Advt

Advt

sudha-kalas-galpo-7thpart-by-juthika-chakraborty-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-সুধা-কলস-গল্প-যূথিকা-চক্রবর্তী

ধারাবাহিক বড় গল্প

sudha-kalas-galpo-7thpart-by-juthika-chakraborty-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-সুধা-কলস-গল্প-যূথিকা-চক্রবর্তী

৭ম পর্ব 

এবার মাধুরী বেঁকে বসল। বলল,"এই জমি ত আমার বাবার দেওয়া টাকায় আমার নামে কেনা হয়েছে। তাহলে এখানে কেন রামা বাড়ী করবে? এই জন্যই ও তখন বাড়ীর সামনে দোকান তুলতে দেয়নি। ও সামনেটা দখল করবে সে মতলব ওর আগেই ছিল। সুতরাং তুমি বাজারে যে দোকানঘর আছে সেটা বেচে দাও। আমার যে টুকু গয়না আছে তাই দিয়ে তুমি অবিলম্বে বাড়ীর সামনের জায়গায় মনোহারী দোকান কর। এ পাড়ায় একটাও এধরনের দোকান নেই। সুতরাং দোকান ভাল চলবেই। বাজারের দোকানঘরটা বিক্রি করে তাই দিয়ে লতার বিয়ে হবে। একটু না হয় দেরী হল। লতার বয়স তো এখনও কুড়ি পেরয় নি।” লতাও বলে উঠল, "আজকাল মেয়েদের লেখাপড়া শেষ না করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে না,আর তোমরা ক্ষেপে উঠেছ আমার বিয়ে নিয়ে"। মাধুরীর জেদে দেবানন্দ তাড়াতাড়ি করেই বাড়ীর সামনে দোকান তুলে ফেললেন। অনেকদিন পরে পরিবারটার মধ্যে যেন প্রাণের চাঞ্চল্য প্রকাশ পেল। খবর পেয়ে রামা ছুটে এসেছিল কিন্তু কিছু করার ছিল না তখন,দোকানঘর উঠে গেছে।

মাধুরী রামাকে ছেড়ে কথা বলেনি। রামা নিঃশব্দে মাথা নিচু করে চলে গিয়েছিল। সুযোগ বুঝে লতা একদিন বলে বসল, "দাদা, আমি নার্সিং ট্রেনিং নেব। ছোড়দা চলে গেছে যাক, আমিও তো তোমার হাতেই মানুষ। আজকাল মেয়েরাও চাকরী করে, আর নার্সিং এর চাকরী ভালই। এখনকার দুনিয়ায় কেউ কারুর দিকে তাকায় না। কাজেই তুমি আপত্তি করবে না। নার্স পাত্রীকে যদি কারুর পছন্দ হয় তো বিয়ে হবে, নইলে হবে না, ক্ষতি নেই। মেয়েদেরও স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ দিতে হয়। শুধু এখন ভর্তি করে দাও, পরে আর কিছু লাগবে না। তাছাড়া দাদা,স্বাতীটার হঠাৎ Growth থেমে গেল মনে হচ্ছে, প্রায়ই জ্বর হয়, পেটও ভাল থাকে না- আমিই ত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। ওকে একজন ভাল ডাক্তার দেখানো দরকার।"

ডাক্তার দেখাব, তুই একটু খোঁজ খবর কর। আমি দোকান ফেলে কোথায় যাব বল। এখন তুই-ই আমার ভরসা। কোথায় তোর বিয়ে দেব,সংসার করবি তা নয়,হাসপাতালে যাবি নার্সিং করতে।

আমি কিছুতেই এটা সহ্য করতে পারছিনা রে, রামাটাও পাশ থেকে কেমন স্বার্থপরের মত চলে গেল বলতে বলতে দেবানন্দ কেঁদে ফেলেন।

এভাবে বলছ কেন দাদা? চাকরী করেও মেয়েরা বিয়ে করে। তাছাড়া কতই বা আমার বয়স। তোমাদের দেখাশুনা করা,ছোট্ট ছেলেমেয়ে দুটোকে দেখা আমার কর্তব্য। আমাকে নিয়ে তুমি এত ভেবনা।

