ধারাবাহিক বড় গল্প
২য় খন্ড
আর কি এদের জন্য করা যেতে পারে এই চিন্তাই শ্যামলকৃষ্ণ
কুরে কুরে খায়।
বাহকের জীবন থেকেও যাতে একে নির্মূল করা যায় তার জন্য
তার ভাবনার শেষ নেই। কিন্তু যা তাকে গভীরভাবে পীড়া দেয় তা হোল কোন যুবক বা যুবতী
যদি জানতে পারে তারা বাহক তখন তারা এতটাই ভেঙ্গে পড়ে যে ডাক্তার অনেক চেষ্টা করেও
তাদের মনের গ্লানি কাটাতে পরেন না। কোন সুস্থ ছেলে বা মেয়ে যদি সাহসের সাথে বুকভরা
ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে আসে তবেই এদের মনের গ্লানি অনেকটাই কেটে যায়। কিন্তু সেও
সাময়িক কেননা তাদের সন্তানদের মধ্যে ও থ্যালাসেমিয়া থাবা গড়তেই পারে। ডাক্তার শুধু
ভাবেন Blood
Transfusion & Marrow Steem cell Transplant করা ছাড়া আর কি
কোন উপায় হতে পারে না?
ডাক্তার বিকাল হলেই নিকটবর্তী একটি পার্কে পদচারনা করেন
আর প্রজাপতির মত রং বেরং-এর পোষাকে সজ্জিত ফুলের মত ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের দেখেন।
এই সময় টুকুই ওনার অবসর। এখনই একদিন ডাঃ পার্কে তিনচার পাক হেঁটে একটা বেঞ্চে বসতে
যাবেন এমন সময়
দেখেন এক মহিলা ২৬/২৭ বছর বয়স তো হবেই,আকাশের দিকে মুখ তুলে উদাস চেয়ে আছে। মন যে তার সুদূরে উধাও,এ জগতে যে নেই, তা বুঝেও ডাক্তারের অসুবিধা হল না।
মেয়েটি খুব সুন্দরী, ঝজুটান শরীরের ভঙ্গিমা, বেশ নজর কাড়ে। মুখে যেন সামান্য ফ্যাকাসে ভাব কিন্তু বড় বড় চোখ দুটো ঘন
নীল। মুখের হালকা ফ্যাকাসে ভাব ডাক্তারের নজর এড়াতে পারেনি। ডাক্তার নিঃশব্দে
বেঞ্চের পেছনে গিয়ে মেয়েটির দিকে পেছন ফিরে আকাশের দিকে চেয়ে থাকলেন কিছুক্ষন,তারপর আপন মনে গান ধরলেন -
“ শ্রাবনের ধারার মত পড়ুক ঝরে,পড়ুক ঝরে তোমার সুরটি আমার মুখের পরে বুকের পরে”।
সম্পূর্ন গানটি গেয়ে ডাক্তার থামলেন এবং মেয়েটির দিকে ফিরলেন। দেখলেন মেয়েটি অবাক বিস্ময়ে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে আছে। ডাক্তারও নির্নিমেষে তাকিয়ে থাকলেন। অবশেষে মেয়েটিই মুখ খুলল -
Nice!
you ore singing nice. But what's the meaning of it? The song toneless my heart
but I don't know why? - কথা কটি বলেই ডাক্তারের দিকে ডান হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে
পরক্ষনেই আবার গুটিয়ে নিল। ডাক্তার একটু হেসে নিজের হাতটি বাড়িয়ে বললেন,- I am Shyamal, Dr.
