ধারাবাহিক বড় গল্প
১ম খন্ড
শ্যামল কৃষ্ণ রায়। কলি গ্রামের ছেলে। বাবা ডাক্তার কমল কৃষ্ণ রায় গ্রামেই ডাক্তারি করেন। বাড়ী জমি জায়গা নিয়ে বার্ধিত পরিবার । ধনীও বটে। ছেলেকে কোলকাতায় হস্টেলে রেখে পড়াশুনা শিখিয়েছেন। ডাক্তারী পড়িয়েছেন। ছেলেও বরাবর ভাল রেজাল্ট করে বাবার মুখোজ্জ্বল করেছে।
ডাক্তারিতেও উল্লেখযোগ্য ভাল রেজাল্ট করে বিদেশে যাবে
এমডি করতে এবং গবেষনামূলক কাজ করবার ইচ্ছা আছে। একমাত্র ছেলের উচ্চশিক্ষায় বাধা
দেননি ডাক্তার বাবু। মেয়েকেও তিনি উচ্চশিক্ষা দিয়েছেন। অধ্যাপনার কাজ করছে
কোলকাতায়। বিয়েও দিয়েছেন ধনী পরিবারে। ছেলের বিদেশে যাবার কথা শুনে আপত্তি করেননি
শুধু মায়ের ইচ্ছার কথা বললেন। স্ত্রী সুলতাদেবীর ইচ্ছা ছেলেকে বিয়ে দিয়ে তবেই
বিদেশে পাঠাবেন। কিন্তু ছেলের বক্তব্য তার অনেক কিছু বিষয়ে পড়াশুনা ও গবেষনার
ইচ্ছা। এখনই যদি বিয়ে করে বৌ সঙ্গে নিয়ে বিদেশে যায় তাহলে উচচাশা
সার্থক নাও হতে পারে। বাবা কমল কৃষ্ণ জানতে চাইলেন, কি নিয়ে
তার পড়াশুনা ও গবেষনা করার ইচ্ছা ? উত্তরে ছেলে জানিয়েছিল
সেটা সময় কালেই জানাবে।
- তবে বর্তমানে
থ্যালাসেমিয়াটা একটা আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে,এর মূল কোথায়,প্রতিকারের কোন উপায় হতে পারে কিনা ইত্যাদি নিয়েই আমার গবেষমা করার ইচ্ছা
আছে। "আর তুমি তো বোঝই বাবা, এই সব গবেষনাধর্মী কাজে
সময় এবং মনোযোগ কতটা দরকার। তাই বলছিলাম কি পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে আমি তো বাড়ীতে আসবই তোমাদের দেখতে তখন সুযোগ মত বিয়ে দিও। এব্যাপারে তোমাদের
পছন্দ এবং মতামতই আমার শিরোধার্য”।
সুলতা দেবী একটু মনঃ ক্ষুন্ন হলেও আর বিশেষ জোরাজুরি
করেননি ছেলের বিয়ে নিয়ে। ডাঃ শ্যামল কৃষ্ণ রায় একদিন যাত্রা করলেন বিদেশের পথে,স্বপ্নের উড়ানে।
বছর দুয়েক পর একদিন হঠাৎ দুঃসংবাদ ভেসে এল শ্যামল কৃষ্ণ রায়ের কাছে যে বাবা কমল কৃষ্ণ রায় সস্ত্রীক বাড়ী থেকে গাড়ী করে হরিশচন্দ্রপুর আত্মীয়র বাড়ী থেকে ফেরার পথে দুর্ঘটনায় প্রান হারান। মা তখনই চলে যান বাবা
কিছুক্ষন বেঁচে ছিলেন। ওনাকে নিজ বসভবনে এনে এ্যাম্বুলেন্সে করে মালদা সদর
হাসপাতালে আনার ব্যবস্থা হচ্ছে তখন উনিও চলে গেলেন। মা বাবার এক সাথে মৃত্যু সংবাদ
শ্যামলকৃষ্ণকে বিমূঢ় করে ছিল। সদ্য তিনি মাসখানেকের জন্য বাড়ী থেকে ঘুরে গেছেন,বিয়ের মতও দিয়ে এসেছেন। হতভম্ব হয়ে গেলেন তিনি। কোলকাতায় বোনকে জানালেন
কলিগ্রামের বাসভবনেই শ্রদ্ধ-শান্তি হবে "তুই চলে আয়
আমিও আসছি।"
কাজকর্ম মিটিয়ে আবার তিনি হবেন দেশছাড়া। আসার সময়ে বোন
সুদেষ্ণা খুব কান্নাকাটি করছিল,"বলছিল দাদা তুই কি আর দেশে ফিরবি
না,বিয়ে করবি না। মার কত সাধ ছিল মনের মত বৌ আনবে তোর জন্য
সে সবেতো চরম বাধা পড়ে গেলরে।"
- শ্যামল হেসে বলেছিলেন,"শেকড়ের
টান কি অস্বীকার করা যায়,তবে যে কাজে বাধা পড়ল তা কবে হবে এই
মুহূর্তে ওসব নিয়ে ভাবছি না। মন খারাপ করিস না। তোর ছেলে মেয়ে দুটোকে মানুষ কর
ভবিষ্যতে যদি বিদেশে আসতে চায় জানাস সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
