আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন রথ
বলতে শুধুমাত্র জগন্নাথ দেবের রথের কথাই বুঝতাম। কিন্তু বড় হওয়ার পর দেখলাম যে
আজকাল বহু রাজনৈতিক দলগুলোও রথযাত্রা করছে। সেগুলো অবশ্যই ভগবানের রথ নয়। রাজনৈতিক
রথ। তাই অনেকের মনেই রথযাত্রা সম্পর্কে জানার ইচ্ছে হওয়াটা স্বাভাবিক।
আমরা প্রায় সবাই জানি যে
‘রথ’ শব্দটি সংস্কৃত ভাষাজাত, তবে এই শব্দটি সে ভাষায় ব্যবহৃত হলেও আসলে সেটি
সম্ভবত: ইন্দো-ইরানীয় শব্দ। ‘রেত-হ’ শব্দ থেকে রথ শব্দের উৎপত্তি বলে ধারণা করা
হয়। কালক্রমে ‘রেত-হ’ রূপান্তরিত হয় রোটা, ল্যাটিন
শব্দে যার অর্থ রোটেশন বা ঘূর্ণন। ল্যাটিন রোটা শব্দটি জার্মান, সেলটিক ও
বাল্টিক ভাষা থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়। রথের চাকা ঘোরে বলেই এ ধরণের যানের নাম
ধীরে ধীরে তাই সংস্কৃত শব্দে এসে দাঁড়ায় ‘রথো’-তে। রথো থেকে বাংলায় রথ। রথকে
কেন্দ্র করে যে শোভাযাত্রা ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় তাকে বলা হয় রথযাত্রা।
রথযাত্রা সম্পর্কে আজকাল
প্রায় সবাই জানেন। বিশেষকরে রাজনৈতিক নেতারা যখন থেকে এই রথের ব্যবহার শুরু করেছেন
তখন থেকেই রথযাত্রা সংবাদের শিরোনামে আসতে শুরু করেছে। আমাদের বাংলায় যারা মানুষ
হয়েছেন বা শৈশব কাটিয়েছেন তাঁরা প্রায় সকলেই একবার না একবার রথের দড়ি ধরে টেনেছেন, সেটা বড়
রথই হোক বা শৈশবের খেলার রথই হোক। শুধু বাংলাই বা বলি কেন, আজকাল
প্রবাসে থেকেও বাঙালিরা এবং উড়িষ্যাবাসীরাও রথযাত্রা পালন করে থাকেন। যেমন
দিল্লিতে চিত্তরঞ্জন পার্কে বা বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাতে রথের দিন গেলে আজও দেখা
যায় ছোট ছোট বাচ্চারা রথ টেনে নিয়ে চলেছে। ওই দৃশ্য দেখে মনটা নস্টালজিক হয়ে ওঠে।
বড় হয়ে কলেজের পাঠ্যপুস্তকে
পড়েছিলাম যে ইংরেজদের সময়ে একজন বাঙালি ভদ্রলোক দেরীতে অফিসে পৌঁছানোতে ইংরেজ
সাহেব যখন কারণ জানতে চান, তখন ভদ্রলোকটি তাকে বলেন যে
রথের জন্য তার আসতে দেরী হয়েছে। সাহেব ‘রথ’ কথাটির অর্থ জানতে চাইলে, তাকে
বোঝানোর জন্য বলেছিলেন “ চারচো চারচো উডেন চারচো, আপ অন দ্য
থ্রি স্টেয়ারস্, গড অলমাইটি সিটিং দেয়ার , হাণ্ড্রেড হাণ্ড্রেড মেন
পুলিং দ্য রোপ এন্ড কল্ড হরিবোল, হরিবোল।
দ্যাট ইজ কল্ড রথ। এর থেকেই বোঝা যায় যে ইংরেজ আমলেও রথযাত্রার প্রচলন ছিল।
রথযাত্রা খুবই প্রাচীন।
ছোটবেলা থেকেই আমরা শুনে আসছি রথযাত্রার কথা। রথযাত্রা মহোৎসবের উৎপত্তি-কাল
ঠিকমতো জানা যায়নি। তবে ভবিষ্য পুরাণে রথের প্রসঙ্গে উল্লেখ আছে এবং বলা হয়েছে যে
সূর্যের রথই সর্বপ্রথম।
ভারতে একসময়ে মাঘের শুক্লা
সপ্তমী তিথিতে সূর্যের রথ যাত্রা উৎসব পালিত হত। ভবিষ্য পুরাণে ভাদ্র মাসে সূর্যের
