ধারাবাহিক বড় গল্প
৫ম পর্ব
সব দেখে শুনে শ্যামল শ্রাবণ কে বললেন,দেখছিস তো
এখনকার অবস্থা,কি করবো বল? ভবিষ্যতে
তুই কি দেশের বাড়ীর দায়িত্ব নিবি? বাবা,ছেলের কথার মধ্যে এলিস বলল, অনুমতি দিলে আমি একটা
প্রস্তাব রাখতে পারি কি? সাগ্রহে পিতা- পুত্র সম্মতি দিয়ে
সপ্রশ্ন চেয়ে থাকল এলিসের দিকে। এলিস বলল, এটা তো তোমাদের
বাবা মায়ের বাড়ী, আর তুমি ও সু- ও এখানেই মানুষ হয়েছ,
এই বাড়ীতে তোমাদের অনেক স্মৃতি। তাই এটাকে বেঁচে দিও না। শ্রাবণের
বিয়ে দিয়ে আমরা দুজনে এখানে এসে থাকতে চাই,যদি অবশ্য তোমাদের
মত থাকে। ডাক্তার খুশী হলেন এবং এলিসের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে সরকার জ্যেঠুকে ডেকে
বললেন, বাড়ী- মেরামতির ব্যবস্থা করুন আর আপনিও সপরিবারে
আমাদের বাড়ীর নীচতলায় থাকুন। তাতে আমারও ভাল লাগবে আর আমরাও মাঝে মাঝে এসে থাকব।
আর আপনার বৌমার ইচ্ছা শেষ বয়সে আমরা এখানেই এসে থাকব।
সরকার মশাই যার পরনাই খুশী হলেন। বললেন, বাবা শ্যামল,
আমার আর বেশি পরিশ্রম করার ক্ষমতা তো নেই, আমার
রতনই সব দেখাশুনা করে, তাতে তোমার আপত্তি নেই তো। আপত্তি
কিসের জ্যেঠু? আপনারাই আমার আপনজন, রতন
আপনার জায়গায় বহাল হোক, ওর প্রাপ্য ও পাবে। এ নিয়ে আপনি চিন্তিত
হবেন না। ওরা কয়েক দিনের জন্য মামাবাড়ি হরিশচন্দ্রপুরেও ঘুরে এলো।
মামীমা বললেন, বাবা শ্যামল, তোরা
অনেকদিন পরে এলি, পুজোর ত আর দেরী নেই, পূজোটা দেখের বাড়ীতেই কাটিয়ে যা।” প্রস্তাবটা মন্দ নয়, কেননা বাংলা দেশের শরৎকালীন প্রকৃতি এলিস মুগ্ধভাবে উপভোগ করছে। ভোরে উঠে
শিউলি ফুল কুড়ানো ওর কাছে যে কী আনন্দের তা আর কাউকে বোঝান যাবে না। কিন্তু
অতদিনের জন্য হাসপাতাল ছেড়ে পিতা-পুত্রের দূরে থাকাটা সম্ভব নয়। তাই মামীমার
প্রস্তাবে রাজী হতে পারলেন না। বললেন, "এখন যাই,
আমরাও শেষ বয়সে দেশের বাড়ীতেই থাকব ঠিক করেছি। ওর কথা শুনে মামীমা
মামা খুশীই হলেন, তবু বললেন, আমরাও তো
বুড়ো হয়েছি কবে আছি, কবে নেই তাই বলছিলাম। তবে সত্যিই তো
তোরা বাপ ছেলে একই হাসপাতালে আছিস একসাথে বেশী ছুটি পাবিই বা কী করে।
বাড়ী এসে সব গোছগাছ চলছে। সন্ধেবেলা এলিস বাড়ীর বাগানে
দোলনায় দুলতে দুলতে গাইছে- ভুলনা, ভুলনা, ভুলনা।
সেদিন দুজনে দুলে ছিনু বনে
ফুল জোরে বাধা ঝুলনা।
শ্যামলকে ডেকে এলিস একসাথে দুলতে দুলতে গান গাইতে লাগল।
শ্যামল হেসে বললে,
এলিস, আমাদের বয়স হয়েছে, কেউ দেখে ফেললে,বুড়ো বয়সের শখ বলে ঠাট্টা করবে।
দোতলার অন্ধকার ঘর থেকে শ্রাবণ মা-বাবাকে
দোলনায় দুলতে দেখে নিঃশব্দে হাসতে লাগল। বাবা আর মা যে পরস্পর পরস্পরকে প্রাণের
চাইতে বেশী ভালবাসে সেটা জেনে শ্রাবণের অন্তর পরিতৃপ্ত।
কর্মস্থলে ফেরার পথে ছোট শহর মালদায় আসতেই হয়,এখানে শ্যামলের
