Advt

Advt

farm-house-story-galpo-by-dr.-sunandan-shikdar-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-ফার্মহাউস-গল্প-ডাঃসুনন্দন-শিকদার

farm-house-story-galpo-by-dr.-sunandan-shikdar-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-ফার্মহাউস-গল্প-ডাঃসুনন্দন-শিকদার

দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে শীতের আদুরে রোদ অনেকক্ষণ পড়ে থেকে থেকে , ঘাস থেকে শুকিয়ে গিয়েছে খিচুড়ির গন্ধে বাতাস ভারি এমন কতদিন খায়নি জাহ্নবী যত পার খাও-

এমন ভাবা যায় ?

খিচুরিতা সে হোক না মোটা চালের , দু দুটি বেগুনি , ঝুরো আলুভাজা -

শেষ পাতে আবার আমরার চাটনি

ফার্মহাউসের প্রকান্ড বাগান তার শেষ প্রান্তে বসেছে হাঁটু মুড়ে শাদা চুলগুলি মাটির দিকে ঝুলে পড়েছে পরনে কালো পাড় শাদা থান যুগ যুগান্তর থেকে সে ছিল তল্লাটের আয়া প্রায় কুড়ি - তিরিশ বছর , বর্ধিষ্ণু ঘরে সন্তান জন্মালেই ডাক পড়ত তার শিশু শুয়ে আছে কাঁথায় বিষ্টামাখা কাঁথাকে করবে পরিস্কার ? আয়ামাসীকে ডাক

জাহ্নবী অনেকক্ষণ থেকে চাটছে , কড়া-পড়া আঙুলে লেগে থাকা চাটনির রেশ মাথার ওপর যে নিমগাছটার ছায়া গাঢ় হচ্ছে , ঘরেফেরা পাখিদের কলরব , সেসবে তার কোন খেয়াল নেই দুটি সারি দিয়ে বসেছে আশেপাশের গ্রামের মানুষ সামনের ঘাসে রাখা শালপাতায় পড়ে আছে ছিটেফোঁটা খিচুড়ি আর রস নিঙড়ানো লেবু  

ঠিক তখনি উল্টোদিকে বসা বসন্ত ফিসফিসিয়ে বলে ,

-       আসছে , আসছে

জাহ্নবী প্লাস্টিকের গ্লাসে রাখা জলে হাত ধুয়ে , শাড়ির খৈনি বাঁধা আঁচলে  মোছে গুঞ্জনটা এদিকেই আসছে আশেপাশে ধুলো কারণ অনেকগুলি মানুষ আসছে মাঝখানে একজন দীর্ঘকায় মানুষ, কাঁধে তাঁর হলুদ রঙের শাল

বসন্ত বলে ,

-       দাদাবাবুর মাথায় টাক-টা বছর বেড়েছে গেল বছর এত ছিল না গো ছুইডেনে গেলে টাকা বাড়ে টাকও বাড়ে ?

-       বাবু এলে টিপ করে পেন্নাম করিস !

-       করব না আবার ? অলাবৎ করব গেরামের ছেলে , কত পড়াশোনা করল , কোলকাত্তা গেল , দিল্লী গেল , তারপর ছুইডেন গিয়ে গেরামের মুখ উজ্জ্বল করল কত বড় চাকরি করে , তবু গেরামের কতা ভুলতে পারেনি পতি বচ্ছর পনেরো দিনের জন্যে  আসে তার মধ্যি এক দিন পুরো গেরামের সব্বাইকে খাওয়ায় নিজের ভিটে বাড়িয়ে ফার্মহাউজ করেছে   কী চাড্ডিখানি কতা ?   

-       বাবুর আমার খুব বড় মন মানুষ তো বড় হয় , মন আর বাড়ে কই ?

-       মনটা ফার্মহাউজের মত বড়এর দেয়াল , বারান্দা , বাগানটা দেখলে মনে হয় আমরা দাদাবাবুর মত বড় হই- তারপর মনটা দুখে ভরে যায়

-       ঠোঁটের ওপর এই কাটা দাগটা দেখেছিস ?

-       হাঁ-

-       বাবুর তখন তিন বছর বয়স ইজের পরা শুরু করেছে মুরগী দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম বাবুকে বাঁচাতে গিয়ে ঠুকরে দিয়েছিল আমায়

শোরগোলটা বেড়ে গিয়েছে কাছেই , দুটি সারির মধ্যে দাঁড়িয়ে টাকমাথা ভদ্রলোক পিছন থেকে কেউ বলছে অনিমেষবাবু কম্বল শেষ হয়ে গেছে - বেশি কাঙালি চলে এসেছে এবছরএবার কি দেবেন ?

