পুলিশ!আমাদের বাড়ির সদর দরজায় পুলিশ। শেষে ঠিক খুঁজে বার করে নিল আমায় পুলিশ। এই সেই কালপ্রিট যে এতদিন ধরে লুকিয়ে চুরিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আজ থেকে লুকোচুরির খেলা শেষ।
আমি
স্বচক্ষে যেন দেখতে পাচ্ছি, পুলিশ আমায় হ্যান্ডকাফ পরিয়ে
পাড়ার মাঝখান দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একজন মর্য্যাদা সম্পন্ন লোককে বেইজ্জত করতে করতে।
পাড়ার পঞ্চাশ জোড়া চোখ আমার উপর নিবন্ধ। ভয়ে শরীরের সমস্ত রক্ত হিম বরফ হয়ে গেল।
আমি ধপাস করে ব্যালকনিতে রাখা চেয়ারে বসে পড়লাম। সেদিনকার ঘটনার ফ্ল্যাশব্যাক আমার
চোখের সামনে। সন্ধের সময় নতুন ম্যাটিজ গাড়ী
নিয়ে ফরিদাবাদ থেকে দিল্লী যাচ্ছি। যাব নেহরুপ্লেসে। ন্যাশনাল হাইওয়েতে পড়ার মুখেই
আমায় গাড়ী থামাতে হল। একদল ফ্যাক্টারী ওয়ারকার্স রাস্তা পার হচ্ছে। ওরা কোনও কালেই
দেখি নিয়মটিয়ম মানে না। শর্টকাট হয় বলে মাঝ পথেই রাস্তা ক্রস করে মাঠের মধ্যে দিয়ে
চলে যায়। ব্রেক চেপে বসে আছি। লোকগুলি চলে যাওয়ার পর যেই না গিয়ার বদলে গাড়ীতে
স্পিড তুলেছি হঠাৎ কোথা থেকে এক দেহাতী লোকের আবির্ভাব হল। দেখতে না দেখতেই লোকটা ঝপাং
করে আমার গাড়ীর বোনেটের ওপর এসে পড়েই ঝাঁকুনি খেয়ে উল্কার বেগে মাঝের লেনে গিয়ে
পড়ল। ওর মাথার ধাক্কায় গাড়ীর উইন্ডস্ক্রীনের কাঁচ ভেঙ্গে চুরমার। আমার গাড়ী তখন
প্রথম লেনে ছিল। পেছনে তখন দ্রুত বেগে ধেয়ে আসা ট্র্যাফিক। পিছনে ফিরে আর তাকানো
নয়। লোকটা মরল না বাঁচল সেইটুকুও ভাববার তখন সময় নেই। দুরন্ত বেগে ছুটছি। থামলেই
যে ধরা পড়ে যাব। সোজা গিয়ে দিদির বাড়ি উঠলাম। দিল্লী আর যাওয়া হল না। আমার রক্তহীন
ফ্যাকাশে মুখ দেখে দিদি আতঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে? আমি এক
নিঃশ্বাসে দুর্ঘটনার কথাটা বললাম। গাড়ীটা ধুয়ে মুছে, রক্তের
দাগ তুলে ফেলে বেসমেন্টে লুকিয়ে রাখলাম সপ্তাহখানেক। ঘটনার পরের দিনই লোকাল নিউজের
পাতায় তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি যদি কোনও লোকের গাড়ী চাপা পড়ে মারা যাওয়ার খবর থাকে।
না,সেরকম
কোনও খবরই পাইনি। দিদি ছাড়া বাড়ির কারোকেই বলিনি দুর্ঘটনার কথা। বাড়িতে বলেছিলাম
--গাড়ী গ্যারেজে দিয়েছি। সেইদিন থেকে গাড়ী চালানো প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। সেদিন ধরা
পড়লেই,হয় পুলিশের হাজতে না হয় পাবলিকের হাতে খেতে হোত
গণধোলাই।
চুপচাপ
একাকী বসে থাকলেই দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। লোকটা যেভাবে আমার গাড়ীর ওপর
ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার বেঁচে থাকার কথা নয়। আমার কী দোষ। লোকটা যেন সুইসাইডের বাসনা
নিয়েই ইচ্ছাকৃত ভাবে ঝাঁপ দিয়েছিল। "কিন্তু তাকে হসপিটালে নিয়ে গিয়ে মেডিকেল
এইড তো দেওয়া যেতে পারতো।" কিন্তু তার আগেই পাবলিকের হাতে আমার ভালরকম ধোলাই
হয়ে যেত। মনের কোর্টে বাদী-প্রতিবাদীর উকিলদ্বয়ের চাপান-উতোর চলতে থাকে ক্রমাগত।
সর্বক্ষণই একটা ভয় রক্তের মধ্যে খেলা করে। কেউ যদি আমার গাড়ীর নাম্বারটা টুকে রেখে থাকে তাহলে
নিশ্চয় একদিন না একদিন ধরা পড়ে যাব। আজ সেই দিন। পুলিশ খুঁজতে খুঁজতে ঠিক আমার বাড়ির
ঠিকানায় এসে পৌঁছেছে। এতক্ষণে নিশ্চই বাড়ীর সবাই জেনে গেছে যে
আমার গাড়ীতে একটা লোক চাপা পড়ে মারা গেছে।
'কাকু, কাকু একটু
নিচে আসবে।'
ভাইপোর
ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম। কম্পিত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেখি সিঁড়ির গোড়ায়
অরূপ দাঁড়িয়ে। ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করলাম 'কী হয়েছে? পুলিশ
আমায় কেন খোঁজ করছে?'
অরূপ অবাক হওয়া গলায় বলে তোমাকে কেন? আমার O.N.G.C-তে চাকরী হয়েছে তাই পুলিশ ভেরীফিকেশনে এসেছে।
সমাপ্ত
লেখিকার পরিচিতিঃ
যদিও জন্ম পলাশীপাড়া, নদিয়া জেলা, পশ্চিমবঙ্গ, কিন্তু তাঁর শৈশব, বেড়ে ওঠা, শিক্ষা-দীক্ষা সব এলাহাবাদেই। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থশাস্ত্রে এম.এ.। ১৯৮১ সালে এলাহাবাদ থেকে একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা "তূণীর" প্রকাশ করতেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় (দেশে ও বিদেশে) লেখা প্রকাশিত হয়। হিন্দী ও ইংরাজিতেও লেখা প্রকাশিত হয়েছে। পানামার কবি, রোখেলিও সিনান এর দশটি স্প্যানিশ কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেছেন। 'অনুশীলন পত্রিকা'সুইডেন থেকে রাইটার্স অ্যাওয়ার্ড ২০১৩ সালে পেয়েছেন। ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছে "ঈশ্বর ও মানুষ" ( অণু গল্প ও ছোট গল্প সংকলন)। লেখিকার অভিজ্ঞতাজাত কোভিড সংক্রান্ত বই "কোভিড-১৯ আমার জীবন আমার লড়াই" গাঙচিল থেকে প্রকাশিত হয়েছে, ডিসেম্বর ২০২২ সালে।