Advt

Advt

paramatmiya-story-galpo-by-dr.sunandan-shikdar-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-পরমাত্মীয়-গল্প-ডাঃসুনন্দন-শিকদার

ধারাবাহিক বড় গল্প

১ম পর্ব

( ১)


 মন কোন অনিশ্চয়তার  ভয় ছিল না নন্দিনীর।  তিনি স্হির জানতেন, তিনি যা বলবেন তাই হবে । নিজের ছেলের ওপর ছিল অগাধ ভরসা। ছেলের নাম বাণীপ্রিয়। তার মুখ নিসৃত বাণী কাব্যময় বা  প্রিয় তা নয়বরং সে বদমেজাজের জন্যে যথেষ্ট  বিখ্যাত ছিল । বাড়িতে কতটুকুই বা থাকত বাণীপ্রিয়? তার চাকরি মার্চেন্ট নেভিতেমাসের পর মাস সে সাতসমুদ্রে ঘুরে বেড়াত।  যেকটি দিন ঘরে ফিরে বাড়িতে থাকত,আশেপাশের মানুষের কানে যেত সরকার বাড়ির তুমুল কলহ।  সবাই পরামর্শ দিল ছেলের বিয়ে দিন , তবে না মাথা ঠান্ডা হবে । অনেক তো হল । কথাটা  যুক্তিপূর্ণ লেগেছিল নন্দিনীর ।  দেরি না করে লেগে পড়েছিলেন পাত্রী দেখতে ।  অরুণবাবু এক রবিবার বাজার থেকে ফিরে বললেন ,

-          দেখেছ আজ পাত্র-পাত্রীর কলামে বাণীর বিজ্ঞাপনটা বেরিয়েছে ।

নন্দিনী  দুপুরের আগে কাগজ পড়েন না ।  স্বামীর নামিয়ে রাখা  বাজারের ব্যাগ  থেকে কাগজের ক্রোড়পত্রটি  বের করলেন ।  নিয়ে এলেন জানলার কাছে । 

সেখানে উজ্জ্বল আলোয় শ্রেণীবদ্ধ বিজ্ঞাপনের সারিতে চোখ বোলাতে লাগলেন । সপ্তম সারির বাঁ কোনে  বাণীপ্রিয়ের বিজ্ঞাপনে পৌঁছলেন এত টাকা দেওয়ার পরও কী ছোট হরফেই না বেরিয়েছে। কাগজও এত মূল্যবান ।

নন্দিনী  পাতাটিকে আলাদা করে রেখে দিলেন । আর রাখতে রাখতেই ফোন ।

একটার পর একটা ফোন , আর বেজেই চলেছে ।

চন্দননগর , গড়িয়া , বাগুইআটি , পুরুলিয়া , কুচবিহার , রাজস্হান , দিল্লী –

এত মানুষ সকালেই চোখ রাখে কাগজে ।

ছেলের বাড়ি বলে কথা । ওদিকের ভাষা অবশ্যই গদগদ্ । তবে  সকলের নয় ।  বিশেষ করে গড়িয়ার ফোনটা । বিশেষণহীন কেজো ফোনটি বেশীক্ষণ  ধরে রাখতে পারলেন না নন্দিনী । বরং প্রবাসী ফোনে কিছু অবাঙালীসুলভ টান থাকলেও মধুরতার অভাব ছিল না   সকলের কথা মার্চন্ট নেভির চাকরি নামক ডুবো পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে যায় । তারপর ফের ভদ্রতার  স্রোতে ভাসতে ভাসতে বন্দরে গিয়ে পৌঁছোয় ।

অনেকগুলিই কথা হয়েছে এই কদিনে ।  দুটি বাড়ি পছন্দ হয় নন্দিনীর ।  একটি বাগুইআটির , অন্যটি হুগলীর । একটি মেয়ে কমার্সে স্নাতক, অন্যজন শিক্ষিকা । বি এড । উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে পড়ানো শুরু করেছে  । নন্দিনী ঠিক করলেন এই দুই পরিবারের সঙ্গে কথা এগিয়ে নিয়ে যাবেন

অরুণবাবু কথা কমই বলেন । পাত্রী নির্বাচন আর  বিয়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তো নয়ই । মত দিলে  মতের অভিমান গৃহকত্রী রাখবেন কিনা সেই বিষয়ে  নিসন্দেহ নন  অরুণ  ।  তবু নন্দিনী তাঁর মতামত চায় ,

-          এটুকুও কি তুমি ঠিক করতে পারো না ?