Shyamal, Specialist in thalassemia" মেয়েটি তার ফর্সা হাতটি বাড়িয়ে
দিয়ে বলল: am
Alice. Carrier of Thalassemia । আমার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে
দিয়ে খুব ভুল করলেন ডাক্তার।" ভুল আমি করিনি এলিস।
তোমার মন এখন বিষন্ন কেন? আনন্দ কর।
এলিস ডাক্তারের হাতটি ধরে চুপচাপ বেঞ্চে বসে হইল।
মুখে কোন কথা নেই। কিন্তু ডাক্তার নিজের হাতটি এলিসের হাতের
মধ্যে মেলে দিয়ে যেন তার মনের নীরব উপলব্ধিগুলো নিজের অন্তরে অনুভব করতে পারলেন। তিনি এলিসকে
সময় দিলেন। কিছুক্ষন পর ডাক্তার বললেন, চিকিৎসার অনেক উন্নতি
হয়েছে- তুমি যদি আমার উপর ভরসা করতে পার তবে আমি বলছি, তুমি
ভালোভাবে বেঁচে থাকবে,তোমার সামান্য রক্তাল্পতা,যা আমি দেখতে পাচ্ছি,তা কেটে যাবে। তুমি আমার উপর
ভরসা করতে পারছ তো? তুমি কি আমাকে বন্ধু বলে গ্রহন করতে পারছ?
এলিসের মুখে কোন কথা নেই। সন্ধে ঘনিয়ে আসছে।
পার্কের কোলাহল থেমে গেছে। রঙীন প্রজাপতিগুলি তাদের মা বাবা কিংবা আয়ার হাত ধরে যে
যার বাসস্থানে ফিরে গেছে। অনেকক্ষন পরে ডাক্তার বললেন, "তুমি আর এখানে বসে না থেকে বাড়ী যাও।”
যেন অনেকদূর থেকে বিঘা দখিন্ন কণ্ঠে এলিস বলে উঠল, "ডাঃ আমার
কোন বাড়ী নেই।” ডাক্তার এলিসের হাতটি ধরে বললেন, "আপত্তি
না থাকলে চল আমরা একসাথে কফি খাব। যদি চাও তবে তোমার সব কথা আমাকে বলতে পার”।
এলিস ডাক্তারের হাত ধরে উঠে দাঁড়াল, তারপর বলল,
আমি কাছেই একটি বাড়ীতে পেয়িং গেষ্ট, এক বৃদ্ধা
মহিলার দেখাশুনা করি,উনি যা দেন খাওয়ার খরচ মিটিয়ে হাতে আমার
সামান্যই থাকে। বিকেল টুকুই আমার নিজস্ব সময়। আমি পার্কে এসে বসে থাকি। জানি আমার
জীবনের কোন আশা নেই, কিন্তু ডাক্তার তোমার গান আমার হৃদয়
ছুঁয়েছে,যদি আবার গান শোনাও তবে কাল আবার এই সময় পার্কে আসব।
চল তোমার সঙ্গে কফি খাব।
পরের দিন দেখা হতেই শ্যামল এলিসকে নিয়ে এলেন নিজের
কোয়াটার্সে। সেখানে এলিসের রক্ত সংগ্রহ করলেন এবং আরও নানারকম পরিক্ষা করে এলিসকে ওষুধপত্র
দিয়ে বললেন নির্দেশ মত সেগুলি নিতে যেন কখনো ভুল না হয়। তারপর এলিসকে বললেন,
'কাজের চাপে আমার সারাদিন খাওয়া হয়নি তুমি যদি আপত্তি না করে
অংশগ্রহন কর তবে এস, খাওয়াটা সেরে নিই। আর একটা কথা,আমাকে ডাক্তার না বলে তুমি শ্যামল বলে ডাকবে,মনে
থাকবে তো।'
এলিস আপত্তি করল না,তবে খেল
সামান্যই। শ্যামলের অভিজ্ঞ চোখে ধরা পড়ল এলিসের মুখের গোলাপী আভা। খাওয়ার শেষে
এলিস নিজেই বলল তার জীবনের কথা,কেন সে একা থাকে? ও জানাল রক্তাল্পতার জন্য ডাক্তার দেখাতে গিয়ে ধরা পরল যে এলিস
থ্যালাসেমিয়ার বাহক। অথচ এলিসের বড় ভাই, একমাত্র ভাই,
জুলিয়ান সম্পূর্ন সুস্থ। সে এলিসকে স্পষ্ট বলে দিল যে সে মার্থাকে
