Advt

Advt

bangsha-pradip-story-galpo-by-nityaranjan-debnath-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-বংশ-প্রদীপ-গল্প-নিত্যরঞ্জন-দেবনাথ


 

শ্রাদ্ধ পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম মিটে যাওয়ার পর বাড়িটা একদম ফাঁকা। এক ডজন কাজের লোক ছাড়া নিজের বলতে কেউ নেই।

বর্ধমান শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে  দেড় বিঘে জায়গার উপর বিশাল এই বাড়িটাকে এখন অদিতিকেই সামলাতে হয়। ভাললাগা মন্দলাগা একরকম অভ্যাসে  দাঁড়িয়ে গিয়েছে। শুধু তো বাড়ি নয়, ব্যবসা, জমি জায়গা বিষয়-সম্পত্তি -- সবই এখন অদিতির কথায় চলে। পরামর্শদাতা থাকলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি তিনিই দেন। ঝুঁকি হলেও আলাদা এক আনন্দও উপভোগ করেন। তবে আজ বড় একাকীত্ব বোধ করছেন তিনি। দু'দিন আগেও বাড়ি ভর্তি আত্মীয় স্বজনে গমগম করছিল। একে একে সবাই ফিরে গেল নিজের বাড়িতে। আজকাল দরকার ছাড়া কে আর বেশিদিন থাকে ! অদিতির একমাত্র পুত্র দীপঙ্করও একটু আগে স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। ওরা দিল্লিতে সেটলড। সন্ধে সাড়ে ছটায় নাকি  ফ্লাইট। অদিতি দোতলার শোয়ার ঘরের গ্রিল বারান্দায় বেতের চেয়ারটায় এক কাপ চা নিয়ে বসলেন। মন কেমন বিক্ষিপ্ত। মৃত্যুশয্যায় স্বামীর কথাটা মনে পড়লেই পিন ফোঁটার মত খচ খচ করছে। কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছেন না। এই কটা দিন লোকজনের হট্টগোলে  মনের গভীরে যেন থিতু হয়ে বসে ছিল।  একা হতেই চাগাড় দিয়ে উঠেছে।

ফাল্গুন মাসের সবে শুরুনা ঠান্ডা না গরম আবহাওয়া। পশ্চিমে সূর্যদেব আম গাছের ফাঁক দিয়ে বিদায় নেবার তোড়জোড়  করলেও সন্ধে হতে এখনো কিছুটা বাকি। পরিষ্কার আকাশ। বেশ  ফুরফুরে হওয়া বইছে।  আরামদায়ক হলেও অদিতি শান্তি পাচ্ছেন না কিছুতেই। জীবনের তিন কাল কেটে শেষ পর্বে এসে একী বিড়ম্বনায় পড়লেন তিনি ! কত কাল আগের ঘটনা, কেন যে আজ এত জ্বালাচ্ছে !

অনল রায়চৌধুরী। বনেদি পরিবারের সন্তান। বাপ-ঠাকুরদা এককালে  বিশাল জমিদার ছিলেন। এছাড়া বর্ধমান শহরে একাধিক ব্যবসা রমরমা চলতো। সেই পরিবারের একমাত্র সন্তান অনলের বউ হয়ে এল অদিতি। সেকি আজকের কথা ! দেখতে দেখতে পঁয়তাল্লিশটি বছর পেরিয়ে গেল। জমিদার বংশ। তার একটা অহংকার তো ছিলই। আদ্যিকালের ধ্যান ধারণা অদিতির না-পসন্দ হলেও সাধ্যমত মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। অবশ্য অনল সর্বদা পাশে থেকেছে বলেই সহজ হয়েছে। অনল তখন সদ্য বর্ধমান ইউনিভার্সিটি থেকে এম এ পাশ করেছে। পাঁচ রকম বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে মিশে মন একেবারে আধুনিক। মিথ্যে বলবে না, অনল তাকে পাগলের মত ভালোবাসত। অদিতিও সেই বছরেই ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে বি এ পাশ করেছে।  অনল এম এ তে ভর্তি হতে বলেছিল। হয়নি বাড়ির অন্যান্য মেম্বারদের মুখের অভিব্যক্তি দেখে। ঘরের শান্তির অগ্রাধিকার বেশি