রথ যাত্রার উল্লেখ আছে। প্রচলিত উপাখ্যান আছে যে সূর্য প্রতিদিন সাতটি ঘোড়ায় টানা
রথে চড়ে পূর্ব দিকে উদয় হতে যান এবং পশ্চিম দিকে রথ চালিয়ে অস্ত যান। সাতটি রং –
এর প্রতীক হল সাতটি ঘোড়া।
রথে বসে থেকেও দূরে গমন করেন
দেবতা। মিলিত হন সকলের সঙ্গে। দেবতাদের এই ভাবধারার প্রকৃষ্ট প্রমাণ এই রথ
যাত্রায়। রথ দেবতাকে বহন করে নিয়ে যায় সকলের মধ্যে দিয়ে। ধনী, দরিদ্র
সকলেই রথের দড়ি টানে এক অনাবিল আনন্দে। সকলে তখন দেবতার সাথে এবং দেবতার রথের সাথে
একাত্ম হয়ে যায়। কিছুক্ষণের জন্য সবাই এক প্রাণ, এক জাত ও
এক ধর্মের হয়ে যায়।
রথযাত্রাকে কেন্দ্রকরে দেশের
বিভিন্ন স্থানে পালনকরা হয় রথের মেলা ও উৎসব। কোথাও কোথাও এই রথের মেলাগুলো চলে
মাসব্যাপী। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র
নির্বিশেষে সে উৎসবে আনন্দ করে। তাই রথের মেলা উৎসব পরিণত হয় এক ঐতিহ্যবাহী লোক
উৎসবে। সবার জন্য সমানভাবে চলে সে আনন্দ উৎসব। বিশ্বের তথা ভারতের সর্ববৃহৎ
রথযাত্রা উৎসব পালিত হয় উড়িষ্যা রাজ্যের পুরীতে, পশ্চিম
বঙ্গের শ্রীরামপুর, মাহেশে এবং তামিলনাড়ু-র
থিরুবরন্তপুরে। বাংলাদেশের ধামরাই-এর যশোমাধবের রথযাত্রা খুবই প্রসিদ্ধ। এছাড়া বিশ্বের
আরও যেসব শহরে উল্লেখযোগ্য রথযাত্রা উৎসব পালিত হয় সেগুলো হল ভারতের আরাগুলার, অবিনাশী, চেন্নাইমালাই, ইলামপিলাই, কাঞ্চিপুরুম, চেন্নাই, নিঝাল, থাংগাল, পলানি, ভীরামপত্তনম, ভুবনেশ্বর, সালেম, উদুপি, থিরুচিরাপল্লী, কুম্ভকানম
ইত্যাদি। শ্রীলংকার কলম্বো শহরেও বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে রথযাত্রা উৎসব পালিত হয়।
আগেকার দিনে ধনী পরিবার ছাড়া
সেকালের বিখ্যাত যত প্রতিষ্ঠিত নারায়ণ ও জগন্নাথ মন্দির প্রাঙ্গণে আর মন্দিরের
কাছে পথের দুপাশে শহরে, গ্রামে, গঞ্জে
রথের মেলা বসত। রথ টানা হত খুব ঘটা করে। পুজোর পর প্রসাদ বিতরণ করা হত। মেলায়
মাটির পুতুল, মেলার পাখি, কাঠের
জিনিস, ঝুড়ি ধামার সঙ্গে শৌখিন জিনসের বেচাকেনা চলত। পাঁপড় ভাজা আর তালপাতার ভেঁপু
ছিল রথের মেলার বড় আকর্ষণ।
প্রাচীনকালে যান্ত্রিক বাহন
ছিল না। তাই দূরবর্তী স্থানে চলাচলের জন্য রথ ছিল রাজ-রাজাদের বাহন। ভগবান
শ্রীকৃষ্ণেরও রথ ছিল। তাঁর ছিল পাঁচ রকমের রথ – ব্রহ্ম রথ, মধ্য রথ, কিন্ন রথ, রৌপ্য রথ
ও স্বর্ণ রথ।
ব্রহ্ম রথ ছিল সবচেয়ে বড়। আর
কিন্ন রথ ছিল সবচেয়ে ছোট। ঘোরা দিয়ে সেসব রথ টানানো হত। এমনকি শ্রীকৃষ্ণের রথের
চড়ে যুদ্ধ করার কথাও শোনা যায়। কুরুক্ষেত্রর যুদ্ধে কুরু ও পাণ্ডবদের অন্যতম
যুদ্ধ-বাহন ছিল রথ। ভারত ছাড়া শ্রীলংকাতেও ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে রথযাত্রা
পালিত হয়।
রথ হল একধরনের গাড়ি বা বাহন
