দাদুর
কাছে শুনেছি বাবাকে নাকি বুদ্ধিটা দিয়েছিলেন নিশিকান্ত কাকা। বাবার বন্ধু।
ক্লাসমেট। বড় কারবারি। ব্যবসায়িক বুদ্ধি তুখোড়। অথচ পড়াশুনায় আগ্রহ কম। কিন্তু
ব্যবসাটা বুঝতেন ভাল। তিন-চারটে ব্যবসা রমরম করে
চলত। বাবাও একই পথের পথিক। পড়ালেখায় মন নেই। এইজন্যই বোধহয় বন্ধুত্বটা
নিবিড় হয়েছিল। দু'জনে হরিহর আত্মা। পরীক্ষাগুলোতে কোনও রকম উৎরে গেছে মাত্র। টায়ে
টায়ে পাশ কোর্সে বি.এ পাশ করে বসে আছে। কিন্তু বাবার তো নিশিকান্ত কাকুর মতো
পৈত্রিক ব্যবসা নেই। যা রেজাল্ট, চাকরি হওয়াও কঠিন। কারণ চাকরির বাজার সবসময়েই
আকাল। কয়েক বছর আদাজল খেয়ে চেষ্টা করেও চাকরি জোটাতে পারলেন না।। এখন কি করবেন?
দাদু সরকারি চাকরি করতেন। রিটায়ারমেন্টের পর সংসারে টানাটানি শুরু হল। পেনশনের
টাকায় কোনোরকমে চলছে। অবসরকালীন থোক যে টাকা পেয়েছিলেন সেটা দাদু ভাঙতে চাইছেন না
কিছুতেই। সুপ্ত ইচ্ছে বাড়িটা দোতলা করবেন।
আমাদের
বাড়িটা কলকাতা থেকে পঁচিশ-ছাব্বিশ কিলোমিটার দূরত্বে এক মফঃস্বল শহরে। এক বিঘে
জায়গার ওপর এক কোণে একতলা বাড়ি। বাড়ির সম্মুখে কুড়ি ফুট চওড়া রাস্তা। নিশিকান্ত
কাকু বাবাকে বললেন, "বাড়ির সম্মুখে একটি মন্দির কর। মন্দিরে কালীঠাকুর ও বড়
এক শিবলিঙ্গ থাকবে। আর কিছুর দরকার নেই।" বাবা বললেন," মন্দির করে আমার
কি হবে? অযথা অর্থ খরচ করে লাভ কি?"
নিশিকান্ত
কাকু বললেন, " ওই মন্দির থেকেই তোদের সংসার চলে যাবে। ভক্তরাই অন্ন
যোগাবে।" এর গূঢ় অর্থ বোধগম্য হতে বাবার একটু সময় লেগেছিল। তবে দাদুর
দূরদর্শিতা প্রখর। তিনি শুনেই বেশি ভাবেন নি। সঞ্চিত অর্থ বাবার হাতে তুলে
দিয়েছিলেন।
মিরাকল!
তিন বছরের মধ্যে বাড়ির চেহারা বদলে গেল। চাকরি করে একজন কত আয় করে? কল্পনাতীত। কম
করে পাঁচজন চাকরিজীবীর রোজগার ওই মন্দির থেকে আসতে লাগল। ভাবা যায়!
এসব
কথা বলছি, আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের ঘটনা। আমার তখন জন্মই হয় নি। থুড়ি! বাবার
তখনও বিয়েই হয় নি। আমি হবো কি করে? সবটাই দাদু-ঠাকমার কাছে শোনা। এসব অবতারণার
একটাই কারণ, বাবার কাহিনীটা শোনাবো বলে।
আমার
বাবা শ্রীযুক্ত অমরনাথ বন্দোপাধ্যায়। ধর্মকর্ম ঠাকুর দেবতার প্রতি এতটুকু বিশ্বাস
ছিল না। পড়াশুনার কথা তো আগেই বলেছি। পড়ার থেকে আড্ডা দিতেন বেশি। বন্ধুর পরামর্শে
মন্দির করেন। পূজার জন্য একজন পুরোহিতকে মাসোহারা দিয়ে রাখা হয়। কয়েক মাসের মধ্যেই
হঠাৎ মানসিক পরিবর্তন। বাবা রাত জেগে গীতা, পুরোহিত দর্পন ইত্যাদি নানা ধর্মগ্রন্থ
পড়া শুরু করেন। এক অভিজ্ঞ শিক্ষিত পুরোহিতের কাছে ছ'মাস ধরে নিয়মিত পাঠ নেন। তারপর
নিজেও পুজো করতে লেগে গেলেন। একজনতো
মাসোহারা ভাবে আছে। দুজনে মিলে মন্দিরের পুজো সামলান। তখন থেকে বাবার কি
