বাদশাহ জাহাঙ্গীরের (Jahangir) নাম তো
সবারই জানা। ইতিহাস বইয়ে পড়ে থাকবেন। বাদশাহ জাহাঙ্গীরের প্রধান
শিকারীর নাম ছিল, ইমাম বির্দি । একদিন এই ইমাম
বির্দি একটি ধূসর রঙের তিতির পাখি হাতে
নিয়ে খুব বিস্ময়ে দেখছিলেন। তিনি জানতেন যে পুরুষ
তিতিরের পায়ে কয়েকটা ধারালো নখের মত থাকে,কিন্তু
স্ত্রী তিতির-এর ক্ষেত্রে তা থাকে না। কিন্তু এই
পাখিটি পুরুষ না মহিলা তা তিনি বুঝতে পারছিলেন না। মনে মনে ভাবলেন,রাজা তো নিজেকে
পাখিদের বিশেষজ্ঞ বলে মনে করেন, এইবার তার
জ্ঞান পরীক্ষা করার সুযোগ এসেছে। দেখা যাক তাঁকে
জিজ্ঞাসা করে, তিনি কি বলেন।
গ্রীষ্মকালের এই দুপুরে শিকার করতে বেরিয়ে ব্যর্থ হয়ে বাদশা একটি গাছের তলায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সে সময় ইমাম বির্দি বাদশাহের সামনে এসে দাঁড়ান। বাদশা একটু বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকান। তখন খুব নম্র সুরে বির্দি বাদশাহকে বলেন, মাফ করবেন হুজুর, এই পাখিটি স্ত্রী না পুরুষ একটু যদি বলে দেন তাহলে ভাল হয়। ইতিমধ্যে অন্যান্য শিকারীরাও সেখানে এসে জড় হয়েছিলেন। সবাই এই পরীক্ষার ফলাফল জানার জন্য উৎসুক হয়ে ছিলেন। বাদশা পাখিটিকে হাতে নিয়ে ভাল করে পরীক্ষা করেই নিশ্চিত ভাবে বলেন যে এই পাখিটি স্ত্রী পাখি। একথা বলে পাখিটিকে তিনি ইমাম বির্দিকে ফেরত দিয়ে দেন।
বাদশার এই সিদ্ধান্তকে প্রমাণ করার জন্য পাখিটিকে কেটে দেখা গেল যে পাখিটির পেটে কয়েকটা ডিম আছে এবং বাদশাহর কথাই ঠিক। এতে যারা বাদশাহকে পরীক্ষা করতে এসেছিলেন তাদের মধ্যে বির্দি ও উপস্থিত অনেকেই বেশ লজ্জিত বোধ করলেন। তাঁরা বাদশাহর প্রশংসা করলেন কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না যে বাদশাহ কি করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিলেন। বাদশাহকে জিজ্ঞাসা করাতে, বাদশাহ জাহাঙ্গীর জাহাঙ্গীর সূরার পেয়ালায় চুমুক দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, "পাখিটির ঠোঁট দেখে আমি এটিকে স্ত্রী পাখি বলে চিনেছি। ওর ঠোঁটের ডগাটা খুব ছোট।" জাহাঙ্গীর যে শুধুমাত্র পক্ষী বিশারদ ছিলেন তা নয়, প্রাণীজগত ও উদ্ভিদজগতের খবরও তিনি রাখতেন "তুজুক-ই-জাহাংগীরিতে” (জাহাঙ্গীরের স্মৃতিকথা) তাঁর এই পরীক্ষা নিরীক্ষার কথা লেখা আছে।
হিন্দু রানী, অমুরের রাজা ভরমলের কন্যার গর্ভে,আকবর পুত্র জাহাঙ্গীরের জন্ম হয়। ১৬০৫ খৃষ্টাব্দের ২৪ শে অক্টোবর তিনি বাদশা পদে অভিষিক্ত হন। ১৬২৭ খৃষ্টাব্দের ২৮ শে অক্টোবর তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ২২ বছর ধরে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁকে অনেক যুদ্ধ লড়তে হয়েছিল এবং অনেক বিদ্রোহ দমন করতে হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর শখ হিসেবে প্রকৃতি বিজ্ঞানের চর্চা করার সময় বের করে নিতেন। তিনি পশুপাখীর বিভিন্ন বৈশিষ্টা,তাদের ভৌগলিক বাসস্থান এবং তাদের স্বভাব সম্পর্কে এত যত্ন সহকারে সঠিক ভাবে লিখে গেছেন যে,যদি কোনও পেশাদার প্রকৃতি বিজ্ঞানী এরকম রচনা লিখতে পারতেন, তবে তিনি যথেষ্ট প্রশংসার পাত্র হতেন। বিশ্ববিখ্যাত পক্ষী বিশারদ সলীম আলী বলেছেন, "তাঁর 'তুজুক-ই জাহাঙ্গীরি' সেকালের ভারতের জীববৃত্তান্তের একটি প্রামাণিক গ্রন্থ।"
ফ্লোরিকান, ডিপার, হক-কুক্কু ইত্যাদি
পাখী এবং বাঁদর (pole- cat পোলক্যাট)
ইত্যাদি জন্তুর সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে তাঁর লেখা খুবই উল্লেখযোগ্য।