মামাতো ভাই কালীকৃষ্ণ মিশ্র থাকেন। তিনি পেশায় উকিল দুদিনের জন্য থাকতেই হবে। সেখান
থেকে কোলকাতা তারপর বিদেশের উড়ান। শ্রাবণ একটা সাইকেল নিয়ে সকাল থেকে শহরটা ঘুরে
ফিরে গৌড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরের দিকে চলে গেল। দেখল ছোটখাটো একটা জটলা জটলার বিষয়
এম এ পরীক্ষার ফল প্রকাশ। হঠাৎই নজর পড়ল একটি টিকটিকির মত রোগা মেয়ে সাইকেল চালিয়ে
এলো। দেখতে সুন্দর মুখশ্রী কিন্তু জটার মত একরাশ কালো কোঁকড়া চুল পিঠে ছড়ানো,চেহারায় বিন্দুমাত্র পারিপাট্য নেই,মুখটা রক্তহীন,ফ্যাকাসে। সম্মোহিতের মত শ্রাবণ
গিয়ে মেয়েটার পথের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,কনগ্রাচুলেশনস
মেয়েটা অবাক হয়ে শ্রাবণের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কয়েক সেকেন্ড তারপর শব্দ-মাত্র
না করে ভিড় ঠেলে ভেতরয়ে ঢুকে নিজের রেজাল্ট জেনে নিয়ে বেরিয়ে যখন যাচ্ছে, তখন শ্রাবণ কে একই জায়গায় নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকাল একটু,তারপর সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। শ্রাবণের বুকের মধ্যে যেন কেমন করে উঠল,মন যেন বলল,পেয়েছি।
---------------------------------------------------
২য় খণ্ড – ১ম পর্ব
গ্রামের নাম লক্ষ্মীপুর। দেশভাগের পর কোন এক চেনাজানা সূত্রেই এই গ্রামে আসা। এখনকার বাসিন্দারা অধিকাংশই অশিক্ষিত। মাইল খানেক দূরে একটা হাইস্কুল আছে। গ্রামে একটা প্রাইমারী স্কুল আছে বটে তবে ছাত্রছাত্রীর সমাগম তেমন হয় না। দেবানন্দ ভাই বোন ও স্ত্রীকে নিয়ে লক্ষ্মীপুরেই বাস শুরু করলেন। যা সঙ্গে আনতে পেরেছিলেন তাই দিয়েই জমি কিনে চাষবাস শুরু করলেন। চাষবাসের কাজ নিজের কাঁধে নিয়ে ভাইকে ভর্তি করে দিলেন স্কুলে। বোন জেদ ধরে বসল ছোড়দার সাথে সেও স্কুলে যাবে। আজকালকার দিনে মেয়েরা আর মূর্খ হয়ে ঘরে বসে থাকতে চায় না। তাই ভাই-বোন দুজনকেই স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। সাইকেলে করে ওরা দুজনে স্কুলে যাওয়া শুরু করল। স্ত্রী,মাধুরী একাই সংসার সামলান। অবশ্য লতা যতক্ষণ বাড়ীতে থাকে বৌদিকে সাহায্য করে সাধ্যমত। দেবানন্দ চাষবাস করেই সব খরচ সামলান। কষ্টই হয়। তবে স্ত্রী,মাধুরীর হাতে যাদু আছে। বাড়ীর উঠোন সংলগ্ন এক ফালি বাগানে একদিকে যেমন ফুলের বাহার আর একদিকে সবজির চোখ জুড়ান সম্ভার। কি না ফলে বাড়ির বাগানে। লংকা,বেগুন, শীম,পালং,ধনেপাতা,লাউ,কুমড়া,সজনে এক কথায় সব ঋতুর উপযোগী সব সবজিই লাগানো হয় মাধুরীর বাগানে।
জল দেয়,
গোঁড়ার মাটি আলগা করে দেয় সার দিয়ে। আর বাড়ীর ছাইগাদায় রয়েছে মানের
ঝাড়। গ্রামের চাষিদের ঘরের মেয়ে হলে হবে কী,মাধুরী সেলাই
