Advt

Advt

sudha-kalas-galpo-4thpart-by-juthika-chakraborty-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-সুধা-কলস-গল্প-যূথিকা-চক্রবর্তী

ধারাবাহিক বড় গল্প

 

৪র্থ পর্ব

রাত্রে শোবার আগে বোন সু-কে ফোনে সুখবরটা দিলেন। সু তো খুবই খুশী দাদার বিয়ের খবরে। তবে বারণ করল এই আষাঢ়মাসে বিয়েতে,কেননা এটা দাদার জন্ম মাস। দাদাকে বলল,"বিয়ের আনন্দে নিজের জন্ম দিনটাই ভুলে গেলি?"

"যার বাবা মা নেই তার আবার জন্মদিন কিসের রে? তুই মামা মামীকে জানিয়ে দিনক্ষণ ঠিক কর এবং তোদের সবার আসা চাই না আসার কোন অজুহাতই আমি শুনব না।

দাদা, তুই ভাবিস না, তোর বিয়েতে আমরা চারজনই যাব, মামা মামীও মনে হয় না যেতে অরাজি হবেন, তোর কথা খুব জিজ্ঞেস করেন। নাম কিরে আমার হবু বৌদির? আর শোন, কোন রং ওর সবচেয়ে পছন্দ,আর ব্লাউজের সাইজ পাঠাবি,শুধু কাঁধের মাপ হলেই চলবে। তোর বিয়ের বাজার আমি কোলকাতা থেকেই করব।

তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ওর ব্লাউজের মাপ আমি কি করে বলব? এসব ঝামেলা করিস না,ও ত শাড়িটাড়ি পরবে না,স্কার্ট পরে, তাই- ই পড়বে, ওগুলো কোলকাতার চাইতে এখানেই ভালো পাওয়া যাবে।

দাদা, মা বাবা কেউ নেই বলে আমারও কি কোন সাধ নেই তোকে নিয়ে? দেখিস বৌদিকে আমি বাঙ্গালী কনে সাজাব। ওর স্বভাব কেমন রে? খুব রাগী?

নারে, এলিস শান্ত মেয়ে,ওর চেহারায় একটা স্নিগ্ধ ভাব আছে। ঘননীল চোখ আর একমাথা সোনালি ফুরফুরে চুল,ওকে পিঙ্ক আর আকাশনীল মানায় ভাল।

এমন ফোনাফুনি রোজই চলতে লাগল;ভাই বোনে। মাঝে একদিন মামাও ফোন করেন। কী কী রং এর 'খানা বেনারসী কিনেছে,কখানা অন্যান্য সিল্ক শাড়ী কিনেছে,ওর হাতের মাপ কি,বোনকি বৌদিকে কোন গয়না দেবে না নাকি,মামা,মামীও কী খালি হাতে বৌয়ের মুখ দেখবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

অবশেষে সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে শ্রাবনের এক শুভ সন্ধ্যায় বিয়ের আসর বসল। রেজিষ্ট্রি সম্পন্ন হতেই বাঙ্গালীমতে টৌপর মাথায় দিয়ে সাতপাকে ঘোরা,শুভদৃষ্টি,মালা বদল সব হল হৈ,হৈ করে। মামা নিজে যজ্ঞ করলেন। সিঁদুর দানের সময় এলিসকে জিজ্ঞেস করা হল,এতে ওর আপত্তি আছে কিনা। আপত্তি নেই,কেননা বাঙ্গালী ঐতিহ্যপূর্ন বিয়ের অনুষ্ঠান এত আড়ম্বরপূর্ন যে ওর খুবই ভাল লাগছে। গোলাপী বেনারসী শাড়ি,গলায় হাতে প্রচুর গয়না,কান মাথা আঙ্গুল সবখানেই সোনার রকমারী গয়নার প্রাচুর্যে দিশাহারা এলিস সু- র হাতখানা সবসময় আঁকড়ে ধরে থাকছে। মামীমা যথাসাধ্য উপকরন সহযোগে বধুবরন করে নবদম্পত্তিকে আর্শীবাদ করে ঘরে তুললেন। শ্যামলও খুব খুশী এমন জমজমাট বিবাহ আসার পেয়ে। কিন্তু ছেলের কী যে হোল,ঘরে ঢুকে বাবা-মায়ের ছবিতে প্রণাম করতে গিয়ে হু হু করে কেঁদে ফেলল।

বিয়ের জন্য শ্যামল মাত্র দুদিনের ছুটি নিয়েছিল। হাসপাতাল সংলগ্ন কোয়াটার্স তাই অসুবিধা তেমন হয়নি। দিন সাতেক সবাই এদিক ওদিক খনিক ঘুড়ে অবশেষে প্লেনে চেপে বসলেন। ওদের সকলকে বিদায় জানাতে এলিস-সহ শ্যামল বিমান বন্দরে গেছিল। ফেরার পথে গাড়ীতে এলিসকে চুপচাপ দেখে শ্যামল জানতে চাইল মন খারাপ লাগছে কিনা। উত্তরে শ্যামলের দিকে এলিস ফিরে অকাল,ওর দুচোখে জল টলটল করছে। ধরা গলায় বলল,তোমার মা- বাবার কথা ভেবে খুব মন কেমন করছে। আমার মা- বাবা তো থেকেও নেই। শ্যামল কিছুই না বলে নিঃশব্দে গাড়ী চালাতে লাগল। ওর মনও কি মা- বাবার জন্য ব্যাকুল হয়নি?