পারলে অবশ্য  তাঁর মত তিনি মেনে নিতেন কিনা তা তিনিও হয়ত জানতেন না ।

অরুণের হাতে একটি মদের গেলাস । এই নৈশকর্মটি তাঁর বহুদিনের অভ্যাস । এইসময়ই তাঁর মতামত নেন নন্দিনী । একটি দামী কাঠের টেবিলে ঝুঁকে আর  একটি অভিজাত চেয়ারে বসে ড্রিঙ্ক করেন । মদের বোতলের হলুদ লেবেলের ওপর  স্তিমিত আলো ।  এই নেশা  বহু পুরোণ- তিনিও ছিলেন মার্চেন্ট নেভিতে।  বহু জায়গায় ঘুরেছেন । মাসের পর মাস দূর সমুদ্রে কাটিয়েছেন । একাকি এই সমটা কাটিয়ে এ রকমই একটা অভ্যসে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন  গত কুড়ি বছর  ।  রেডিওয়ে গান বাজছে , চারিদিকে সমুদ্রের নিস্তব্ধতা।  পাশের ঘর থেকে চামচ আর প্লেটের শব্দ। একদমই ইচ্ছে ছিল না ছেলে মার্চেন্ট নেভিতে যায় । কিন্তু বিধাতা বোধহয় মুচকি হেসেছিলেন । বাবার কথা শুনে শুনে সমুদ্রের প্রতি ছেলের ছিল অপ্রতিরোধ্য টান । সেইখানেই অরুণের ইচ্ছা অনিচ্ছা ভেসে গেল ।

অরুণ  ভাবতে লাগলেন তাঁর সমুদ্র যাত্রার দিনগুলি ।   সেই একাকীত্ব আর স্বাধীনতা  আসবে না কোনদিনআকাশভরা তারা,তার নীচে জাহাজ ভেসে যাচ্ছেসিঙ্গাপুর বন্দর , এডেন , মাদ্রাজ, কেপ টাউন – কত জায়গায় না তাঁকে ঘন ঘন ঘুরতে হয়েছে ।  নোঙর করতে হয়েছে । মাল তোলা-নেওয়া করতে হয়েছে ।   কিছু  খাওয়া বড়ই  আশঙ্কার ব্যাপার ছিল । একজনই কুক – সে মাংস ছাড়া কিছু রান্না করতে জানত না ।   সেই সব পেরিয়ে এতগুলি বছর কাটিয়ে তো দিয়েছিলেন । ছেলে কী পারবে মার্চেন্ট নেভির এইসব বাধা সামলে নিজের কেরিয়ার শেষ করতে  ?

( ২)

অনেকটা  গলিঘুঁজির মধ্যে বাড়িটা গলিগুলি বেশ সরু ছেলে আসার আগে পাত্রী দেখে পারিবারিক একটি সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছেন নন্দিনী পাত্রীর বাপের বাড়ি একটি আবাসনে নতুন নয় – বিবর্ণ দেয়াল দেখলে বোঝা যায় কয়েক বছরের পুরাতন । আবাসনের চারিদিকে দেয়াল  ।  গেট একটা আছে বটে কিন্তু সেটি সাধারণত খোলাই থাকে । একটি লোমওয়ালা কুকুর গেটের সামনে বসে । এগিয়ে গেলেন অরুণবাবু । লিফট নেই । এবড়ো- খেবড়ো সিঁড়ি বেয়ে পায়ে হেঁটেই তিনতলায় উঠলেনবাতে কাতর নন্দিনী  পিছন পিছন দেয়াল  ধরে  ওপরে উঠছেন । তিনতলায় উঠে হাঁফাতে থাকেন নন্দিনী।   তারপর সিঁড়ির রেলিং ধরে  একদন্ড শ্বাস নিয়ে  বেল বাজালেন । দরজা খুলল পাত্রী নিজেই ।

মেয়েটি সুশ্রী কিন্তু বেশ রোগা । চাপা রঙ । চোখের কোণে একটি আঁচিল আছে ।  পরনে নীল সালোয়ার । কোন সাজগোজ করেনি । নন্দিনী  সোফায়  এসে বসলেন । বসার ঘরে দুটি সোফা। একটু দূরে ডাইনিং টেবিল । তাতে একটি জলের জগ রাখা । দেওয়ালে ক্যালেন্ডারের পাতা উড়ছে।   নন্দিনী অনেকক্ষণ ধরে মেয়েটিকে দেখছেন । অরুণবাবুর এসবে ভ্রুক্ষেপ নেই । তিনি এরমধ্যেই একদিনের বাসি কাগজটা তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করেছেন

নিশ্চই অনেকগুলি পাত্রপক্ষের দলবল দেখা করে গেছে কারণ মেয়েটির মধ্যে কোন  দ্বিধা নেই ।  বেশ সহজ ভাবেই কথাবার্তা বলছে । নন্দিনী কথার স্রোতে ভেসে গেলেন । ভেসে যেতে যেতে জিজ্ঞাস করলেন ,

-          এখন কি কোথাও চাকরি কর ?    