হল, মুখে ঠাকুর দেবতা ছাড়া অন্য কোনও কথাই নেই। কথায় কথায় নানা শ্লোক আওড়ান। গীতার
উদাহরণ দিয়ে মানুষকে বোঝান। দাদু-ঠাকুমা মতিগতি দেখে আশ্চর্য হলেও মনে মনে খুশিই
হন। এবার ছেলেকে বিয়ে দেবার ভাবনা চলছে। ততদিনে
মন্দির তিন বছর হয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যে দাদু বাড়িটাকে একতলা থেকে দোতলা করে
ফেলেছেন। মন্দিরের জন্যও দুটি লম্বা বড় ঘর করেছেন। দূর দূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন
নানা মানসিক মানত-এর পুজো দিতে। রাতটা থাকার মতো ব্যবস্থা করা আরকি। তখন চারজন
পুরোহিত নিয়মিত মাসোহারা ভাবে আছেন। এছাড়া প্রধান পুরোহিত হিসেবে বাবা তো রয়েছেনই।
বাবা প্রথমে বিয়ে করতে রাজি হননি। ঠাকুর সেবায় নাকি ব্যাঘাত হবে। এনিয়েও নাকি অশান্তি
কম হয় নি। কয়েক মাস বোঝানোর পর রাজি হয় একটি শর্তে। মেয়েকে ধার্মিক হতে হবে।
আধুনিক মডার্ন মেয়ে হলে চলবে না।
( দুই )
আমার
মা ধার্মিক শুধু নয় বুদ্ধিমতীও। বাবাকে চালনা করেন মা-ই। যত দিন যাচ্ছে বাবা মন্দির
, ঠাকুর, জাগযজ্ঞ, ইত্যাদি ছাড়া মাথায় অন্য কিছু নেই। বাকিটা মা-ই সামাল দেন। মা
না থাকলে বাবার যে কত অসুবিধা হতো আমি বুঝি। আমার পড়াশুনার দিকটাও মা দেখেন। যখন
কলেজে ভর্তি হবো তখন শুধু বাবা বলেছিলেন, আমার ইচ্ছে তুই সংস্কৃতে অনার্স নিয়ে পড়।
যেহেতু বাবার ইচ্ছে তাই মায়েরও আদেশ, বাবার কথাই অনুসরণ করতে হবে। আমারও প্রিয়
সাবজেক্ট বলে আপত্তি করিনি। এরপর সংস্কৃতে এম.এ করে এম.ফিল করি। এখন একটি কলেজে
লেকচারার। পুরোহিত হওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। অবশ্য বাবা-মা কখনো জোর করেন নি। তবে
ঠাকুমার একটা কথা খুব মনে পড়ে। এখন অবশ্য ঠাকুমা নেই। আমি যখন এম.এ তে ভর্তি হই
তখন ঠাকুমা মারা যান। তিনি বলেছিলেন, নিজের ইচ্ছায় সব কিছু হয় নারে দাদুভাই ।
উপরওয়ালা একজন থাকেন। তিনিই স্থির করে দেন। এই দেখনা, তোর বাবা কি কোনওদিন পুরোহিত
হতে চেয়েছিল? শেষে বাধ্য হয়ে হল কিছু রোজগারের আশায়। কিন্তু এখন দেখ, রোজগারের
চিন্তা মাথায় নেই, একমাত্র ধ্যানজ্ঞান মন দিয়ে পূজা করা। রাত জেগে এখন কত পড়াশুনা
করে দেখেছিস? স্কুল-কলেজের পড়ার সময় এর সিকিভাগ যদি পড়ত কত ভাল রেজাল্ট করতে পারত।
চাকরিও পেয়ে যেত। তবে ঠাকুর ওকে দু'হাত
ভরে ঢেলে দিচ্ছে। প্রকারান্তরে ঈশ্বরই ওকে এই পথে টেনে এনেছে। এটাই হওয়ার কথা
ছিল।তোর দাদু একতলা একটা বাড়ি করতে এক লপতে এক বিঘে জমি কিনবেন কেন? সুযোগ থাকলেই
এত জমি কেউ কেনে? অবশ্য ভেবেছিল দাম বাড়লে বিক্রি করে ওই টাকায় দোতলা করবে। ঠাকুর
তো অন্য উদ্দেশ্যে ওটা কেনা করিয়েছিল। এটা বুঝিস না কেন? তোর এখন পুরোহিতগিরি করার
ইচ্ছে নেই। তিনি চাইলে মত বদলে যেতে কতক্ষন?
