কলকাতার সদা ব্যস্ত বউবাজার স্ট্রিটে বাড়ি নং ২১০।
সেখানে তখন ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কালটিভেশন অফ সায়েন্স’-এর প্রধান
কার্যালয় ছিল। চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমণ এই
পরীক্ষাগারগুলির একটিতে ১৯২৭ সালের ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় তাঁর কিছু যন্ত্রের
প্রয়োগ দেখাচ্ছিলেন। সে সময় কে এস কৃষ্ণান নামে এক যুবক উত্তেজিত হয়ে এসে
সবাইকে জানান যে প্রফেসর কম্পটন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। রমণ এই খবরে আনন্দিত
হয়ে বললেন,"যদি এই কম্পটন প্রভাব (Compton effect)রঞ্জনরশ্মির
ক্ষেত্রে সঠিক হয়,তাহলে আলোর ক্ষেত্রেও হবে।"
কয়েকবছর আগে এ,এইচ,কম্পটন
পরীক্ষা করে দেখেন যে রঞ্জনরশ্মি,যখন কোনও বস্তুর মধ্যে দিয়ে
যায়,তখন তার কিছু স্বভাবগত পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তন নির্ভর
করে সেই বস্তুর মৌলিক গুণের উপর। ঐ প্রভাবকে "কম্পটন প্রভাব" বলা হয়।
রমণের মনে প্রশ্ন জাগলো,স্বচ্ছ বস্তুর মধ্যে দিয়ে যখন আলো
যায়,তখন আলোরও কি এমন পরিবর্তন হয়? সুদীর্ঘ
পাঁচ বছর ধরে আলোক বিদ্যার (optics) উপরে তিনি গবেষণা চালিয়ে
যাচ্ছিলেন। তাঁর উচ্চমানের কোনও যন্ত্র ছিল না। তথাপি তিনি দৃঢ় নিশ্চিত ছিলেন যে,এই যন্ত্রপাতির কিছু উন্নতি করেই তিনি এই প্রশ্নের সমাধান বার করতে
পারবেন।
১৯২৮ সালের ১৬ ই মার্চ বাঙ্গলোরের এক বৈজ্ঞানিক সভায় রমণ
তাঁর নূতন বিকিরণের আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করলেন। তাঁর এই আবিষ্কারকেই পৃথিবী
"রমণ প্রভাব" (Raman Effect) বলে উচ্চ স্বীকৃতি দিলো। মাত্র দু'শো টাকা দামের অতি সাধারণ যন্ত্র দিয়ে,রমণ এমন একটা
আবিষ্কার করলেন যা তাঁকে ১৯৩০ সালে পদার্থ বিদ্যায় নোবেল প্রাইজ এনে দেয়। আমাদের
দেশের বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে এই দিনটি চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
১৮৮৮ খৃষ্টাব্দের ৭ ই নভেম্বর তামিলনাড়ুর
তিরুচিরাপল্লীতে রমণের জন্য হয়। তাঁর বাবা একটি কলেজে পদার্থ বিদ্যার অধ্যাপক
ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই রমণ অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। ম্যাট্রিক পাশ করার পর বাবা মা
তাঁকে বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাঠাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু একজন
ইংরাজ চিকিৎসকের পরামর্শে তাঁরা রমণকে বিদেশে না পাঠিয়ে মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি
কলেজে M.A ক্লাসে ভর্তি করে দিলেন।
ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞান তাঁকে আকর্ষণ করতো, এবং তিনি
বিভিন্ন নাম করা বৈজ্ঞানিক পত্রিকায় গবেষণামূলক রচনা লিখতে শুরু করেন। মাত্র ১৯
বছর বয়সে তিনি "ইন্ডিয়ান এ্যাসোসিয়েশন ফর কালটিভেশন অফ সাইন্সের" সদস্য
হন। ইতিমধ্যে বাবা মার ইচ্ছানুসারে তিনি কলকাতায় অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি প্রশাসনিক
চাকরি গ্রহণ করেন। কিন্তু বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ বিন্দুমাত্র কমলো না। এই
সময়ে তিনি দপ্তর থেকে ফিরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমনকি কখনও সারা রাত গবেষণাগারে কাজ
করতেন।
যৌবনে রমণের ধ্বনিবিজ্ঞানের প্রতি খুব আকর্ষণ ছিল। তিনি বেহালার
মত ছড়ওয়ালা এবং সেতারের মত তার যন্ত্র থেকে কি করে সুসমঞ্জস সংগীত সৃষ্টি হয়, সে বিষয়ে অনেক
পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিলেন। তিনি এ বিষয়ে এত গভীর ভাবে একাতন হয়েছিলেন যে,১৯২১ সালে লন্ডনে বিজ্ঞানের ওপরে একটি বক্তৃতা দেবার পর, শ্রোতাদের মধ্য থেকে এক বৈজ্ঞানিক কৌতুক করে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, যে তিনি কি বেহালা বাজিয়ে "রয়্যাল সোসাইটির" সদস্য হতে চান?
