Advt

Advt

athacha-eto-manush-chilo-story-galpo-by-dr.sunandan-shikdar-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-অথচ-এত-মানুষ-ছিল-গল্প-ডাঃসুনন্দন-শিকদার

 


শরৎকাল নয় । কিন্তু এত ভিড় কিসের ?

দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলের লাইন নয় । স্লিং এ জড়ানো ভাঙা বাঁ হাত । হয়ত কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে । মেয়েটির চোখে চশমা । চুলটা টেনে বাঁধা । ওর ঠোঁটে স্বাভাবিক লিপস্টিক দিতে ভুলে গিয়েছে অন্যদিনের মত । ঠোঁটটা ঈষৎ ফাঁক । ও স্লোগান দিচ্ছে ।  ওকে আমরা  তনিমা বলে ডেকেছি 

ও একা হাঁটছে না ।

রাত্রি বারোটায় সমস্ত রাস্তা দখল করে হাঁটছে অগণিত মানুষ । ব্রিজে এত মানুষ উঠেছে , যে ভারে মনে হচ্ছে কখন ভেঙে পড়বে । ব্রিজের দুমুখে পুলিশের ব্যারিকেড । তাই যানবাহন বলতে কয়েকটি মোটরসাইকেল আর একটা মানুষ ভর্তি ট্রাক । বাকি সব কেবল চলন্ত মাথার সম্ভার ।

যেন জীবনের এক নদী চলে যাচ্ছে । একা হাঁটছে না । স্রোতের সঙ্গে সে হাঁটছে । অব্যবহৃত ট্রামলাইনে হোঁচট খেতে খেতে সে হাঁটছে ।

পোশাক আছে , কিছু সচ্ছল , কিছু তেমন সচ্ছল নয় । মলিন হলুদ কাপড় , মুখে শাঁখ বাজাতে বাজাতে যে মহিলা ওর ঠিক পিছনেই , তিনি মধ্যবয়স্কা ।

ইংরেজিতে স্লোগান উঠছে – উই ওয়ান্ট জাস্টিস ।

হাতে মোবাইলের আলো জ্বালা । অন্ধকার রাত্রের অসংখ্য প্রদীপের মত । যেন আরতি হচ্ছে । সবই যেন স্রোতের তোড়ে চলেছে সামনে । কেউ যেন দাঁড়াতে পারছে না । সহস্র পা যখন হাঁটে তখন চলার ছন্দই তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় , দ্রুত থেকে দ্রুততর বেগে ।

কোন আবেগ এতগুলি মানুষকে এক ছন্দে নিয়ে এলো ? কেন হাঁটছে তানিয়া  ?

 আজ সকালে সে ঘুণাক্ষরেও জানত না সে হাঁটবে । কাল তার সেমিস্টার পরীক্ষা ছিল । সারা বছর পড়েনি । শেষ সপ্তাহে পড়ে সে সাফল্য পায় । বহুদিন ধরে এভাবেই চলে আসছে । তার ওপর বাস থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙেছে । ব্যথার জন্যে চারদিন পড়া হয়নি ।  আজ বইয়ে চোখ বোলাতে বসেছিল অধির একাগ্রতায় । ঠিক তখনই ফোন এলো , সঙ্গে হোয়াটস্ আ্যাপে একের পর এক পোস্ট হচ্ছে – কোলকাতা আজ বিচার চায় , রাত দখল করবি তো আয় ।

তারই মত একটি মেয়ে , স্নাতকোত্তর ছাত্রী ,  চিকিৎসক ধর্ষণ আর খুন হয়ে গিয়েছে নিজের হাসপাতালে নাইট ডিউটি সেরে বিশ্রামরত অবস্থায় । পুলিশ অতিদ্রুততায় ময়নাতদন্ত সেরে , দাহ করে দিল ।  তানিয়া আর কিছু ভাবতে পারছে না । তার রক্ত , জ্বালা , হতাশা আর ক্ষোভে ফুটছে । সেই মেয়েটির এই হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে যেন সবাই অপরের সঙ্গে আপনার শিথিল হওয়া বন্ধন  ফের খুঁজে পেয়েছে । সে যেন সবার হারানো বোন , দিদি বা মেয়ে হয়ে উঠেছে ।

সেই অবস্থাতেই পড়ার বই টেবিলে খুলে রেখে  আসছে তানিয়া। উঠবার আগে সে ভাবেনি । ঘরের আলো নেভাবার সময় সে ভাবেনি । যখন দূর থেকে মিছিলটাকে আসতে দেখেছিল তখনও ভাবেনি কেন যোগ দেব , কিন্তু যেন হঠাৎই মন্ত্রপূতের মত হাঁটতে হাঁটতে মিছিলে ঢুকে পড়েছিল । তারপর মিছিলের ধাক্কায় সে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে ।

তার মোবাইলে গোলাপি কাপড় ঢাকা একটি নীলাভ- হলদে দেহের ছবি  । টিপে মারার কালশিটে ফুটে উঠেছে গলায় ।  তার চোখে শেষ একটা বিভীষিকা লেগে আছে । সেই মেয়েটির মুখচ্ছবি তার চোখের সামনে ভাসছে । তাকে অস্থির করে তুলছে । মৃতার কোন বন্ধু পোস্ট করে দিয়েছে । সহস্র থেকে কোটি মানুষের কাছে চলে গিয়েছে সেই ছবি ।

সে পিন্টুর ফোন পেয়ে – তাকে ভিডিও কলে ব্রিজটা দেখায় । মানুষ দেখে হতবন্ব হয়ে পিন্টু বলে ,

-  মধ্যরাতে এত লোক ?