বৌদি মাধুরীও আর আগের মত নরম কোমল নন, রামার ব্যবহারে, দুর্বুদ্ধির পরিচয়ে, নিঃশব্দে বিয়ে করা,তারপর বাড়ীর সামনের জায়গাটা দখল করার বদ মতলব,এসব মাধুরীর কোমল সহানুভূতি-পূর্ণ মনটাকে নীরস করে দিয়েছে।

ছোট্ট স্বাতী আর এখন তত ছোট নেই। গার্লস হাইস্কুলে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী। লতা নার্সিং ট্রেনিং সমাপ্ত করে শহরের সদর হাসপাতালে নার্সের চাকরী পেয়েছে। সেই সূত্রেই হাসপাতালের বড় ডাক্তারকে দেখান হয়েছে। নানান রকম চিকিৎসাতেও যখন কোন উন্নতি হল না তখন থ্যালাসেমিয়ার পরীক্ষা করে ধরা পড়ল স্বাতী থ্যালাসেমিয়ার বাহক। লতার চোখের জল আর শুকোয় না। ভাইপো,ভাইঝি দুটোকে ও প্রাণের চাইতেও বেশী ভালোবাসে। সেই স্বাতীর এমন একটা অসুখ হল যা সারার তো কোন প্রশ্নই নেই কদিন যে বাঁচবে তারও ঠিক নেই। বিয়ের প্রশ্ন তো উঠতেই পারবে না।

তাহলে মেয়েটার ভবিষ্যৎ? স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে লতা প্রধান শিক্ষিকার সাথে দেখা করে সব বলে আর কেঁদে ভাসায়। সব শুনে তিনি বললেন,"এখানকার থ্যালাসেমিয়ার সোসাইটিতে খবর করে দেব,আমার জানা আছে, ওরাই চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে, রক্ত নেবার প্রয়োজন হলে তাও ব্যবস্থা করে দেবে। আমি স্বাতীর খেয়াল রাখব। তবে এরা যদি বাইশ তেইশ বছর পার হতে পারে তবে নিশ্চিন্তে আরও কিছুদিন টিকে যেতে পারে, কিন্তু একবার যদি রক্ত নেবার প্রয়োজন হয় তবে বারে বারে কখনো মাসে মাসে রক্ত নিতে হতে পারে। তবে সেটা নেওয়া শুরু হলে আর কিছু করার থাকে না। যখন রোগটা ধরা পরেছে তখন এটাকে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করার চেষ্টা করবে,ক্রমে ক্রমে ওকেও জানিয়ে দেবে। যাই হোক স্বাতীকে নিয়ে এস দেখব।” স্বাতী এলে বড়দি জিজ্ঞেস করলেন – “শুনলাম তুমি নাকি ঠিকমত খাওয়া দাওয়া কর না। এটা খাব না ওটা খাবনা এসব বল? আমাদের দেশে অনেক বাচ্চা আছে যারা দুবেলা পেট পুরে খেতে পায় না, তাদের কথা ভেবে কখনও খাবার নষ্ট করবে না, যা দেবে তা চেটে পুটে খাবে। আরে বাঃ তোমার চুল তো খুব সুন্দর। এখন যাও ক্লাসে,আমি কিন্তু খবর রাখব মন দিয়ে লেখাপড়া করছ কিনা। যাও এখন। স্কুলের বড়দির কাছে লতারা সবাই কৃতজ্ঞ। কোন ক্লাসে ওকে আটকানো হয়নি। কোনবার রিপোর্ট হাতে পেয়েছে কোনবার পায়নি- থ্যালাসেমিয়ার পেসেন্ট বলে বড়দি ওকে মাধ্যমিক পর্যন্ত টেনে দিয়েছেন। তবে আশ্চর্যের বিষয় শেষের দিকে আর টানতে হয়নি নিজের কৃতিত্বেই ও মাধ্যমিক ভালো ভাবেই পাশ করেছে।