ফোড়াইও করে নানারকম, কাঁথায় নকশা করা,কত
ফুলতোলা বসবার আসন। দেবানন্দবাবুরা তেমন সম্পন্ন ঘর না হলেও মাধুরীর বাবা মেয়েকে
দিয়ে থুয়েই বিয়ে দিয়েছিলেন। জামাই যখন দেশত্যাগ করবে ঠিক করল তখন আর অনর্থক দেরী
না করে মেয়ে জামাইকে সাত তাড়াতাড়ি ভিটে ছাড়ার পরামর্শ এবং সেদেশে গিয়ে যাতে জলে না
পড়ে তার ব্যবস্থা করেই পাঠিয়েছিলেন। দেবানন্দও পয়মন্তর ছেলে, দু-চার বছর ঘুরতেই জমির পরিমাণ বাড়িয়েছেন। ইচ্ছা আছে আর একটু সংগতি হলে
মালদা শহরে একটা ছোটমত মাথাগোঁজার ঠাই করবেন। কোনমতে একটা ঘর তুলতে পারলে ভাইবোন
দুজনে শহরে পড়াশোনা করতে পারবে। লতা ও ছোড়দা রামানন্দ পাঁচ বছরের ছোট বড়। রামার
পরীক্ষার সময় এসে গেল। দেবানন্দও শহরে একখণ্ড জমির খোঁজে। অনেক খুঁজে দরকষাকষি করে
একখণ্ড জমি পেলেন শহরের মাঝেই,কাঠা তিনেকের মাত্র। তারপর বছর
খানেকের মধ্যেই ঘর তুলে মোটামুটি বাস করা যায় সে ব্যবস্থাও করে ফেললেন । ইতিমধ্যে
কোলে এলো ছোট্ট ফুটফুটে এক মেয়ে। নাম রাখা হল স্বাতী। বাড়ীতে বলেন, "মাধু তোমার মত লক্ষ্মীমন্ত বৌ পেয়েছিলাম বলেই আমি দাঁড়িয়ে যেতে
পারলাম"।
মাধুরী অভিমান ভরে বলে
"তাতে আমার কি? শহরে তো আমরা থাকব না, থাকবে তোমার ভাই রামা,কলেজে পড়বে। তারপর সময় হলে
লতাও যাবে পড়তে। মাধু তো পড়ে থাকবে এই গোবর গাদায়"।
দেবানন্দ বলেন,
"না মাধু,আমার ইচ্ছা জমিজমা খানিকটা
বেঁচে দেব,খানিকটা ভাগচাষ করতে দেব আর নিজেরাও শহরে গিয়ে
বসবাস করবো। ওখানে একটা দোকান দেব। কলেজ পাশ করে রামা যদি একটা চাকরী পায় তবে
দুভাই মিলে বোনটার বিয়ে দেব। মেয়ে হয়ে আর পড়াশোনার দরকার কি। তাছাড়া আমার স্বাতী
মা তো শহরেই লেখাপড়া শিখবে। এই অশিক্ষিতের গ্রামে আর থাকতে মন চায় না।
ক্রমশ ………
৬ষ্ঠ পর্ব পড়ুন আগামী মঙ্গলবার ।
লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখিকার পরিচিতি –
যুথিকা চক্রবর্তীর
জন্ম ১৯৪২-এ । মালদায় বেড়ে ওঠেন। সেখানে তার পড়াশোনা
শুরু হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও বাংলায় স্নাতকোত্তর বর্ধমান
বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে। ১৯৬২-তে মালদহ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার
পবিত্র কর্মযজ্ঞে প্রবেশ করে পরবর্তীতে ১৯৭১ থেকে ২০০২ পর্যন্ত সেই বিদ্যালয়ের
প্রধান শিক্ষিকার গুরুদায়িত্ব পালন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন। শুধু তাই
নয়, লেখালেখিতেও তার
সহজাত অধিকার। তিনি সেতার বাদন ও বই পড়তে ভালোবাসেন। বর্তমান ভ্রমণকাহিনীটি তার
অন্যান্য পরিচয়কে সমুন্নত করে তুলেছে।
বিভিন্ন
পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত বই একটি।