এরপর দশদিনের ছুটি নিয়ে ওরা মধু যামিনীতে রেড়িয়ে পড়ল। নানান জায়গায় ঘুরে ইতালীর সমুদ্র সৈকতে নাম না জানা এক অজ্ঞাত ছোট্ট দ্বীপে ওরা দুদিন কাটাল। জলপাইয়ের ঘন পাতার রাশির উপর এলিসের কোলে মাথা রেখে শ্যামল শুয়ে পড়ল চোখ বন্ধ করে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে এলিস বলে গান গাও,গানের কথা বুঝিনা কিন্তু সুর বুঝি। শ্যামল এলিসের বুকের পরে দোলায়মান লকেট নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে গান ধরল,

"তোমার প্রাণে মাঝে সুধা আছে চাও কী হায় বুঝি তার খবর পেলে না।

এলিসও গাইল, তারপর অনুরোধ করল বাংলা গান শেখাতে হবে। শ্যামল রাজী। গভীর সুখে বুঁদ হয়ে মধুযামিনীর দিনগুলো শেষ হয়ে গেল। এবার ঘরে ফেরার পালা।

নিয়মিত চেকআপ,খাওয়া দাওয়া,ওষুধপত্র তাছাড়া শ্যামলের পাগল করা ভালোবাসার স্পর্শে দিনে দিনে এলিস পরিপূর্ন পদ্মের মত বিকশিত হয়ে উঠতে লাগল। সেদিন অসময়ে শ্যামল ঘরে ফিরে হলের সামনে থমকে দাঁড়াল,দেখল,বাঙালি মেয়েদের মত শাখা, শাড়ী গুজে পড়ে এলিস আপন মনে নিজস্ব উচ্চারণে বাংলা গান গাইতে গাইতে নাচচ্ছে। গান বাছাই দেখে শ্যামল অবাক হয়ে গেলে।

আমার জীবন পাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করেছ দান এমন অন্তর দিয়ে গেয়ে গেয়ে নাচছে যে শ্যামল অভিভুত হয়ে গেল। এগিয়ে গিয়ে একহাতে এলিসের কোমর জড়িয়ে ধরে গলা মেলাল ওর সঙ্গে। এমন করেই ওদের জীবন বয়ে চলল সোনার তরী বেয়ে। হাসপাতাল থেকে ফিরে শ্যামল দোলনা চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছে। এলিস নিঃশব্দে পিছনে এসে ওর কপালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, "ক্লান্ত? " "উহুঃ, গান শুনবে?"

"গাও”

আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে বসন্তের বাতাসটুকুর মতো। সে যে ছুঁয়ে গেল, নুয়ে, গেলরে- ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত।

শ্যামলের গাওয়া হয়ে গেলে এলিস বলল, "আমি একটা গান গাইব?" "গাও গাও!” আনন্দে খুশীতে শ্যামল বলল। এলিস গান ধরল-

" জগতে আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ। ধন্য হল ধন্য হল মানব জীবন। নয়ন আমার রূপের পুরে সহি মিটায়ে বেড়ায় ঘুরে, শ্রাবণ  আমার গভীর সুরে হয়েছে মগন। "

এবারে এলিস মা হল। ছেলে হয়েছে গায়ের রং ধবধবে ফর্সা নয়, একটু যেন চাপা, কিন্তু নাক চোখ মুখ একেবারে এলিসের মত বাংলা গানের অনেক শব্দের মধ্যে শ্রাবণ  শব্দটা এলিসের পছন্দ। তাই ছেলের নাম রাখা হল শ্রাবণ । শ্রাবণ  লেখাপড়া শিখে বাবার পেশাই নিল। গবেষনা চলতে লাগল থ্যালাসেমিয়ার উপরই। শ্রাবণ বাবা-মার কাছ থেকে গান শিখেছে,মায়ের গলার বাংলা গান শুনতেই ও ভালবাসে বেশী।

ইতিমধ্যে হাসপাতালে একটি বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটল। বাবার সহযোগী হিসাবে শ্রাবণ  চিকিৎসা করছিল এক রোগীর। ব্লাড ট্রান্সফিউশনের পরপরই তার হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে গেল। শ্রাবণ  ভেঙ্গে পড়ল হতাশায়। তবে কী তার কোন ত্রুটিতেই এমনটা হল! শ্যামল অনেক বোঝা এরকমটা হতেই পারে। আমরা তো যত্ন সহকারেই সবরকম চেষ্টা করি। এটা পেসেন্টের অক্ষমতা। সে আর পারলনা,নতুন রক্ত নেবার পরেই তার হার্ট ফেলিওর হল। এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। তোমার মনখারাপের কোন কারন নেই।

দেশ থেকে খবর এল কলিগ্রামের বাড়ী নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সরকার মশাই বৃদ্ধ হয়েছেন,তারপক্ষে আর সম্ভব নয় সম্পত্তি দেখাশুনা করার। শ্যামল যদি নিজে এসে সব ব্যবস্থা নেয় তবে ভাল হয়। ওরা তিনজনে মিলে এই তৃতীয়বার দেশের বাড়ীতে এল।

 

ক্রমশ ………

৫ম পর্ব পড়ুন আগামী মঙ্গলবার ।

 লেখিকারঅন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

 লেখিকার পরিচিতি 

যুথিকা চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৪২-এ । মালদায় বেড়ে ওঠেন। সেখানে তার পড়াশোনা শুরু হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও বাংলায় স্নাতকোত্তর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে ১৯৬২-তে মালদহ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পবিত্র কর্মযজ্ঞে প্রবেশ করে পরবর্তীতে ১৯৭১ থেকে ২০০২ পর্যন্ত সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার গুরুদায়িত্ব পালন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন। শুধু তাই নয়, লেখালেখিতেও তার সহজাত অধিকার। তিনি সেতার বাদন ও বই পড়তে ভালোবাসেন। বর্তমান ভ্রমণকাহিনীটি তার অন্যান্য পরিচয়কে সমুন্নত করে তুলেছে।

বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত বই একটি।