দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে । শীতের আদুরে রোদ অনেকক্ষণ পড়ে থেকে থেকে , ঘাস থেকে শুকিয়ে গিয়েছে । খিচুড়ির গন্ধে বাতাস ভারি । এমন কতদিন খায়নি জাহ্নবী । যত পার খাও-
এমন
ভাবা যায় ?
খিচুরি – তা সে হোক না মোটা চালের , দু দুটি বেগুনি , ঝুরো আলুভাজা -
শেষ
পাতে আবার আমরার চাটনি ।
ফার্মহাউসের
প্রকান্ড
বাগান । তার শেষ প্রান্তে বসেছে হাঁটু মুড়ে । শাদা চুলগুলি মাটির দিকে ঝুলে পড়েছে । পরনে কালো পাড় শাদা থান । যুগ যুগান্তর থেকে সে ছিল এ তল্লাটের আয়া । প্রায় কুড়ি - তিরিশ বছর , বর্ধিষ্ণু ঘরে সন্তান জন্মালেই ডাক পড়ত তার । শিশু শুয়ে আছে কাঁথায় । বিষ্টামাখা কাঁথা – কে করবে পরিস্কার ? আয়ামাসীকে ডাক –
জাহ্নবী
অনেকক্ষণ
থেকে চাটছে , কড়া-পড়া আঙুলে লেগে থাকা চাটনির রেশ । মাথার ওপর যে নিমগাছটার ছায়া গাঢ় হচ্ছে , ঘরেফেরা
পাখিদের
কলরব , সেসবে তার কোন খেয়াল নেই । দুটি সারি দিয়ে বসেছে আশেপাশের গ্রামের মানুষ । সামনের ঘাসে রাখা শালপাতায় পড়ে আছে ছিটেফোঁটা খিচুড়ি আর রস নিঙড়ানো লেবু ।
ঠিক
তখনি উল্টোদিকে বসা বসন্ত ফিসফিসিয়ে বলে ,
- আসছে , আসছে -
জাহ্নবী
প্লাস্টিকের
গ্লাসে
রাখা জলে হাত ধুয়ে , শাড়ির খৈনি বাঁধা আঁচলে মোছে
। গুঞ্জনটা এদিকেই আসছে । আশেপাশে ধুলো । কারণ অনেকগুলি মানুষ আসছে । মাঝখানে একজন দীর্ঘকায় মানুষ, কাঁধে তাঁর হলুদ রঙের শাল ।
বসন্ত
বলে ,
- দাদাবাবুর মাথায় টাক-টা এ বছর বেড়েছে । গেল বছর এত ছিল না গো । ছুইডেনে গেলে টাকা বাড়ে । টাকও বাড়ে ?
- বাবু এলে টিপ করে পেন্নাম করিস !
- করব না আবার ? অলাবৎ করব । গেরামের ছেলে , কত পড়াশোনা করল , কোলকাত্তা
গেল , দিল্লী
গেল , তারপর ছুইডেন গিয়ে গেরামের মুখ উজ্জ্বল করল । কত বড় চাকরি করে , তবু গেরামের কতা ভুলতে পারেনি । পতি বচ্ছর পনেরো দিনের জন্যে আসে
। তার মধ্যি এক দিন পুরো গেরামের সব্বাইকে খাওয়ায় । নিজের ভিটে বাড়িয়ে ফার্মহাউজ করেছে । এ
কী চাড্ডিখানি কতা ?
- বাবুর আমার খুব বড় মন । মানুষ তো বড় হয় , মন আর বাড়ে কই ?
- মনটা ফার্মহাউজের মত বড় – এর দেয়াল , বারান্দা , বাগানটা দেখলে মনে হয় আমরা দাদাবাবুর মত বড় হই- তারপর মনটা দুখে ভরে যায় –
- ঠোঁটের ওপর এই কাটা দাগটা দেখেছিস ?
- হাঁ-
- বাবুর তখন তিন বছর বয়স । ইজের পরা শুরু করেছে । মুরগী দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম।
বাবুকে
বাঁচাতে
গিয়ে ঠুকরে দিয়েছিল আমায় ।
শোরগোলটা বেড়ে গিয়েছে । কাছেই , দুটি সারির মধ্যে দাঁড়িয়ে টাকমাথা ভদ্রলোক । পিছন থেকে কেউ বলছে – অনিমেষবাবু
কম্বল শেষ হয়ে গেছে - বেশি কাঙালি চলে এসেছে এবছর – এবার কি দেবেন ?