 মেয়েটি অবলীলায় বললে ,

-          না । বিয়ের পর কোথায় থাকব ঠিক নেই , এখন জয়েন করে কী করব ?   

মেয়েটির  আত্মবিশ্বাসে আশ্চর্য না  হয়ে উপায় নেই ।  কোন সংকোচ না করেই বললে ,   

-          ইন্টারভিউ দিলেই  চাকরি যে পেয়ে যাই ।   আচ্ছা আপনাদের বাড়ির কাছে মোমোর  দোকান আছে ?

মেয়েটির নাম বর্ণালী । তাকে সামলাতে তার বাবা বলে উঠলেন ,

-          ভিতর থেকে দুকাপ কফি নিয়ে আয় তো মা ।

বর্ণালীর বাবা আশুতোষ,গমনোদ্যত  মেয়ের দিকে চেয়ে ফের বললেন ,

-          মেয়েটা বড় সোজাসাপ্টা । কিছু মনে করবেন না ।

-          না,না কি মনে করব ।  এক একজন মানুষ তো এক এক রকম হবেই । 

কথাটি যেন অনাবশ্যক জোর দিয়ে বললেন নন্দিনী । তাঁর এখনো ভাল বা মন্দ কোনটাই লাগেনি। সাধারণতঃ তাঁর পছন্দ বা অপছন্দ হতে সময় লাগে না  ।  কিন্তু তাঁর একটি  বিরল ক্ষমতা আছে বলে তিনি বিশ্বাস করেন । অনেকে যা দেখতে পান না তা তিনি দেখতে পান ।  এই ক্ষমতা যেন তাঁর ঈশ্বরদত্ত ।  হঠাৎ তাঁর  মনে হয় যেন  বর্ণালীর মধ্যে কোন একটা  অলৌকিক ব্যাপার আছে। কি অলৌকিক ব্যাপার তিনি বুঝতে পারছেন না,কিন্তু আছে

কফির ট্রে হাতে বর্ণালী ফিরে এসেছে । পিছনে পিছনে তার মা শিখা । অত্যন্ত যত্নসহকারে ট্রেটি নামালে টি-পাইয়ের ওপর । ধপধপে সাদা কাপে গরম কফি ।  ধোঁয়া উঠছে । এক একটি চুমুক দিতে দিতে নন্দিনী নজর চলে যাচ্ছে মেয়েটির দিকে । অনেক কথা হল । বর্ণালী  ইংরেজি মাধ্যম স্কুল থেকে পাশ করে কমার্স পড়েছে । কিন্তু কয়েক বছর  স্কুলে পড়িয়ে এখন মাসকয়েক বাড়িতে। শখ বলতে ফুলের গাছ করা । ফুলের প্রতি তার আশ্চর্য একটা টান । নানা জায়গায়  - ঘরের কোনে , সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে , ছাদে ফুলের টব ও নানা রকম ফুল । কোথাও গাঁদা , কোথাও সূর্যমুখি, কোথাও প্যানজি ,  কোথাও ডালিয়া ।

যখন অরুণ উঠব উঠব করছেন তখন  আশুতোষ বললেন ,

-          মেয়ের  প্রশংসা করা উচিত নয় তবু বলছি  ও খুব অনেস্ট । খুব সোজা সাপ্টা । আর ফুল অন্ত প্রাণ ।

লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।

ক্রমশ ………

২য় পর্ব পড়ুন আগামী শনিবার ।

 লেখক পরিচিতি –

জন্ম  ১৯৭৪  পেশায় চিকিৎসক এমডি , ডিএম  কার্ডিওলজিস্ট ) কবি , সমালোচক , রবীন্দ্র অনুরাগী  শনিবারের চিঠির সম্পাদক সজনীকান্ত দাসের পৌত্র 

ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে নবকল্লোল , শনিবারের চিঠি ( নবপর্যায় ) , সুদক্ষীণা , গল্পপত্র , কাথাসাহিত্য , শারদীয়া দক্ষীণীবার্তা , কবিতা  গল্প বারোমাস , কালপত্রী , ইছামতি বিদ্যধরী অন্ধপক্ষ প্রভৃতি পত্রিকায়  নানা লিটল ম্যাগাজিনে

গল্পগ্রন্থ : সৈকত শিল্পী , বনবিহঙ্গ  

উপন্যাস:  সমান্তরাল