বিশেষ করে যার চারটে চাকা থাকে। মঠ বা মন্দিরের আদলে সেই গাড়ি সদৃশ কাঠামোর ওপর
তৈরি হয় রথের মূল কাঠামো। এজন্য ইংরেজিতে রথকে বলা হয় টেম্পল কার অর্থাৎ গাড়ি
মন্দির। সাধারণত: কাঠ দিয়েই রথ তৈরি করা হয়। কাঠের নানা রকম নকশা খোদাইকরে রথকে
সৌন্দর্য-মণ্ডিত করে তোলে। কখন কখনও রথের বেষ্টনী ও ছাদে কিছু পৌরাণিক চরিত্রের
দৃশ্য বা ছবি আঁকা থাকে। চূড়ার কারুকার্য, রঙের
বিন্যাস ও গড়ন রথকে একটি বিশেষ শোভনীয় বাহনে পরিণত করে। পৌরাণিক কাহিনীতে
প্রাচীনকালে দেবতারা পুষ্পক রথ, সুবর্ণ রথ
ইত্যাদি ব্যবহার করলেও মর্ত্যের মাটিতে তা বিরল। ভারতের পালানিতে অবশ্য একটি
স্বর্ণ-রথ আছে বলে জানা যায়। রথের ওপরের গড়ন অনেকটা মন্দিরের মত। তার ভেতরে
রথযাত্রার সময় প্রতিষ্ঠা করা হয় শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের মূর্তি। সঙ্গে থাকে
সুভদ্রা ও বলরামের মূর্তি। রথ চালককে বলা হয় শিখণ্ডী। রথযাত্রার দিনেই শুধু রথকে
বের করা হয় ও রথের টান হয়। সে উপলক্ষে বেশ কয়েকদিন বা মাসব্যাপী কোথাও কোথাও উৎসব
চলে। চলে রথের মেলা। কথায় বলে রথ দেখা আর কলা বেচা, রথের মেলা
নিয়ে এরকম প্রবাদ অনেক দিনের। অর্থাৎ এক ঢিলে দুই পাখি মারা যায় রথের মেলায় গেলে।
কি পাওয়া যায় না রথের মেলায়? কাঠের পুতুল, মাটির
পুতুল থেকে শুরু করে গ্রামীণ গৃহস্থালি দ্রব্যের প্রায় সবকিছুই ওঠে রথের মেলায়।
বাতাসা, কদমা, সন্দেশ, জিলিপি, মুড়কি, মোয়া তো
অবশ্যই থাকে। রথযাত্রার দিনে হিন্দু সমাজে কোথাও কোথাও মহিলারা উপবাস ও করে থাকেন
এবং উপবাস শেষে দই, চিড়া, খই মুড়ি ও
ফল খাওয়া হয়।
রথের রশি বা দড়ি ধরে শত শত
ভক্ত সেই রথকে টেনে একটা নির্দিষ্ট গন্তব্য পর্যন্ত নিয়ে যান। রশি ধরে একনাগাড়ে
টানা হয় না। খানিকটা বিরতি দিয়ে দিয়ে টানা হয়। একে বলে রথের টান। লোকেদের মধ্যে
বিশ্বাস আছে যে, রথের দিন বৃষ্টি হবেই, তবে সে
বৃষ্টিটা হয় টানে টানে – এক এক পশলায়। একটু থামে, একটু ঝরে।
একটানা বৃষ্টি হয় না। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, রথ টানায়
যে তাতে প্রশান্তি প্রদানের জন্যই স্বর্গ থেকে এই বৃষ্টি ঝরান শ্রী শ্রী জগন্নাথ
দেব। আবার ৭ – ৯ দিন পর সে রথ ফেরত আসে। তখনও সে রথকে ভক্তরা টেনে নিয়ে আসেন। তাকে
তখন বলা হয় উল্টোরথ। তাই রথ থেকে উল্টোরথ – এ দশ দিন ধরেই চলে রথযাত্রার আনন্দ
উৎসব। সুপ্রাচীন কাল থেকে শুরু হওয়া রথযাত্রার উৎসব এখনও প্রবহমান। দেশের বিভিন্ন
জায়গায় ছোট বড় নানা আকৃতি ও আয়োজনের রথযাত্রা প্রতি বছর আষাঢ় মাসে অনুষ্ঠিত হয়।
সূর্য ঋগ্বেদের মিত্র দেবতা।
মিত্র দেবতা ক্রমবিকাশের ভেতর দিয়ে বিভিন্ন দেব-দেবীতে রূপান্তরিত হয়েছেন উপনিষদ
পুরাণের যুগে। তিনি কোন সময় বিষ্ণু, কোন সময়