বিলেত থেকে ফেরার পথে জাহাজের ডেকে বসে নীল আকাশ ও নীল
সমুদ্র দেখতে দেখতে তাঁর মনে প্রশ্ন জাগলো এই আকাশ ও সমুদ্র নীল কেন? এই নিয়ে চিন্তা
করতে করতে তাঁর ধারণা হ'লো, আলোর
বিচ্ছুরণের ফলে, নিশ্চয় রঙ দেখা যায়। কিন্তু তাঁর এই ধারণা
তো পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণিত। কলকাতায় ফিরে তিনি বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে,
তাঁর এই উৎপত্তির ওপর গবেষণা শুরু করে দিলেন। এই তাঁর আলোকবিদ্যার
ওপর গবেষণার শুরু এবং এর থেকেই তিনি পরে বিশ্ববিখ্যাত হন। ১৯২৪ সালে রমণ
আলোকবিদ্যায় তাঁর বিশেষ অবদানের জন্য "রয়্যাল সোসাইটির" সদস্য নির্বাচিত
হন। এর ছয় বছর পরে তিনি নোবেল প্রাইজ পেয়ে বিশ্বজোড়া খ্যাতি পান।
১৯৪৩ সালে বাঙ্গালোরের কাছে রমণ গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনা
করেন। সুন্দর বাগানের মধ্যে প্রাসাদোপম এই বাড়ীতে ২০ শে নভেম্বর ১৯৭০ সালে মৃত্যু
পর্যন্ত তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান। রমণ কোনোদিনই "ধুনি বিজ্ঞানে"
উৎসাহ হারান নি। মৃদংগম ও তবলায় সুসমঞ্জস (harmonic) ধ্বনি সাদৃশ্য আছে এবং এ
বিষয়ে এ'দুটি যন্ত্র অন্যান্য ঢোলক জাতীয় যন্ত্র থেকে পৃথক,
এটি তাঁর একটি গুরুত্ব পূর্ণ আবিষ্কার।
পরবর্তী জীবনে প্রজাপতি, ফুল থেকে নিয়ে
মণিমাণিক্য পর্যন্ত যে কোনও রঙচঙে জিনিসে তিনি আকৃষ্ট হতেন। তিনি ভাবতেন, এই জিনিসটা সুন্দর, অথবা রঙিন লাগে কেন? অর্থাৎ তাঁর মন সবসময়ে প্রশ্নে ভরা থাকতো এবং তিনি এসমস্ত প্রশ্নের উত্তর
খুঁজতেন। যুবকদের তিনি গবেষণাগারের মধ্যে বদ্ধ না থেকে চারপাশের জগতে নজর রাখতে
বলতেন। তিনি বলতেন, "বিজ্ঞা- নের সার হ'লো, মৌলিক চিন্তা ও কঠিন পরিশ্রম। যন্ত্রপাতির স্থান
অনেক পরে।"
কঠিন, তরল অথবা বায়বীয় স্বচ্ছ বস্তুর মধ্যে
দিয়ে আলো যায় তখন সেই আলোর মধ্যে কিছু প্রকৃতিগত পরিবর্তন দেখা যায়। একেই
"রমণ এফেক্ট” (Raman Effect) বলে। প্রকৃতপক্ষে স্ট্রাইকার
যেমন ক্যারাম বোর্ডের খুঁটি গুলিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়, সেই
রকম মাধ্যমের পরমাণুগুলি আলোক কণা (photons) গুলি কে ছড়িয়ে
ছিটিয়ে দেয়, ফোটনের শক্তির সূক্ষয় পরিবর্তন থেকে মাধ্যমের
ভিতরের আণবিক গঠনসম্পর্কে অনুমান করা সম্ভব। "রমণ এফেক্ট" রাসায়নিক
যৌগের আণবিক গঠন বুঝতে সাহায্য করে। রমণ এফেক্ট আবিষ্কারের এক দশকের মধ্যেই প্রায়
দু'হাজার রাসায়নিক যৌগের অভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে নির্ভুল
সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়েছে। পরে স্ফটিকের (crystals) অভ্যন্তরীণ
গঠনও এই ভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। সেকালের আবিষ্কারের পরে 'রমণ
এফেক্ট' বৈজ্ঞানিকদের কাছে একটি শক্তিশালী উপকরণে পরিণত
হয়েছে।