-  সবাই বেরিয়েছে । আজ রাত দখল করার লড়াই ।

-  তুই তো সারাটা বছর সিনেমা , থিয়েটার , হৈ হৈ – তুই ও বেরুলি ?

-  বাঃ রে ! আমরাও তো সমাজটাকে সুস্থ করতে চাই । রাতে যদি একা বেরুতে হয় ?

-  আসছি আমি চটি গলিয়ে । তুই দুমিনিট দাঁড়া ।

-  আচ্ছা তুই খেলা দেখছিস , দেখ –

-  আসছি । কখন না জানি পুলিশ বা গুণ্ডা মিছিল আক্রমণ করে ।

পিন্টু আসবে । ও দাঁড়াবে । পিন্টুকে ওর ভালই লাগে । এক শ্রেণী উঁচুতে পড়ে কলেজে । গানের গলা ভাল ।  কলেজ সোশালে তার গানে বহু মেয়েই মুগ্ধ হয় ।

সে পিছন দিকে তাকায় ।

ব্রিজটার এপ্রান্ত থেকে কেবল মানুষের মাথা ।

সামনে হাসপাতালের নীল বাড়ির সামনে ,  মানুষের ভিড়ের মধ্যে অসংখ্য সাদা পতাকা । উড়ছে , নড়ছে । উদ্বিগ্ন মুখে এদিক ওদিক ছুটছে ওয়াকি টকি হাতে পুলিশ । সংঘবদ্ধ ভিড়টা স্লোগান দিচ্ছে – উই ওয়ান্ট জাস্টিস । মাইক থেকে ঘোষণা হচ্ছে- এগিয়ে চলুন , এক লাইনে এগিয়ে চলুন -

তানিয়া কখনো ভাবেনি তার সঙ্গে এত মানুষ হাঁটবে । মানুষ তো যে যার মতো আলাদা হতে চায় । হয়ে যায় । আজ  ডেকে  ডেকে সবাই সবার সঙ্গে মিলিত হচ্ছে । ওপরে ফাঁকা আকাশ , নিচে রেল ইয়ার্ডে ওয়াগন । মেঘ গুমোট হয়ে ঝুলে রয়েছে । তার মধ্যেই ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল । ইঞ্জিনের হুইসিল কোন দূর থেকে শোনা যাচ্ছে বর্ষার ঠন্ডা বাতাসে

স্রোতের মত মানুষ , নদী থেকে সাগর হয়ে যাওয়া মানুষ । হাঁটছে । বৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে হাঁটছে ।

কেবল সে ছিল একা । সে কখনো ভাবেনি তার ডাকে সাড়া দিয়ে এত মানুষ তার পাশে – অন্তত তার নামের পাশে এসে দাঁড়াবে । তার নামটা মুছে যাচ্ছে , মুছে গেছে , তার অস্তিত্বের প্রমাণও লোপাট হয়ে গেল । সময় আর রাষ্ট্রের নিরলস প্রচেষ্টায় ।  

যখন ভয়-শঙ্কিত নির্দয়  হাতটা তার গলা টিপে ধরেছিল বধ্যভূমিতে , তখন সে ছিল নিরুপায়-ভাবে , নিদারুণভাবে একা ।   ভাবতেও পারেনি এত মানুষ  , রক্ষার জন্যে তার আশে পাশেই ছিল । সে হয়ত ভাবতেও পারত না  , কাতারে কাতারে মানুষ রাত্রি বারোটায় সময় পথ হাঁটবে ।

লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।

লেখক পরিচিতি –

জন্ম  ১৯৭৪  পেশায় চিকিৎসক এমডি , ডিএম  কার্ডিওলজিস্ট ) কবি , সমালোচক , রবীন্দ্র অনুরাগী  শনিবারের চিঠির সম্পাদক সজনীকান্ত দাসের পৌত্র 

ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে নবকল্লোল , শনিবারের চিঠি ( নবপর্যায় ), সুদক্ষীণা , গল্পপত্র , কাথাসাহিত্য , শারদীয়া দক্ষীণীবার্তা , কবিতা  গল্প বারোমাস , কালপত্রী , ইছামতি বিদ্যধরী অন্ধপক্ষ প্রভৃতি পত্রিকায়  নানা লিটল ম্যাগাজিনে

গল্পগ্রন্থ : সৈকত শিল্পী , বনবিহঙ্গ  

উপন্যাস:  সমান্তরাল