শিব আবার কোন সময়ে জগন্নাথ – বলরাম –সুভদ্রা হয়েছেন।
দেবীপুরাণে কার্ত্তিকের
শুক্লা তৃতীয়া, পঞ্চমী, সপ্তমী, একাদশী ও
পূর্ণিমায় মহাদেবীর রথযাত্রার উল্লেখ আছে। নেপালে বৈশাখ মাসের শুক্লা চতুর্দশীতে
দেবীযাত্রা বা নেতাদেবীর রথযাত্রা উৎসব হয়। কুমারী রথযাত্রা উৎসবও নেপালে
মহা-ধুমধামের সাথে পালিত হয়।। কুমারী বালিকা অষ্ট মাতৃকার প্রতীক। নেপালের কুমারী
রথে গণেশ, কার্ত্তিকের প্রতিভূস্বরূপ
দুটি বালকও থাকে। যেহেতু নারীর ভেতরে দেবী-শক্তি বিরাজ করে এবং পুরষের মধ্যে
দেবশক্তি বিরাজ করে তাই এই দু’টি শক্তিকে জাগিয়ে তুলবার জন্যই কুমারী রথযাত্রা
উৎসব।
আষাঢ় মাসের পুষ্যা নক্ষত্রে
শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে জগন্নাথ দেবের রথ যাত্রা উৎসব পালিত হয়। তিথির সাথে
নক্ষত্রের যোগ না থাকলেও তিথির প্রাধান্যেই এই উৎসব পালন করা হয়।
জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রাকে একই রথে যাত্রা করানোর বিধি দিয়েছেন বিষ্ণু-ধর্মোত্তর
গ্রন্থ। কিন্তু পুরুষোত্তম মাহাত্ম্য ও নীলাদ্রি মহোদয়ের পদ্ধতিতে বলা হয়েছে যে
তিনজনকেই আলাদা আলাদা রথে যাত্রা করানোর কথা। পুরীধামে কিন্তু প্রত্যেকেরই পৃথক
পৃথক রথ দেখা যায়। জগন্নাথ দেবের ষোল চাকার রথে গরুড় ধ্বজা, বলরামের
চৌদ্দ চাকার রথে লাঙ্গল ধ্বজা এবং সুভদ্রার রথে পদ্ম ধ্বজা দেখা যায়।
সনাতন পুঁথি-পুস্তকের দিকে
দৃষ্টি দিলে যা জানা যায় তা হল –
কাঠ দিয়ে তৈরি বিষ্ণুর
মূর্তির মত জগন্নাথ মূর্তিকেও পুজো করা হয়ে থেকে। জগন্নাথদেবের রথযাত্রা কত পুরনো
তা না জানা গেলেও পুরীর জগন্নাথদেবের মূর্তিকেই জগন্নাথ পুজোর আদি বলে মনে করা হয়ে
থাকে। নীলাচলে বিষ্ণুর জীবন্ত মূর্তি নীলমাধবের অন্তর্ধান ও পুরীর রাজা
ইন্দ্রদ্যুম্ন দ্বারা বিশ্বকর্মাকে দিয়ে জগন্নাথদেবের মূর্তি প্রতিষ্ঠার বিস্তারিত
বিবরণ স্কন্দ-পুরাণের উৎকল খণ্ডে বর্ণনা করা হয়েছে। বিশ্বকর্মা ঠিক কতদিন
বিগ্রহগুলো নির্মাণের নির্মাণের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তা নিয়েও মতভেদ আছে। শিশু
কৃষ্ণদাস, দেউল-তোলায় লেখা আছে
বিগ্রহগুলো নির্মাণের জন্য মোট ২১ দিন সময় চেয়েছিলেন বিশ্বকর্মা। কিন্তু তার আগেই
১৪ দিনের মাথায় রানীর কথায় ইন্দ্রদ্যুম্ন দরজা খোলায় বিগ্রহগুলো অর্ধনির্মিত রয়ে
গেল। নবম দিনের কথা লেখা আছে অন্য বইতে। ১৪ দিন নয়, ৯ দিনেই রানী
বিগ্রহ নির্মাণ কক্ষ থেকে কোনরকম সাড়াশব্দ না পেয়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে সেই
কক্ষের দ্বার খোলার জন্য পীড়াপীড়ি করেন। এরপর মন্দিরের বন্ধ দরজা খোলার পর সেই
বৃদ্ধ ছুতোরকে দেখা গেল না। অর্ধসমাপ্ত বিগ্রহগুলো দেখে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে আছড়ে