সামনেই দাঁড়িয়ে শাল জড়ানো অনিমেষ মুখুজ্জ্যে

সসব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায় জাহ্নবী একটি চোখে চালসে , অন্য চোখটি অধীর আগ্রহে চেয়ে থাকে আপন কৃষ্ঞাঙ্গ মুখের বলিরেখা ভেদ করে

-       ছেলেমেয়ে সব ভাল তো বাবু ? বৌমা ? বৌমা আসেনা বাবু

-       দেখিপরের বছর যদি আসে  

-       হাজার হোক মেম তো , গরমে কষ্ট হবে ওঁর তো তুমার মত টান নাই শিকড়ের

-       আয়া-মা , কম্বল শেষ হয়ে গেছেপ্রতি বছর তো দিইএবারেরটা বাড়িতে পাঠিয়ে দেব

-       তুমার আয়া-মা ডাক খুব মিষ্টি প্রতি বছর এই ডাকটার জন্যেই এই ফারমহাউজে আসি কত ছেলেমেয়েকে মানুষ করলাম , কে মনে রাখলে ? সবাই আসে না , সবাই রাখে না

-       তোমার কম্বলটা আলাদা করে যদি সরিয়ে রাখতাম !

-       কম্বল থাক আমার একটা আর্জ্জি আছে বাবু

-       বলো

-       আমিও তো মা আমারও তো ইচ্ছে হয় মোর ছেলের তরে এই বসন্ত বল্ না

বসন্ত ঝুঁকে প্রণাম করে কিন্তু মুখ দিয়ে কথা সরে না

-       বসন্ত আমার খুব লাজুক কিনা বড্ড সাদাসিধা ছেলে ওকে তুমি ছুইডেনে নিয়ে গিয়ে একটা কাজ দাও বাবু তোমার বাজারটাজার করে দেবে , ফাই ফরমাস খাটবে

-       কি করে ?

-        সেই যে মাধ্যমিকের সময় থেইকে মাছ ধরার নেশায় পাইলএখনো বর্ষার সময় জেলের সঙ্গে নৌকায় ওঠেমাছ ধরে , সামান্য কিছু পায়গরমের সময় কুয়ো খোঁড়ে-

-       সুইডেন বড্ড দূর , বরফ পড়ে মাস

-       তা হোক না হয় দূরেই গেলক্ষতিই বা কী বাবু তুমিও তো আছো বুকের ভিতর শিকড় থাকুক

-       অতদূর ছেলেকে ছেড়ে দেবে ?

-       ডালপালা যে আলোর দিকে যেতে চায় বাবু আমার বসন্তরে তুমি নিয়ে যাও ছুইডেনে  

-       ওকে কি নেবে ? ঢুকতে দেবে ?

-       ওদের কি কুয়ো খুঁড়তে লোক লাগে না বাবু ?

জাহ্নবী নিচু হয়ে ধরতে যায় অনিমেষ মুখুজ্জ্যের পা ত্বরিতে পিছিয়ে যেতে হয় তাঁকে কেমন অসহায় লাগে চারিদিকে আঁধার নামছে পিছনে খালি হয়ে আসছে জনতা   স্তিমিত হয়ে আসছে কোলাহল বাগানের ঝোপে এক দুটি জোনাকি , জ্বলে উঠছে আবার নিভে যা্চ্ছে বছরের মত ফার্মহাউসের স্মৃতি তুলে রেখে , কাল বাদে পরশু একা ফিরে যেতে হবে স্টকহোম জলস্থল পেরিয়ে , তিনি ছাড়া হয়ত আর কেউ আসবে না , কখনও আসবে না , বেদনাবিধুর এই বিশাল ফার্মহাউসে এই মাটি , হাস্নুহানা ফুল আর বিকেলের এই বাতাসের গন্ধে , তাঁকেই কেবল  জ্বলতে হবে , জ্বলতে জ্বলতে পুড়তে হবে একাকী একাকী  

লেখক পরিচিতি –

জন্ম  ১৯৭৪ পেশায় চিকিৎসক , এমডি , ডিএম  ( কার্ডিওলজিস্ট )  কবি , সমালোচক , রবীন্দ্র অনুরাগী শনিবারের চিঠির সম্পাদক সজনীকান্ত দাসের পৌত্র

ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে নবকল্লোল , শনিবারের চিঠি ( নবপর্যায় ) , সুদক্ষীণা , গল্পপত্র , কাথাসাহিত্য , শারদীয়া দক্ষীণীবার্তা , কবিতা গল্প বারোমাস , কালপত্রী , ইছামতি বিদ্যধরী,  অন্ধপক্ষ প্রভৃতি পত্রিকায় নানা লিটল ম্যাগাজিনে

গল্পগ্রন্থ : সৈকত শিল্পী , বনবিহঙ্গ  

উপন্যাস:  সমান্তরাল