তার সেমিস্টার পরীক্ষা ছিল । সারা বছর পড়েনি । শেষ সপ্তাহে পড়ে সে সাফল্য পায় ।
বহুদিন ধরে এভাবেই চলে আসছে । তার ওপর বাস থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙেছে ।
ব্যথার জন্যে চারদিন পড়া হয়নি । আজ বইয়ে
চোখ বোলাতে বসেছিল অধির একাগ্রতায় । ঠিক তখনই ফোন এলো , সঙ্গে হোয়াটস্ আ্যাপে একের পর এক
পোস্ট হচ্ছে – কোলকাতা আজ বিচার চায় , রাত দখল করবি তো আয় ।
তারই মত
একটি মেয়ে , স্নাতকোত্তর ছাত্রী , চিকিৎসক
ধর্ষণ আর খুন হয়ে গিয়েছে নিজের হাসপাতালে নাইট ডিউটি সেরে বিশ্রামরত অবস্থায় ।
পুলিশ অতিদ্রুততায় ময়নাতদন্ত সেরে , দাহ করে দিল ।
তানিয়া আর কিছু ভাবতে পারছে না । তার রক্ত , জ্বালা , হতাশা আর ক্ষোভে ফুটছে । সেই মেয়েটির এই হারিয়ে যাওয়ার
মধ্যে যেন সবাই অপরের সঙ্গে আপনার শিথিল হওয়া বন্ধন ফের খুঁজে পেয়েছে । সে যেন সবার হারানো বোন , দিদি বা মেয়ে হয়ে উঠেছে ।
সেই
অবস্থাতেই পড়ার বই টেবিলে খুলে রেখে আসছে
তানিয়া। উঠবার আগে সে ভাবেনি । ঘরের আলো নেভাবার সময় সে ভাবেনি । যখন দূর থেকে
মিছিলটাকে আসতে দেখেছিল তখনও ভাবেনি কেন যোগ দেব , কিন্তু যেন হঠাৎই মন্ত্রপূতের মত হাঁটতে হাঁটতে মিছিলে ঢুকে
পড়েছিল । তারপর মিছিলের ধাক্কায় সে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে ।
তার
মোবাইলে গোলাপি কাপড় ঢাকা একটি নীলাভ- হলদে দেহের ছবি । টিপে মারার কালশিটে ফুটে উঠেছে গলায় । তার চোখে শেষ একটা বিভীষিকা লেগে আছে । সেই
মেয়েটির মুখচ্ছবি তার চোখের সামনে ভাসছে । তাকে অস্থির করে তুলছে । মৃতার কোন
বন্ধু পোস্ট করে দিয়েছে । সহস্র থেকে কোটি মানুষের কাছে চলে গিয়েছে সেই ছবি ।
সে
পিন্টুর ফোন পেয়ে – তাকে ভিডিও কলে ব্রিজটা দেখায় । মানুষ দেখে হতবন্ব হয়ে পিন্টু
বলে ,
- মধ্যরাতে এত লোক ?
- সবাই বেরিয়েছে । আজ
রাত দখল করার লড়াই ।
- তুই তো সারাটা বছর
সিনেমা , থিয়েটার , হৈ হৈ – তুই ও বেরুলি ?
- বাঃ রে ! আমরাও তো
সমাজটাকে সুস্থ করতে চাই । রাতে যদি একা বেরুতে হয় ?
- আসছি আমি চটি গলিয়ে ।
তুই দুমিনিট দাঁড়া ।
- আচ্ছা তুই খেলা দেখছিস
, দেখ –
- আসছি । কখন না জানি
পুলিশ বা গুণ্ডা মিছিল আক্রমণ করে ।
পিন্টু
আসবে । ও দাঁড়াবে । পিন্টুকে ওর ভালই লাগে । এক শ্রেণী উঁচুতে পড়ে কলেজে । গানের
গলা ভাল । কলেজ সোশালে তার গানে বহু মেয়েই
মুগ্ধ হয় ।
সে পিছন
দিকে তাকায় ।
ব্রিজটার
এপ্রান্ত থেকে কেবল মানুষের মাথা ।
সামনে
হাসপাতালের নীল বাড়ির সামনে , মানুষের
ভিড়ের মধ্যে অসংখ্য সাদা পতাকা । উড়ছে , নড়ছে । উদ্বিগ্ন মুখে এদিক ওদিক ছুটছে ওয়াকি টকি হাতে পুলিশ
। সংঘবদ্ধ ভিড়টা স্লোগান দিচ্ছে – উই ওয়ান্ট জাস্টিস । মাইক থেকে ঘোষণা হচ্ছে-
এগিয়ে চলুন , এক লাইনে এগিয়ে চলুন -
তানিয়া
কখনো ভাবেনি তার সঙ্গে এত মানুষ হাঁটবে । মানুষ তো যে যার মতো আলাদা হতে চায় । হয়ে
যায় । আজ ডেকে ডেকে সবাই সবার সঙ্গে মিলিত হচ্ছে । ওপরে ফাঁকা
আকাশ , নিচে রেল
ইয়ার্ডে ওয়াগন । মেঘ গুমোট হয়ে ঝুলে রয়েছে । তার মধ্যেই ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে
গেল । ইঞ্জিনের হুইসিল কোন দূর থেকে শোনা যাচ্ছে বর্ষার ঠন্ডা বাতাসে।
স্রোতের
মত মানুষ , নদী থেকে সাগর হয়ে যাওয়া মানুষ । হাঁটছে । বৃষ্টিকে
অগ্রাহ্য করে হাঁটছে ।
কেবল সে
ছিল একা । সে কখনো ভাবেনি তার ডাকে সাড়া দিয়ে এত মানুষ তার পাশে – অন্তত তার নামের
পাশে এসে দাঁড়াবে । তার নামটা মুছে যাচ্ছে , মুছে গেছে , তার অস্তিত্বের প্রমাণও লোপাট হয়ে গেল । সময় আর রাষ্ট্রের
নিরলস প্রচেষ্টায় ।
যখন
ভয়-শঙ্কিত নির্দয় হাতটা তার গলা টিপে
ধরেছিল বধ্যভূমিতে , তখন সে ছিল নিরুপায়-ভাবে , নিদারুণভাবে একা ।
ভাবতেও পারেনি এত মানুষ , রক্ষার জন্যে তার আশে পাশেই ছিল ।
সে হয়ত ভাবতেও পারত না , কাতারে কাতারে মানুষ রাত্রি
বারোটায় সময় পথ হাঁটবে ।
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
লেখক পরিচিতি –
জন্ম ১৯৭৪ । পেশায় চিকিৎসক , এমডি , ডিএম ( কার্ডিওলজিস্ট ) ।কবি , সমালোচক , রবীন্দ্র অনুরাগী ও শনিবারের চিঠির সম্পাদক সজনীকান্ত দাসের পৌত্র ।
ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে নবকল্লোল , শনিবারের চিঠি ( নবপর্যায় ), সুদক্ষীণা , গল্পপত্র , কাথাসাহিত্য , শারদীয়া দক্ষীণীবার্তা , কবিতা ও গল্প বারোমাস , কালপত্রী , ইছামতি বিদ্যধরী, অন্ধপক্ষ প্রভৃতি পত্রিকায় ও নানা লিটল ম্যাগাজিনে।
গল্পগ্রন্থ : সৈকত শিল্পী , বনবিহঙ্গ ।
উপন্যাস: সমান্তরাল ।