পড়লেন ইন্দ্রদ্যুম্ন। জগন্নাথদেব সেদিন রাতেই তাকে স্বপ্নে নির্দেশ দিলেন, অপূর্ণ
বিগ্রহগুলোকেই পূজা-অর্চনা করতে।
জগন্নাথদেবের ত্রিমূর্তি হল
বলরাম, সুভদ্রা ও কৃষ্ণ বা জগন্নাথ। স্কন্দ-পুরাণে জগন্নাথদেব নীল মেঘের মত বর্ণ, কাঠ দিয়ে
তৈরি, শঙ্খ-চক্রধারী, বলভদ্র ও সুভদ্রা একসঙ্গে
অবস্থিত।
আর একটি মত এরকম, বিশ্বকর্মা নন, স্বয়ং জগন্নাথদেবই এক বৃদ্ধের ছদ্মবেশ ধারণ করে এ অলৌকিক দারু থেকে বিগ্রহ নির্মাণের অনুমতি নেন ইন্দ্রদ্যুম্নের কাছ থেকে। শ্রী জগন্নাথ মন্দিরে জগন্নাথ দেবের মূর্তি প্রতিষ্ঠার পরিপ্রেক্ষিতে আরেকটি কিংবদন্তি এরকম – সেই সময় স্বয়ং ব্রহ্মা স্বর্গ থেকে এসেছিলেন এবং এই বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার কাজে পুরোহিত হলেন। জগন্নাথদেব নিজেই স্বপ্নে ইন্দ্রদ্যুম্নকে তার নিত্য পূজা ও বিভিন্ন উৎসবের বিধি সম্বন্ধে উপদেশ দেন। ইন্দ্রদ্যুম্ন সেই অনুযায়ী সব রকম ব্যবস্থা নেন। তিনি শবর রাজা বিশ্ববসু ও পুরোহিত বিদ্যাপতির বংশধরদের এবং আরও কয়েকজন ব্রাহ্মণকে জগন্নাথের সেবায় নিযুক্ত করলেন। তখন থেকেই জগন্নাথের সব উৎসব পালিত হয়ে আসছে।
জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা
এবং রথযাত্রা সূর্যের অয়নপথ পরিক্রমার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সূর্যের দক্ষিণায়ন যাত্রা
সঙ্গে বর্ষাগমনের সম্পর্ক স্বতঃসিদ্ধ। আর বর্ষারম্ভেরই উৎসব জগন্নাথদেবের
স্নানযাত্রা। সূর্য-সপ্তাশ্ব বাহিত রথে আকাশলোক পরিক্রমণ করেন। জগন্নাথদেবও রথে
আরোহণ করে যাত্রা করেন। অয়নপথে সূর্যের দক্ষিণ দিকে যাত্রা ও উত্তরে প্রত্যাবর্তন
জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ইতিবৃত্ত। বলরাম ও সুভদ্রা জগন্নাথদেবের সঙ্গী।
স্কন্দ-পুরাণ মতে, জগন্নাথদেবের সঙ্গী বলরাম
বিষ্ণুর অনন্ত শয্যার অংশীদার।
শ্রীরামপুর কলেজের কেরী
লাইব্রেরিতে সুরক্ষিত নথিপত্র থেকে মাহেশের রথের নানাবিধ কথা জানা যায়। মাহেশের
রথযাত্রায় স্বয়ং রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও সারদামণি দেবীও এসেছেন বলে জানা যায়। এখন
মাহেশের রথ স্নানপিড়ি মাঠ থেকে মাহেশ মাসির বাড়ি পর্যন্ত যায়। এক সময় এই যাত্রা পথ
এত কম ছিল না। আগে রথটি চাতরার মদনমোহন মন্দির বা দোল মন্দির (বর্তমান কাশীশ্বর
পীঠ) পর্যন্ত যেত। মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যর অন্যতম পরিকর কাশীশ্বর তাঁর প্রভুর
নির্দেশে চাতরায় মন্দির নির্মাণ করে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। মাহেশের
জগন্নাথ মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা কমলাকর পিপলাই চাতরার কাশীশ্বর পণ্ডিতের পরামর্শেই