সামনেই দাঁড়িয়ে শাল জড়ানো অনিমেষ মুখুজ্জ্যে ।
সসব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায় জাহ্নবী । একটি চোখে চালসে , অন্য চোখটি অধীর আগ্রহে চেয়ে থাকে আপন কৃষ্ঞাঙ্গ মুখের বলিরেখা ভেদ করে।
- ছেলেমেয়ে সব ভাল তো বাবু ? বৌমা ? বৌমা আসেনা বাবু –
- দেখি, পরের
বছর যদি আসে ।
- হাজার হোক মেম তো , গরমে কষ্ট হবে । ওঁর তো তুমার মত টান নাই শিকড়ের –
- আয়া-মা , কম্বল শেষ হয়ে গেছে – প্রতি বছর তো দিই – এবারেরটা বাড়িতে পাঠিয়ে দেব।
- তুমার আয়া-মা ডাক খুব মিষ্টি । প্রতি বছর এই ডাকটার জন্যেই এই ফারমহাউজে আসি।
কত ছেলেমেয়েকে মানুষ করলাম , কে মনে রাখলে ? সবাই আসে না , সবাই রাখে না ।
- তোমার কম্বলটা আলাদা করে যদি সরিয়ে রাখতাম !
- কম্বল থাক । আমার একটা আর্জ্জি আছে বাবু ।
- বলো –
- আমিও তো মা । আমারও তো ইচ্ছে হয় মোর ছেলের তরে।
এই বসন্ত বল্ না –
বসন্ত ঝুঁকে প্রণাম করে । কিন্তু মুখ দিয়ে কথা সরে না ।
- বসন্ত আমার খুব লাজুক কিনা । বড্ড সাদাসিধা ছেলে । ওকে তুমি ছুইডেনে নিয়ে গিয়ে একটা কাজ দাও বাবু । তোমার বাজারটাজার করে দেবে , ফাই ফরমাস খাটবে ।
- ও কি করে ?
- সেই যে মাধ্যমিকের সময় থেইকে মাছ ধরার নেশায় পাইল – এখনো বর্ষার সময় জেলের সঙ্গে নৌকায় ওঠে – মাছ ধরে , সামান্য কিছু পায় – গরমের সময় কুয়ো খোঁড়ে-
- সুইডেন বড্ড দূর , বরফ পড়ে ছ’মাস ।
- তা হোক । না হয় দূরেই গেল – ক্ষতিই বা কী । বাবু তুমিও তো আছো । বুকের ভিতর শিকড় থাকুক –
- অতদূর ছেলেকে ছেড়ে দেবে ?
- ডালপালা যে আলোর দিকে যেতে চায় বাবু । আমার বসন্তরে তুমি নিয়ে যাও ছুইডেনে ।
- ওকে কি নেবে ? ঢুকতে দেবে ?
- ওদের কি কুয়ো খুঁড়তে লোক লাগে না বাবু ?
জাহ্নবী নিচু হয়ে ধরতে যায় অনিমেষ মুখুজ্জ্যের পা । ত্বরিতে পিছিয়ে যেতে হয় তাঁকে । কেমন অসহায় লাগে । চারিদিকে আঁধার নামছে । পিছনে খালি হয়ে আসছে জনতা । স্তিমিত হয়ে আসছে কোলাহল । বাগানের ঝোপে এক দুটি জোনাকি , জ্বলে উঠছে আবার নিভে যা্চ্ছে । এ বছরের মত ফার্মহাউসের স্মৃতি তুলে রেখে , কাল বাদে পরশু একা ফিরে যেতে হবে স্টকহোম। জলস্থল পেরিয়ে , তিনি ছাড়া হয়ত আর কেউ আসবে না , কখনও আসবে না , বেদনাবিধুর এই বিশাল ফার্মহাউসে। এই মাটি , হাস্নুহানা ফুল আর বিকেলের এই বাতাসের গন্ধে , তাঁকেই কেবল জ্বলতে হবে , জ্বলতে জ্বলতে পুড়তে হবে । একাকী । একাকী ।
লেখক পরিচিতি –
জন্ম ১৯৭৪ । পেশায় চিকিৎসক , এমডি , ডিএম ( কার্ডিওলজিস্ট ) । কবি , সমালোচক , রবীন্দ্র অনুরাগী ও শনিবারের চিঠির সম্পাদক সজনীকান্ত দাসের পৌত্র ।
ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে নবকল্লোল , শনিবারের চিঠি ( নবপর্যায় ) , সুদক্ষীণা , গল্পপত্র , কাথাসাহিত্য , শারদীয়া দক্ষীণীবার্তা , কবিতা ও গল্প বারোমাস , কালপত্রী , ইছামতি বিদ্যধরী, অন্ধপক্ষ প্রভৃতি পত্রিকায় ও নানা লিটল ম্যাগাজিনে।
গল্পগ্রন্থ : সৈকত শিল্পী , বনবিহঙ্গ ।
উপন্যাস:
সমান্তরাল
।