আসলে আজকাল পুরোহিতের সম্মান কতটুকু? অনেকের ধারণা পুরোহিতদের অর্থের প্রতি
লোভ একটু বেশি। সেই কারণেও আমার অনীহা। বাবার কিন্তু সেদিকটা ছিল না। কে কত
দক্ষিণা দিল ভ্রূক্ষেপ নেই। নিষ্ঠার সঙ্গে পুজো করা, ঈশ্বরের আরাধনা করাই একমাত্র
লক্ষ্য।
( তিন )
আমি
এখন পঞ্চাশ বছরে পদার্পণ করেছি। বাবা আটাত্তর বছর বয়সেও যথেষ্ট শক্ত সমর্থ।আগের
মতো নিয়মিত পূজাপাঠ নিষ্ঠার সঙ্গে করেন। আমাদের বাড়িটাকে সকলে ঠাকুরবাড়ি বলে ।সবার
ধারণা মন্দিরের ঠাকুর খুব জাগ্রত। যে যা মানত করে আসে নিশ্চিত ফল পাবেই। কিছু কিছু
পূজার অনুষ্ঠানে হাজারের উপর ভক্তের সমাগম হয়। সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা প্রায়ই
আসেন মন্দিরে। সরকারের উচ্চ পদে আসীন এমনকি মন্ত্রীরাও বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম
করেন। সে যোগ্যতা বাবা অর্জন করেছেন। আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে।ছেলেটি ফিজিক্সে
অনার্স নিয়ে বি.এস.সি পাশ করেছে। আমার ইচ্ছে এম.এস.সি, পি.এইচ.ডি করে আমার মতো
অধ্যাপনা করুক। মেয়েটি ক্লাস ইলেভেনে পড়ছে। আমি আমার কলেজ, পড়াশুনা ইত্যাদি নিয়েই
ব্যস্ত থাকি বেশি। মন্দিরের প্রতি আগ্রহ কম। তাছাড়া মন্দির দেখভালের অনেকে আছে।
মায়ের উপরই দায়িত্ব বেশি। আমি অবাক হয়ে যাই আমার স্ত্রীও মায়ের মতো মন্দির নিয়েই
ব্যস্ত থাকে বেশি। অথচ আমি ধার্মিক মেয়ে বিয়ে করিনি। স্মার্ট, শিক্ষিত, মডার্নই
বলা যায়। বিয়ের পর এমন পরিবর্তন কি করে হয় ভেবে পাই না। এক রবিবারের ঘটনা। সকাল
আটটা নাগাদ চা, টিফিন করে কি মনে হল অনেক দিন মন্দিরে ঢুকিনি, যাই একটু গিয়ে বসি।
মন্দিরে ঢুকেই আমার চক্ষু চড়কগাছ।দেখি
আমার একমাত্র পুত্র যে নাকি সপ্তাহ খানেকের মধ্যে এম.এস.সিতে ভর্তি হবে।
সেই ছেলে বিগ্রহের সম্মুখে ধূতি নামাবলি পরে স্পষ্ট শুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণে
মন্ত্রপাঠ করে পুজো করে চলেছে। পাশে কয়েকজন ভক্ত বসে আছেন পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার
অপেক্ষায়। আমি বিস্ময়ে হতবাক ! স্ত্রী আমাকে দেখে এগিয়ে এসে কানে কানে ফিস ফিস করে
বলল, দেখেছ, মন্দিরের উত্তরসূরি তৈরি হয়ে গেছে। আমাদের খোকাই এবার মন্দিরের
দায়িত্ব নেবে। তোমার মতো অধার্মিকের এসবের মর্ম বুঝবে না। আমি বাক্যহারা !
লেখক পরিচিতি -
নিত্যরঞ্জন দেবনাথ পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়ার পানুহাটে ১৯৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন।কাটোয়া কলেজ থেকে বাণিজ্যে স্নাতক। বর্তমানে থাকেন হুগলির চুঁচুড়ায়। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী ছিলেন।অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল-এর অধীন ডিভিশনাল অ্যাকাউন্টস অফিসার পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম গল্প " চেতনা " ছোটদের পত্রিকা শুকতারায় ১৯৯৬ - এর এপ্রিলে প্রকাশিত হয়। এরপর দেশ, শিলাদিত্য, কালি ও কলম,মাতৃশক্তি, তথ্যকেন্দ্র, কলেজস্ট্রিট, কথাসাহিত্য, দৈনিক স্টেটসম্যান, যুগশঙ্খ, একদিন,,সুখবর ইত্যাদি এবং বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে নিয়মিত তাঁর সাহিত্যকীর্তি অব্যাহত। ইতিমধ্যে পাঁচটি গল্প সংকলন ও চারটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক "শতানীক " পত্রিকাটি দীর্ঘদিন ধরে সম্পাদনা করে আসছেন।