রথযাত্রা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে কাশীশ্বরের ভাগ্নে রুদ্ররাম ব্রহ্মচারী
প্রতিষ্ঠিত রাধাবল্লভ জিউর মন্দির পর্যন্ত মাহেশের রথ আনাগোনা করত। ১২৬২ বঙ্গাব্দে
মাহেশ ও বল্লভ-পুরের সেবাইতদের মধ্যে মনোমালিন্য শুরু হলে রথযাত্রার পথ সংকুচিত
হয়। শ্রীরামপুরের মিশনারিরা ‘ দি ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া’ নামে যে মাসিক পত্রিকাটি
প্রকাশ করতেন সেখানেও মাহেশের রথ সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা জানা যায়।
বঙ্কিমচন্দ্রের লেখায় দেখতে
পাই যে রাধারানী নামে এক বালিকা মাহেশের রথ দেখিতে গিয়াছিল। রুগ্ন মায়ের পথ্যের
জন্য পয়সা জোগাড় করার জন্য মেলাতে বিক্রি করবে বলে বনফুলের মালাও গেঁথে নিয়ে
গিয়েছিল। কিন্তু রথের টান অর্ধেক হতে না হতেই বড় বৃষ্টি আরম্ভ হল। বৃষ্টি দেখে
লোকেরা সব চলে গেল ও মেলা ভেঙে গেল। মালা কেউ কিনল না। ১৮১৮ সনের ১১ জুলাই (২৮ আষাঢ়, ১২২৫)
সমাচার দর্পণ পত্রিকার প্রতিবেদনে প্রায় এই ধরনেরই বিবরণ পাই। ‘ এ বৎসর অতিশয়
বৃষ্টি প্রযুক্ত কর্দম হইয়াছে ...... কতকদূর আসিয়ে রথের চক্র কর্দমে মগ্ন হইলে কোন
প্রকারেও লোকেরা উঠাইতে পারে না’। মাহেশের রথের বর্ণনা দিতে গিয়ে সমাচার দর্পণ
পত্রিকা লিখেছে – ‘মাহেশের রথ অতিবড়। এতবড় রথ এতদ্দেশে নাই, লোকযাত্রাও
অধিক হয়’। পরের বছর ১৮১৯ সনের ২০ জুন (৫ আষাঢ় ১২২৬) সমাচার দর্পণের প্রতিবেদনে
জানা যায় – ‘জগন্নাথ ক্ষেত্রের চাইতে মাহেশে ভিড় কিছু কম হয় না...... অনুমান দুই
লক্ষ লোক দর্শনার্থ আইসে’। প্রমথ নাথ মল্লিক লিখেছেন, ‘মাহেশে
স্নানযাত্রা ও রথে বাংলার লোকে লোকারণ্য হইত। তবে কলকাতার যাত্রীই অধিক’। তিনি আরও
লিখেছেন, ‘মাহেশে স্নানযাত্রা ও রথে বড়ই ধূম। কলিকাতা হইতে অনেকে ভাউলে পানসি করিয়া
আমোদ করিতে আসে’।
পুরানো দিনের কলকাতা শহরের
রথযাত্রা প্রসঙ্গে হুতোম লিখেছেন – ‘ কলকাতায় কিছু ফাঁক যাবার নয়। রথের দিন চিৎপুর
লোকারণ্য হয়ে উঠল। ছোটছোট ছেলেরা বার্ণিশ করা জুতো ও সেপাই পেড়ে ঢাকাই ধুতি পরে
কাজের লোকের হাত ধরে রথ দেখতে বেরিয়েছে’।
মাটির জগন্নাথ, কাঁঠাল, তালপাতার ভেঁপু, পাখা ও শোলার পাখি বিক্রি হচ্ছে’। ছোটদের দেখাদেখি বয়স্ক লোকেরাও তালপাতার ভেঁপু বাজাচ্ছেন।
সেকালের ধনী মানুষ নিজেদের
আভিজাত্য ও গৌরব বাড়াতে, গণ্যমান্য হবার জন্য মন্দির
প্রতিষ্ঠা করতেন। রথ প্রতিষ্ঠা করতেন। কেউবা এ কাজ করতেন মা-বাবার প্রীতি কামনায়।
এই উপলক্ষে ঘটা করে আত্মীয় স্বজনদের নিমন্ত্রণ, ব্রাহ্মণ
পণ্ডিতদের দান বিদায় দরিদ্রনারায়ণ সেবা ইত্যাদির ঢালাও আয়োজন করতেন। সংবাদ পত্রে
প্রকাশিত হত সেসব কথা। ১৮৩৪ সালের ২৪শে জুলাই (১২ শ্রাবণ, ১২৮১)
সমাচার চন্দ্রিকা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এমন একটি সংবাদ। জোড়া-বাগানের শিবনারায়ণ
