ধারাবাহিক বড় গল্প
৩য় পর্ব
শ্যামল বলল, "আমিও ইশ্বরের কাছে প্রার্থনা
করছিলাম আমি যেন একজন থ্যালাসেমিয়ার বাহক কোন মেয়েকে পাই। যার চিকিৎসা করব,
ভালবাসা দেব প্রানভরা, তুমি কি রাজী এলিস আমার
ভালবাসায় সাড়া দিতে? এলিসের দুচোখ জলে ভরে গেল। বলল,'কেন তুমি এমন প্রেমিকা খুঁজছ? আমার উপর তোমার
গবেষনার পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে চাও? আমাকে গিনিপিক বানাতে
চাও?” না এলিসা তা নয়।
বাহকদের আমি এটাই বোঝাতে চাই যে তারা যদি সুস্থ সঙ্গী বা
সঙ্গিনী পায় তাহলে তারা বেঁচে যাবে। বেঁচে থাকার আনন্দ থেকে তারা বঞ্চিত হবে কেন? এই প্রচারটা
আমরা সাধারনের মধ্যে করতে চাই। যাতে আর কোন অপ্রাপ্ত বয়স্ক এলিসকে পরিবারের আশ্রয়
ছেড়ে পথে এসে দাঁড়াতে না হয়। দেশের যুব সমাজ জানুক এই রোগটি সম্পর্কে।"
-"
আমাকেও বোঝাও শ্যামল, আমি সব জানতে চাই। সব
জেনে বুঝেই আমি তোমার সঙ্গী হতে চাই। তোমার আমার মিলিত জীবনে যেন কোন আতঙ্কের কালো
ছায়া এসে না পড়ে।"
-
বেশ, শোন, তোমাকে
মোটামুটি ব্যাপারটা বোঝাই। প্রথমতঃ থ্যালসেমিয়া রোগটি জীন বাহিত অর্থাৎ মা -বাবার থেকে সন্তানে সংক্রামিত। আমাদের শরীরের রক্তে তিনটি সেল থাকে (১)
রেড ব্লাড সেলস্ (২) হোয়াইট ব্লাড সেলস, (৩) প্লেটলেটস্,
লাল রক্ত কনিকায় থাকে হিমোগ্লোবিন যা লৌহ সমৃদ্ধ প্রোটীন। এটি
ফুসফুস থেকে অক্সিজেন নিয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে দেয়। হিমোগ্লোবিন আরও একটি কাজ করে,
ফুসফুস থেকে কার্বন-ডাই- অক্সাইড সংগ্রহ করে প্রশ্বাসের সাথে শরীর
থেকে বের করে দেয়। হিমোগ্লবিনে থাকে দুটো প্রোটিন চেন। (১) আলফা গ্লোবিন (২) বিটা
গ্লোবিন, এদের উপরেই নির্ভর করে থ্যালসেমিয়া।
তোমাকে আরও সহজ করে বোঝাই,পিতা মাতার থেকে
তোমার চারটি জীন দরকার। দুজনের থেকে দুটো করে। বাবার যদি চারটের মধ্যে দুটো জীন
মিসিং হয় এবং মায়ের যদি একটা জীন মিসিং হয় তবে তাদের সন্তাদের কেউবা সাইলেন্ট
ক্যারিয়ার হতে পারে, কেউ বা সম্পূর্ন সুস্থ হতে পারে। বিটা
থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে বাবা বা মায়ের যদি একটা করে সেল মিসিং হয় তবে তারা সুস্থ
নাও হতে পারে,কিন্তু চার ভাগের এক ভাগ সম্পূর্ন সুস্থ
সন্তানও হতে পারে। আজ অনেক জ্ঞান দিলাম খারাপ লাগছে নাতো? তোমার
বাবা মায়ের চেক আপ দরকার।
এলিস বলল সেটা অসম্ভব। কেননা বাবাকে একথা বলতেই বাবা
ড্রয়ার থেকে রিভলবার বের করে বলেছিলেন "নিঃশব্দে এ বাড়ী থেকে বেরিয়ে যাও-
মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা কর।
মা শুধু আমাকে শেষ বারের মত বুকে চেপে কাঁদছিল। আমি
বাবার কথাই মেনে নিলাম। ওরা যখন আমার চিকিৎসার ভারটুকুও নিতে চান না তখন ওদের