মালদা কলেজ থেকে সোশিয়লজিতে অনার্স নিয়ে স্বাতী গৌড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল। এম এ টাও পাশ করল পঞ্চাশ শতাংশ নম্বর পেয়ে। দেখতে বিবর্ণ,বড় বড় চোখ দুটো ফ্যাকাসে, মুখে কোন সময়ে হাসি নেই। মাঝখানে একবার রক্ত নিতে হয়েছে, ওই একবারই। শিরদাঁড়ায় প্রচণ্ড ব্যথা হয় মাঝে মাঝে। ঘাড় নামিয়ে পড়তেও পারে না। ঘাড় সোজা রেখেই কত কষ্ট করে পড়াশোনা করে। কত রকম সেলাই,হাতের কাজে ঘর ভর্তি। কিন্তু মনে কোন আনন্দ নেই। বাবা বুড়ো হয়েছে বয়স এবং হতাশায়। স্বাতীকেই মাঝে মধ্যে দোকানে বসতে হয়। ভাইটা মানুষ হয়নি।

কোন রকমে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে এখন শখের ফটোগ্রাফার। মা বাবা পিসি দিদিভাই কারুর জন্যই ওর কোন মাথাব্যথা নেই। এহেন স্বাতীর জীবনে এলো অদ্ভুত এক সকাল। রোজকার মত সকাল সকাল স্নান সেরে বাড়ীর সামনের অপরাজিতা গাছটা থেকে ফুল তুলছে এমন সময় দেখে ওদেরই পাড়ায় সদ্য আগত একটি ছেলে স্বাতীদের বাড়ী খুঁজছে। স্বাতীকে দেখে ছেলেটি বলে - এটা আপনাদের বাড়ী?

কেন বলুন তো? আমার খোঁজ কেন?

আমি একটা পত্রিকার সাথে যুক্ত, তুই আপনি একটা লেখা দেন, যা পারেন, ছড়া কবিতা ছোটগল্প।

আমি এসব কিছু পারিনা, আপনি জায়গায় এসেছেন।

  - কিছু পারেন না, সে কি হয়। আজ ভাবুন, কাল আমি আবার আসব।

ভাবলেও কিছু হবে না, তবে মাঝে মাঝে আমার চিঠি লিখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কাকে লিখব আমার কোন বন্ধুই নেই।

বলতে চান আপনার কোন বয়ফ্রেন্ড নেই।

হো হো করে হেসে স্বাতী বলে - বললাম তো তোকে আমার কোনরকম বন্ধুই নেই।

শুনুন, আপনি এখন আমার সাথে যদি বেরতে পারেন একটু তবে ভাল হয়।

কোথায় যাবেন?

আগে আসুন তো।

  - না, জানেন আমার পিঠে এত ব্যথা যে সাইকেল চালাতে পারব না, হাটতেও পারব   না,খুব কষ্ট হয়।

ঠিক আছে এখন বিশ্রাম করুন, আমি বিকালে আসব তখন আপনাকে একটা কথা বলব।

শুনুন, যতদূর মনে পড়ছে আপনি প্রদ্যোত জ্যেঠুর কেউ হন। এখন বিদেশে থাকেন। আত্মীয় এবং দেশ দেখতে এসেছেন।  আপনার নাম শ্রাবণ,তাই না?

- আপনি জানলেন কি করে?

- আমাদের বাড়ির দুটো বাড়ি পরেই তো আপনাদের বাড়ি। ঠিক আছে বিকেলে আসবেন, তখন শুনব আপনার কথা।

ক্রমশ ………

 

৮ম পর্ব পড়ুন আগামী মঙ্গলবার ।

 লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

 লেখিকার পরিচিতি 

যুথিকা চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৪২-এ । মালদায় বেড়ে ওঠেন। সেখানে তার পড়াশোনা শুরু হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও বাংলায় স্নাতকোত্তর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে ১৯৬২-তে মালদহ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পবিত্র কর্মযজ্ঞে প্রবেশ করে পরবর্তীতে ১৯৭১ থেকে ২০০২ পর্যন্ত সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার গুরুদায়িত্ব পালন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন। শুধু তাই নয়, লেখালেখিতেও তার সহজাত অধিকার। তিনি সেতার বাদন ও বই পড়তে ভালোবাসেন। বর্তমান ভ্রমণকাহিনীটি তার অন্যান্য পরিচয়কে সমুন্নত করে তুলেছে।

বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত বই একটি।