ঘোষ মায়ের প্রীতির জন্য একটি রথ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ উপলক্ষে বিস্তর দানধ্যান
করেছেন। অনেক লোক খাইয়েছেন। আর নবদ্বীপ ও স্থানীয় ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা বিদায়
পেয়েছেন নগদ ৮ টাকা ও একটি করে ঘড়া।
দিল্লির হাউজখাসে জগন্নাথ
মন্দিরে রথযাত্রা উৎসব খুব ধূমধামের সাথে পালিত হয়। আগে সেখানে যাওয়া যেত অনায়াসে, তবে আজকাল
এত ভিড় হয় সেখানে ওই ভিড়ে ঢোকা প্রায় অসাধ্য হয়ে উঠেছে। এ থেকেই বোঝা যায় যে
প্রতিবছর এর জনপ্রিয়তা দিল্লিতে কত বাড়ছে। তবে দিল্লির অন্যত্রও নিশ্চয়ই রথযাত্রা
হয় তবে এত ভিড় নিশ্চয়ই সেখানে হয়না একথা বলা যেতে পারে। সেদিন সুস্বাদু খাজাও
কিনতে পাওয়া যায়।
তবে এখানে পশ্চিমবঙ্গের মত
ছোট ছোট বাচ্চাদের রথ নিয়ে ঘুরে বেড়ানো খুব একটা লক্ষ্য করিনি। যদিও চিত্তরঞ্জন
পার্ক, মহাবীর এনক্লেভ ও অন্যান্য কয়েকটি বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় একটু আধটু দেখা
যায়।
পল্লিবাংলার রথযাত্রা এবং
রথের মেলার কথা লিখেছেন – দীনেন্দ্রকুমার রায়। গোবিন্দপুরে বাড়ুজ্যেদের ঠাকুর রথে
স্থাপিত হইলেন। ...... পাড়ার ছেলেরা কামিনী গাছের ডাল, দেবদারু
পাতা, প্রস্ফুটিত কদম্ব-পূর্ণ কদম্ব-শাখা ভাঙিয়া আনিয়া তদ্বারা রথের আগাগোড়া
ঢাকিয়া ফেলিয়াছে। রথের চতুর্দিকে পুষ্পস্তবক ও পুষ্পমালা ঝুলিতেছ, পূজারি
ব্রাহ্মণেরা ‘বারকোষ ও পিতলের থালে ‘লুচি, মোহনভোগ, সন্দেশ, ক্ষীরছানা, আম কাঁঠাল
ইত্যাদির ভোগ দেবতাকে নিবেদন করছেন। আবার পথের দুইপাশে সদ্যোনির্মিত বিপণি শ্রেণী।
ময়রার দোকানে জিলিপি, মণ্ডামিঠাই, কুমোরের
দোকানে নানা রঙের পুতুল, মনোহারি দোকানেও ‘ ক্রেতার
সংখ্যা অল্প নয়’। বেলোয়ারি চুড়ির দোকানে মেয়েদের ভিড় লেগেই থাকত।
জগন্নাথদেব আদিম অবস্থায়
বৌদ্ধ দেবতা ছিলেন অথবা অনার্য দেবতা ছিলেন অথবা শাক্ত দেবতা ভৈরব ছিলেন, সে তত্ত্ব
নিছক অনুমানের ব্যাপার। জগন্নাথদেবের মূর্তি বৌদ্ধ দেবতা হলে তিনটি মূর্তির স্বরূপ
কি? তিনটি মূর্তি ত্রিরত্ন হলে এদের মধ্যে নারীমূর্তি সুভদ্রা এলেন কিভাবে? বুদ্ধদেবের
অস্থি বা অন্য কোনও স্মৃতিচিহ্ন জগন্নাথদেবের মূর্তির মধ্যে লুকায়িত আছে কিনা তা
নির্ণয় করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তবে এ কথা সত্যি যে, সূর্য, বিষ্ণুর
প্রভাব জগন্নাথদেবের ওপর আছে।
মূলত জগন্নাথদেব হলেন বিষ্ণু
অবতার। আর পৃথিবীতে অবতার আসে মানুষের মঙ্গল কামনা তথা সমাজ থেকে পাপ-পঙ্কিলতা দূর
করতে এবং অধর্মের নামে দুষ্টদের দমন করতে। হিন্দু সমাজের প্রত্যেক পূজা-অর্চনার
পেছনে পুণ্য অর্জনের একটা ব্যাপার থাকে । জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রাও তার ব্যতিক্রম