সামনে চোখের জল ফেলে লাভ কি? তোমার কথা শুনে আমি ঠিক করলাম আজ থেকে
আমার কাজ হবে বিয়ের আগে যেন প্রত্যেক ছেলে মেয়েই দুজনে দুফোঁটা রক্ত পরীক্ষা করিয়া
নেয়। আমার বাবার মত ধনী অশিক্ষিত চিন্তাধারার মানুষ এখনও সমাজে অনেক আছে।
ডাক্তার বললেন আজ অনেক কথা হল,চল এবার পার্ক
থেকে একটু ঘুড়ে আসি,দুজনে পার্কের দিকে হাঁটা লাগালেন ।
সন্ধের মুখে দুজনেই দুজনের থেকে বিদায় নিলেন।
এলিস বলল, আজ শুধু কথা হল গান শোনা হল না"।
ডাক্তার বললেন অবশ্য শোনাব,আমার সবচেয়ে
প্রিয় গান তোমায় শোনাব। আজ আসি।
(৩)
পরদিন বিকালে পার্কে দেখা হতেই শ্যামল এলিসকে নিয়ে
বেড়িয়ে পড়লেন লং ড্রাইভে নদীর ধারে সবুজ ঘাসে ছাওয়া জমিতে পা ছড়িয়ে বসে
বললেন, আমার মা খুব ভাল রবীন্দ্র সংগীত গাইতেন। মা ছিলেন শান্তিনিকেতনের
ছাত্রী। ছোট্ট বেলা থেকে মার গান শুনে শুনে শেখা তারপর তালিম নিয়েছি মাষ্টার
মশাই-এর কাছে। মা বলতেন গান হল জীবনের শ্রেষ্ট সঙ্গী পরম বন্ধু, মনের সব আনন্দ বেদনা,সুখ,দুঃখের
ভাগ নিয়ে নেয়। আমার বাবা বলতেন,গান শিখছ শেখ, কিন্তু পড়াশুনায় যেন খামতি না হয়। বাবাকে আশ্বস্ত করেতে বরাবরই আমার ভাল
রেজাল্ট করতে হত। ডাক্তারি পড়তে গিয়েও আমি গানের তালিম
নিতাম। নিয়মিত ওস্তাদের কাছে গিয়ে তালিম নিতাম। আমার বাবা,মা
গাড়ী দুর্ঘটনায় এক সাথে প্রান হারান। সেই শোক ভুলতে কাজের মধ্যে ডুবে থাকতাম আর
অবকাশমত গান গাইতাম। আজ তোমার মত একজন মুগ্ধশ্রোতা পেয়ে সত্যি আমার ভাল লাগছে।
প্রতিটা গানের কথাগুলোর অর্থ তোমায় বুঝিয়ে দিতে হচ্ছে।
কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা,গানের কথার অর্থগুলো হয়তো তুমি সঠিক বুঝতে পারছ না, কিন্তু সুর যে তোমার মনকে স্পর্শ করছে সেইটেই আসল কথা। বলেই শ্যামল
গীতবিতানের গান একটার পর একটা গাইতে লাগলেন। একটানা পাঁচখানা গেয়ে থামতেই এলিস
ডাক্তারের হাত চেপে ধরল, বলল,শ্যামল
আসায় বাংলা শেখাবে? বাংলা ভাষা বড্ড
মিষ্টি। আমি যখন স্কুলে পড়তাম,তখন একটা বাঙ্গালী মেয়ে আমার
সাথে পড়ত,আমার বন্ধু হয়েছিল,ওর কাছ
থেকে অল্প অল্প বাংলা শিখেছিলাম। তারপর চর্চ্চা নেই, ভুলে
গেছি। চেষ্টা করলে কি আবার শিখতে পারব না! তুমি সাহায্য করবে
তো?" ডাক্তার পরম স্নেহে নিঃস্ব, রিক্ত
এলিসকে বুকের মধ্যে টেনে নিলেন। এলিসও ধরা দিল। ডাক্তার এলিসের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,"তোমাকে
সব শেখাবো এলিস, তুমি শুধু আমাকে একটু
ভালবাসা দিও। আমার জীবন পাত্র শূন্য তুমি তা ভালবাসায় ভরিয়ে
দিও। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই এলিস।" এলিস ছিটকে উঠে দাঁড়ায় আতঙ্কে বলে ওঠে,তুমি আমাকে স্বপ্ন দেখাচ্ছ না বাস্তবে আছ শ্যামল?