বেশ চলছিল দাম্পত্য জীবন। শ্বশুর,শাশুড়ি, কাকা, কাকিমা সকলেই যথেষ্ট স্নেহ করতেন। বছর তিনেক  তো উড়ে উড়েই কাটল। অনল বেড়াতে ভালোবাসে। দেশের এহেন জায়গা নেই যে তারা যায়নি। তবে একটা ব্যাপার নিয়ে চাপা কানাঘুষা যে চলছে কিছুদিন ধরেই টের পাচ্ছিল। কিছুতেই বুঝতে পারছিল না। তাকে দেখলেই বাড়ির সকলে মুখে কুলুপ আটতো। অনলকে বলল একদিন। পাত্তা না দিয়ে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল। ছাড়ো তো সব আজগুবি কথা।  ব্যাপারটা যে যথেষ্ট গুরুতর সেটা পরিষ্কার এবং তাকে নিয়েই ঘটনা এটাও স্পষ্ট। না হলে তার উপস্থিতিতে সবাই বোবা হয়ে  যায় কেন? দূর সম্পর্কের এক বিধবা পিসি থাকতেন তাদের বাড়িতে। বিয়ে হয়ে আসার পর থেকেই তাকে দেখছে অদিতি। অদিতির অনেক কাজকর্মও তিনি করে দিতেন। তবে কাজের লোক বলে কেউ ভাবতেন না। আদিতিকে খুব ভালোবাসতেন। পীড়াপীড়ি করতে তিনিই একদিন আসল সত্যিটা প্রকাশ করলেন। বুকটা ধড়াস করে উঠল। একী অলুক্ষণে কথা ! সেই রাত্রেই অনলকে চেপে ধরল," তুমি তলায় তলায় এসব করে বেড়াচ্ছ? এদিকে মুখে ভালোবাসার অভিনয়? মেয়েও নাকি দেখা হয়ে গেছে? একটা বউ থাকতে আবার তুমি বিয়ে করবে?"

অনল বিছানায় শুয়ে কোলবালিশ আঁকড়ে  মুচকি হেসে বলল," আমার ঠাকুরদা দুই বিয়ে করেছিলেন। প্রপিতামহের নাকি তিন স্ত্রী ছিল।  আমার বাবা অবশ্য ওঁদের পথ অবলম্বন করেন নি।  আমি যদি করি মন্দ কি?"

সেই রাত যে কিভাবে কেটেছে একমাত্র অন্তর্যামী জানে। শুনে অদিতির সেকি ফোঁপানির কান্না। সারারাতই বলতে গেলে চোখের পাতা এক করতে পারেনি। বউ হয়ে এসে মনের গভীরে কত স্বপ্ন। সবই কী আশার ছলনা !  অনল বার বার বোঝাচ্ছে, সে ঠাট্টা করেছে। তবু যেন মনের সন্দেহ দূর হচ্ছে না।

দিন যায় মাস যায় অদিতির শঙ্কা কিছুতেই কাটছে না। বার বার মনে হতো বাড়ির মানুষগুলো তার সঙ্গে প্রাণ খোলা কথা বলছে না। নিজেরা কী বিষয় নিয়ে কথা বলছে পরিষ্কার নয়। সে উপস্থিত হলেই যেন অন্য প্রসঙ্গ চলে আসে। এভাবে কী বাঁচা যায় ! অনলকে বলেও লাভ নেই। কোনও হেলদোলই নেই।

এরমধ্যেই এল সেই দিনটি। অদিতির কাছে এক স্মরণীয় রাত। দার্জিলিং বেড়াতে গিয়েছিল ওরা তিন জন। অনল, অরিন্দম ও অদিতি। অরিন্দম অনলের বেস্ট ফ্রেন্ড। যেমন ব্রিলিয়েন্ট তেমনি স্মার্ট। এম.এস সি, পি.এইচ ডি করে আমেরিকা পাড়ি দেয়। এখন অবশ্য ওখানকারই স্থায়ী বাসিন্দা। সেবার দার্জিলিংয়ে ভীষণ ঠান্ডা পড়েছে। শুন্য ডিগ্রিরও নীচে। এমনিতেই অনল মদ্য পানে আসক্ত। কনকনে ঠান্ডায় এতটাই খেয়েছে একেবারে বেহুঁশ। সেই রাতেই যা ঘটে গেছে তা নিছক দুর্ঘটনা,না ইচ্ছাকৃত তা আর মনে রাখতে চায় না অদিতি।

দু'মাস যেতে না যেতেই বাড়ির পরিবেশ আমূল বদলে গেল। অদিতি মা হতে চলেছে। ইউরিনের টেস্ট রিপোর্ট নিয়ে অনল যেদিন বাড়ি ঢুকল, যেন আনন্দে আত্মহারা। বাচ্চা ছেলের মত নাচতে শুরু করেছিল। বাড়ির মানুষগুলোও ঠিক ততটাই। রাতারাতি অদিতির কদর আদর বেড়ে গেল কয়েক গুণ। তাকে কোনও কাজই করতে দেওয়া হয় না। প্রতি মাসে বাড়িতে ডাক্তার আসছে  চেকআপ করতে। নিয়ম করে পথ্য, সাবধানে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন মা, কাকিমা এমনকি বাবা কাকাও। কাকিমাও নিঃসন্তান। শুনেছে কাকাকে পুনরায় বিয়ে দেয়ার জন্য বাড়ি সুদ্ধু উঠেপড়ে লেগেছিল। কাকাই জেদ ধরে বসে ছিলেন। কাকিমাকে এতটাই ভালো বাসতেন যে দ্বিতীয় স্ত্রী কল্পনাই করতে পারেন না। পরবর্তী সময়ে অনলের ক্ষেত্রেও তা দেখেছে।  একটাই চিন্তা তাঁদের, বংশধর না থাকলে কে এই বিশাল সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ  করবে?