নয়। খুব সকালে উঠে জগন্নাথদেবের সঙ্গে স্নানযাত্রায় অংশগ্রহণকারী হাজার হাজার
পুণ্যার্থী মনে করে থাকেন, তাদের আগের যত পাপ-পঙ্কিলতা
থাকে স্নানযাত্রায় অংশগ্রহণ করলেই তা বিনাশ হয়ে যায় এবং অশেষ পুণ্য অর্জিত হয়। যুগ
যুগ ধরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এই বিশ্বাস চলে আসছে।
কেহ জল-ঘট দেয় মহাপ্রভুর করে।
কেহ জল দেয় তাঁর চরণ উপরে।
কেহ লুকাইয়া করে সেই জলপান।
কেহ মাগি লয় কেহ অন্যে করে
দান।
শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাই নয়, জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উৎসব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই উদযাপন করে থাকেন। এ উৎসব পরিণত হয় সব ধর্মের মানুষের মিলন মেলায়। এ উৎসবে অনেকে ভেদাভেদ ভুলে মিলিত হয় একই পথের আঙিনায়। তাই তো জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উৎসব এক অসাম্প্রদায়িকতার মিলন মেলায় পরিণত হয়। আসুন আমরা সবাই মিলে এই সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য বজায় রাখি। সবাই মিলে রথযাত্রার আনন্দ উপভোগ করি।
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন
লেখক পরিচিতি –
কালীপদ চক্রবর্ত্তী দিল্লি থেকে প্রায় ১৮ বছর ‘মাতৃমন্দির সংবাদ’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন এবং ‘সৃষ্টি সাহিত্য আসর’ পরিচালনা করেছেন।
দিল্লি, কলকাতা এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখেন। কলকাতার আনন্দমেলা, আনন্দবাজার পত্রিকা, সাপ্তাহিক বর্তমান, দৈনিক বর্তমান, নবকল্লোল, শুকতারা, শিলাদিত্য, সুখবর, গৃহশোভা, কিশোর ভারতী, চিরসবুজ লেখা (শিশু কিশোর আকাদেমী, পশ্চিমবঙ্গ সরকার), সন্দেশ, প্রসাদ, ছোটদের প্রসাদ, কলেজস্ট্রীট, উল্টোরথ, তথ্যকেন্দ্র, জাগ্রত বিবেক (দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির থেকে প্রকাশিত) , স্টেটসম্যান , কিশোর বার্তা অন্যান্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রকাশিত বই-এর সংখ্যা ৬ টি এবং প্রকাশের পথে ২টি বই।
‘ভারত বাংলাদেশ সাহিত্য সংহতি সম্মান’, পূর্বোত্তর আকাদেমির পুরস্কার, ‘বরুণা অসি’-র গল্প প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভ, আরত্রিক সম্মান, তুষকুটি পত্রিকা সম্মান, কাশীরাম দাস সম্মান, সতীনাথ ভাদুড়ী সম্মান লাভ করেন। ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে 'আজীবন সম্মাননা' লাভ করেন। এ ছাড়া আরও কিছু পুরস্কার লাভ করেছেন।
বর্তমানে দিল্লি থেকে প্রকাশিত 'কলমের সাত রঙ' ও www.tatkhanik.com এর সম্পাদক এবং দিল্লিতে প্রতিমাসে একটি সাহিত্য সভা পরিচালনা করেন।