-
আমি অনেক ভেবেই বলছি, আমি তো বাহক নই। আমাদের যে সন্তান আসবে সে হবে সম্পূর্ন সুস্থ। অন্যান্য
ডাক্তারদের সাথে পরামর্শ করেই আমি বলছি। ডাক্তারের গলা একেবারে শান্ত।
তুমি পাগল হয়ে গেছ শ্যামল। যেকোন
সময়েই আমি মরে যেতে পারি।
এলিস্, মৃত্যুর কথা কি কেউ বলতে পারে?
তোমার আগে আমার দরজাতেই হয়ত মৃত্যু এসে দাঁড়াতে পারে।
আমার বাবা মা অকালে চলে গেলেন একসাথে,কে ভাবতে পেরেছিল সেকথা? কাজেই তুমি না কোরনা এলিস। তোমাকে আমি এই কদিনেই প্রাণের চাইতে বেশী
ভালবেসে ফেলেছি। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচার না এলিস। এস,আমার
কাছে এস,ধরা দাও আমার বুকের মধ্যে দেখ কি শুনতে পাও। সোনা,
তুমি না করবে না, আমরা বিয়ে করব। মধুযামিনীতে
কোথায় যাব তুমি ঠিক করবে।
চোখের জলে ভাসতে ভাসতে এলিস লুটিয়ে পড়ল শ্যামলের বুকে।
কতক্ষন ওরা এভাবে পরস্পর পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে ছিল খেয়াল ছিল
না। হুঁস ফিরতেই দেখে সন্ধে নেমে রাত হয়ে গেছে। শ্যামল বলল,এখন তুমি তোমার কত্রীকে জানিয়েঙ দাও,তুমি তোমার কাজ
ছেড়ে দিচ্ছ । তোমার বিশ্রা,খাওয়া দাওয়া ওষুধপত্র সব নিয়মিত
করতে হবে । আমাদের একটা রিসর্ট আছে আমাদের হাসপাতালের,সেখানে
তোমার জন্য একটা স্যুইট বুক করে নেব,সেখানেই তুমি থাকবে। আমি
আমার বোনকে কথা দিয়েছিলাম আমার বিয়ের আগে তাকে আমার কাছে আনাব । আজ বোনকে তোমার
কথা জানাব।
ক্রমশ ………
৪র্থ পর্ব পড়ুন আগামী মঙ্গলবার ।
লেখিকারঅন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখিকার পরিচিতি –
যুথিকা চক্রবর্তীর
জন্ম ১৯৪২-এ । মালদায় বেড়ে ওঠেন। সেখানে তার পড়াশোনা
শুরু হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও বাংলায় স্নাতকোত্তর বর্ধমান
বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে। ১৯৬২-তে মালদহ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার
পবিত্র কর্মযজ্ঞে প্রবেশ করে পরবর্তীতে ১৯৭১ থেকে ২০০২ পর্যন্ত সেই বিদ্যালয়ের
প্রধান শিক্ষিকার গুরুদায়িত্ব পালন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন। শুধু তাই
নয়, লেখালেখিতেও তার
সহজাত অধিকার। তিনি সেতার বাদন ও বই পড়তে ভালোবাসেন। বর্তমান ভ্রমণকাহিনীটি তার
অন্যান্য পরিচয়কে সমুন্নত করে তুলেছে।
বিভিন্ন
পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত বই একটি।