দেখতে দেখতে অদিতি ফুটফুটে এক হৃষ্টপুষ্ট পুত্রের জন্ম দিল। খুশির জোয়ারে ভাসছে পুরো পরিবার। সুদিন যে ফিরে গেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্নপ্রাশনে বিশাল আয়োজন। পাঁচ হাজারের উপর আমন্ত্রিত। সেসব দিন যা গেছে সহজে ভোলার নয়। ছেলেও অত্যন্ত মেধাবী। স্কুল কলেজে প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়নি কোনোদিন। খড়গপুর আই আই টি থেকে বি টেক করে পরে এম টেক, পি এইচ ডি করে দিল্লির আই আই টি কলেজে লেকচারারের চাকরি নিয়ে চলে গেল। বাপ-ঠাকুরদা যে আশায় সন্তান চেয়েছিলেন সেই বিষয় সম্পত্তি দেখার কোনও আগ্রহই নেই তার। এবার কি ভাবে সামলাবে অদিতি?  অনল যতদিন ছিল কোনও চিন্তা ছিল না। বছর খানেক হল হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। এক সময় সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী। ডাক্তার বললেন, দুরারোগ্য ব্যাধি। ক্যানসার। ততদিনে অদিতি ব্যবসা, সম্পত্তি অনেকটা বুঝে নিতে পেরেছে।  যতদিন অদিতি বাঁচবে হয়তো সামাল দিতে পারবে। কিন্তু তারপর?

অনল যেদিন মারা যায় সেদিন ছিল ঝড় জলের রাত। বাইরে মুষলধারে  বৃষ্টি সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া। রাত ঠিক সাড়ে তিনটে। আদিতিই একমাত্র পাশে ছিল। বোধহয় আধ ঘন্টা আগের ঘটনা। ঘড়িতে সম্ভব তিনটে বাজে। হঠাৎ অনল অদিতির হাতটা চেপে ধরল। এতটা শক্তি কী করে পেল আজও ভেবে পায় না।

অনল বলল," দিতি আমার একটা কথা রাখবে? কথা দিতে হবে।"

অদিতি বলল," কেন রাখবো না? তোমার কোন কথাটা রাখিনা শুনি? বলো তুমি।"

তারপর অনল কেটে কেটে যা বলল, ভাবলেই এখনো গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।

অনল বলল," দীপ যে আমার সন্তান নয় এই কথাটা ছেলেকে বলো না কোনও দিন। এমন কি আরিন্দমকেও বলবে না। আমাকে কথা দাও দিতি। ছেলে যেমন জানে আমি তার বাবা সেটাই যেন চিরকাল জেনে যায়।"

" কি বলছ তুমি? দীপ তো তোমারই ছেলে। কী আজে বাজে কথা বলছ?"

"আমি জানি দিতি, তখন ভিন্ন ভিন্ন তিনজন ডাক্তারকে দেখিয়েছিলাম। সবাই পরীক্ষা করে এক কথাই বলেছে। আমি কোনোদিন সন্তানের পিতা হতে পারবো না। তুমি কথা দাও দিতি আসল সত্যিটা প্রকাশ করবে না কোনোদিন।"

অদিতি তখন থরথর করে কাঁপছে। অসুস্থ মানুষটার বুকের উপর মাথা রেখে হাউমাউ করে কাঁদছিল শুধু। মুখে কোনো কথা বলতে পারেনি। বাইরে অবিরাম জলের ধারা সমানে পড়েই চলেছে।

 লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

লেখক পরিচিতি -

নিত্যরঞ্জন দেবনাথ পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়ার পানুহাটে ১৯৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন।কাটোয়া কলেজ থেকে বাণিজ্যে স্নাতক। বর্তমানে থাকেন হুগলির চুঁচুড়ায়। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী ছিলেন।অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল-এর অধীন ডিভিশনাল অ্যাকাউন্টস অফিসার পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম গল্প " চেতনা " ছোটদের পত্রিকা শুকতারায় ১৯৯৬ - এর এপ্রিলে প্রকাশিত হয়। এরপর দেশশিলাদিত্যকালি ও কলম,মাতৃশক্তিতথ্যকেন্দ্রকলেজস্ট্রিটকথাসাহিত্যদৈনিক স্টেটসম্যানযুগশঙ্খএকদিন,,সুখবর ইত্যাদি এবং বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে নিয়মিত তাঁর সাহিত্যকীর্তি অব্যাহত। ইতিমধ্যে পাঁচটি গল্প সংকলন ও চারটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক "শতানীক " পত্রিকাটি দীর্ঘদিন ধরে সম্পাদনা করে আসছেন।