হাতীর গর্ভাবস্থা যে ১৮ থেকে ১৯ মাস থাকে এবং সারস
পাখীরা কিভাবে জোড়ায় জোড়ায় থাকে তার বিশদ বিবরণ জাহাঙ্গীর অনেক আগেই লিখে গেছেন।
অথচ,উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত যে সমস্ত প্রাণী-বিজ্ঞানীরা তাঁর লেখা
পাননি তাঁরা এ কথা জানতেন না।
তাঁর নিজের একটি ছোট চিড়িয়াখানা
ছিল। তিনি সেখানকার সব পশু পাখিদের এক একটি বিষয় নিয়ে
গভীরভাবে নিরীক্ষণ করে অনেক সময় কাটাতেন। এমন কি
দিনের পর দিন রাতের পর রাতও কেটে যেত। পক্ষী বিজ্ঞানীদের মধ্যে তিনি প্রথম
নিরীক্ষণ করেন সারস পাখি কি ভাবে মেলামেশা করে,পালাক্রমে
ডিমে তা দেয় এবং সারস পাখীর বাচ্চা ডিম ফুটে কিভাবে বেরিয়ে
আসে ইত্যাদি। এ সব তিনিই প্রথম লক্ষ্য করেন।
তিনি এই সারস পাখীদের মধ্যে একটি মনুষ্য স্বভাব সুলভ গুণ লক্ষ করেছিলেন। সেটি
হলো পুরুষ ও স্ত্রী পাখি তাঁদের ডিম ও বাচ্চা ছাড়াও পরস্পরকে ভালবাসে। যেমন
আমাদের মানুষদের মধ্যে দেখা যায়।
উদ্ভিদবিদ্যা ও উদ্যান
বিদ্যা সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত পরিমাণে ছিল। তবে
তিনি বাগান করতে ভালবাসতেন। কি ভাবে পদদ্মফুলের
মধ্যে ভ্রমর আটকে যায় এবং কিভাবে জাফরাণের
অঙ্কুরোস্থ হয়,এর বেশি বিশেষ কিছু তিনি লক্ষ্য করেননি।
তবে এছাড়া বিজ্ঞানের
অন্যান্য বিভাগ সম্পর্কেও তাঁর যথেষ্ট উৎসাহ ছিল।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে মামুদাবাদের (গুজারাত) আবহাওয়া যে আমেদাবাদের থেকে
স্বাস্থ্যকর, এটা তিনি পরীক্ষার দ্বারা
প্রমাণ করে ছিলেন। এছাড়া তাঁর সময়ে চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ
এবং যখন কোনও ধূমকেতু দেখা যেতো,সে সব
তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তিনি ধূমকেতুর ল্যাজের বৃদ্ধি এবং ক্ষয় ইত্যাদি সম্পর্কে
কিছু তথ্য লিখে গেছেন। এছাড়া পাহাড়ের অনেক উপরে যে সমস্ত গাছ হয়,যেমন চির,পাইন
প্রভৃতি,তিনি এসব গাছগুলো সমতলে নিয়ে এসে তাদের চাষ করান।
তাঁর সভায় কয়েকজন বিখ্যাত
চিত্রশিল্পী ছিলেন। তিনি যখনই কোনো দুষ্প্রাপ্য পশুপাখি অথবা উদ্ভিদের খোঁজ পেতেন,তখনই তিনি
ছবি আঁকার জন্য একজন চিত্রশিল্পীকে ডেকে পাঠাতেন। এই ধরণের ছবি আঁকায় ওস্তাদ মনসুর
তখন খুব নাম করেছিলেন। সম্রাট তাঁকে ঐ জন্য "নাদির উল- আসার" উপাধি দেন।
দুর্ভাগ্যবশত: তাঁর এই ছবি সংগ্রহের অধিকাংশই বিশেষ করে গাছপালা এবং ফুলের ছবি,মোগল
সাম্রাজ্যের পতনের সাথে সাথে বিদেশী আক্রমণ কারীরা লুটপাট করে নিয়ে গেছে। আজ যদি
সেই অমূল্য সংগ্রহ আমাদের দেশে থাকতো তবে প্রকৃতিবিদদের কাছে সেকালের প্রকৃতি
জগতের এক বিশদ এবং তথ্যপূর্ণ ইতিহাস সহজলভ্য হতো।
১৯৫৮ সালে সোভিয়েট গবেষক এ,ইভানভ
সোভিয়েট বিজ্ঞান আকাদমীর প্রাচ্যবিভাগের চিত্রসংগ্রহশালায় ডোডো নামে একধরণের পাখির
ছবি আবিষ্কার করেন। তাঁর এই আবিষ্কার বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল, কারণ ঐ
পাখী প্রায় তিন শতাব্দী আগে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ঐ ছবিতে শিল্পীর
নামের কোনও উল্লেখ পাওয়া না গেলেও, চিত্রশৈলী
থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে ছবিটি ওস্তাদ মনসুরেরই আঁকা। ১৬২৪ সালে এক সওদাগর
মরিশাস থেকে একটি ডোডো পাখি এনে সম্রাটকে উপহার দিয়েছিল। এই ছবিটি সেই ডোডোরই ছবি।
এইভাবে তিন শতাব্দী পর ঐ ডোডোর মাধ্যমে জাহাঙ্গীরের নাম নাটকীয়ভাবে আন্তর্জাতিক
পক্ষীবিশারদদের জগতে আবার প্রকাশ পায়।