শিগগিরই বিয়ে করতে চলেছে,মার্থা যদি জানতে পারে যে এলসি
থ্যালসেমিয়ার বাহক তবে বিয়েটা ভেঙ্গে যাবে। এলিস অনেক করে ভাইকে বোঝাতে চাইল,
অসুখটা আকাশ থেকে পড়ে নাই,এটা সম্পূর্ন জীন
বাহিত,সুতরাং পারিবারিক। মা কিংবা বাবার থেকে সে পেয়েছে।
তাহলে বিনা প্রস্তুতিতে সে বাড়ী ছেড়ে যাবে কেন? কোথায়ই বা
যাবে? গ্র্যাজুয়েশন সম্পূর্ন করে একটা চাকুরী জুটিয়ে সে
নিশ্চয়ই চলে যাবে। দাদার বিবাহিত জীবনে সুখের মধ্যে কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে না। কিন্তু
দাদা অবুঝ,এখুনি এলিসকে বাড়ী ছেড়ে চলে যেতে হবে। বাধ্য হয়ে
এলিস তার গম্ভীর রাশভারী বাবার কাছে গিয়ে দাবী করল যে তাকে বলতে হবে তিনি না মা,কে এই রোগের উৎস?
উত্তরে পিতা ড্রয়ার খুলে রিভলভার বের করে মেয়ের দিকে তাক
করে বললেন- গেট লষ্ট এ্যাট ওয়ানস। বিস্মিত এলিস নিজের ঘরে এসে বিছানায় লুটিয়ে পড়ল।
অনেক রাতে চুপি চুপি এলিসের মা তাকে একটা টাকা ভর্তি পার্স দিয়ে বললেন,তার পিতাই দায়ী,এলিস যেন এই টাকা নিয়ে অনেক দূরে কোথাও চলে যায় এই কথা বলতে বলতে এলিসের
মাও কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। পরদিন ভোরে এলিস বাড়ী থেকে বেরিয়ে পড়ল। অনেক ঘুরে,অনেক ছোট খাট কাজ করতে করতে সে এতদূরে এসে পড়েছে। এখানে ঐ বৃদ্ধা তাকে না আশ্রয় দিলে এলিসের দূর্গতির শেষ থাকত না। শরীরও
ক্রমশঃ খারাপ হতে শুরু করেছে,মনও ভাল নেই,এমন আর্থিক সঙ্গতি হচ্ছে না যে ডাক্তারের কাছে যায় এবং এ বিষয়ে বিস্তারিত জানে।
এমন সময় ইশ্বরের কৃপায় শ্যামল-এর মত ডাক্তারের বন্ধুত্ব
অর্জন করতে পেরেছে সে,সেজন্য সে ডাক্তারের কাছে কৃতজ্ঞ।
লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
ক্রমশ ………
২য় পর্ব পড়ুন আগামী মঙ্গলবার ।
লেখিকারঅন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখিকার পরিচিতি –
যুথিকা চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৪২-এ । মালদায় বেড়ে ওঠেন। সেখানে তার পড়াশোনা শুরু হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও বাংলায় স্নাতকোত্তর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে। ১৯৬২-তে মালদহ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পবিত্র কর্মযজ্ঞে প্রবেশ করে পরবর্তীতে ১৯৭১ থেকে ২০০২ পর্যন্ত সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার গুরুদায়িত্ব পালন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন। শুধু তাই নয়, লেখালেখিতেও তার সহজাত অধিকার। তিনি সেতার বাদন ও বই পড়তে ভালোবাসেন। বর্তমান ভ্রমণকাহিনীটি তার অন্যান্য পরিচয়কে সমুন্নত করে তুলেছে।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত বই একটি।