আমি এখন ফ্রান্সের একটা হাসপাতালে আছি,সেখানে থ্যালাসেমিয়া
রোগীদের নিয়ে নানান পরীক্ষা নিরিক্ষা হচ্ছে।"
সুদেষ্ণার কান্না থামতে চায় না। বলে,"দাদা তুই
কিন্তু আমাদের সংগে যোগাযোগ রাখিস। ভুলে যাসনা আমাদের কথা। গুবলে আর টিকলুটা ক্লাস VIII আর ক্লাস VIII-এ পড়ে
দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাবে। টিকলুটা দিদা ভক্ত ছিল খুব,আর গুবলেটার ঠিক বাবার মত মেজাজ। বলে "দাদুর মত ব্যক্তিত্ব আমি
দেখিইনি। ডাক্তার তো অনেকেই হয়,কিন্তু
দাদু আর মামা যে আলাদা সবার থেকে"। দাদু,দিদা একসাথে
চলে যাওয়াতে ওরাও খুব মুষড়ে পরেছে। বছরে একবার করেতো কলিগ্রামে আসা চাই-ই,এখানকার
পুকুরে মাছ ধরে দেখা,বগানের আম, জাম,কাঁঠাল ওদের খুব প্রিয় ছিল। এখন কি ওদের এখানে আসতে
ইচ্ছা হবে? আমিই বা এই শূন্য পুরীতে এসে কি করব? সরকার মশাই ও বলছিলেন জমি জমা বাগান বাড়ী এতসব উনি
কিভাবে সামলাবেন,তুই একটু ওনার সাথে কথা বল দাদা।"
শ্যামল শুনে বলল,"বাড়ীতে আশ্রিতজনও তো আছে তাদের তো চলে যেতে বলতে পারিনা। সরকার মশাই-এর সাথে কথা বলব। যেমন সংসার চলছে চলুক,দোতলাটা বন্ধ রাখতে বলব।"
সুদেষ্ণা বলে,আর শোন
দাদা,মা একটা গয়নার বাক্স দেখিয়ে বলেছিল,এগুলি শ্যামলের বৌ-এর জন্য এই গয়না আমি নতুন পুরোন মিলিয়ে রেখেছি। দাদা,তুই গয়নার বাক্সটা নিয়ে যা "। শ্যামল দ্বিধায় পড়ে। সবই বোঝে বোনের
কথায় যুক্তি আছে। তবে এটাও তো ঠিক এখানে আর যখন তখন আসার
ইচ্ছা হবে না।
বোনের কথামত শ্যামল আরও কয়েকটা দিন থাকা ঠিক করলেন।
সরকার মশাইকে ডেকে বললেন,"সরকার জ্যেঠু আপনি এই
বাড়ীতে যেমন আছেন তেমনই থাকবেন, আমাদের আশ্রিতজন যারা ছিলেন
তারাও থাকবেন। সংসার চালাবার মত জমি রেখে বাকী জমি বিক্রি করে দিন। বাগান,দীঘি সমেত বাড়ী যেমন আছে তেমনি থাকবে। আমি
সময় সুযোগমত আসব, দেশের সঙ্গে সম্পর্ক
শেষ করে দিতে আমি চাই না। সরকার মশাই অশ্রুসজলনেত্রে
শ্যামলের কথা মেনে নিলেন এবং শ্যামল যে দেশের সঙ্গে সম্পর্ক
রাখতে চায় সেটা জেনে খুব খুশী হলেন।
বোনের কথামত সিন্ধুকে যত গয়না ছিল সব বের করলেন,মায়ের রাখা
বাক্সটাও। শ্যামল বললে,"সু তুই গয়না গুলি সব নিয়ে নে –
মা তো আমার জন্য আলাদা করে গয়না রেখেইছেন"।
বোন বলে,তা হয় না দাদা,মার
নিজস্ব গয়না সবই তোর প্রাপ্য কিন্তু তুই যখন বলছিস তখন ভাগ কর গয়না অর্দ্ধেকটা নেব,বাকীটা তোর। টাকা পয়সা যা আছে তাও তুই নিবি। বাবা তো
আমাকে প্রচুর দিয়ে থুয়েই বিয়ে দিয়েছিলেন"।
শ্যামল কি আর করে বোনের কথামত টাকা গয়না বিশেষ করে গয়নার
বাক্স নিয়ে নিলেন। নিঃশব্দে শ্বাস পড়ল একটা,এ বাড়ীর বৌ কে হবে তার নাই ঠিক
অথচ তার গয়নার বাক্স তিনি নিলেন। সব মিটিয়ে বোন কোলকাতায় চলে গেল। সরকার জ্যেঠুকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে শ্যামল ও উড়ে গেল নিজের
কর্মস্থলে। কোলকাতা বিমান বন্দর থেকে যখন বিমান উড়ল, শ্যামলের
মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল। বোনের জামাই,ভাগ্নি
সবাই ওরা এসে ছিল বিমান বন্দরে। বম্বেতে বিমান বদল করে দীর্ঘ উড়ান সমুদ্রের উপর
দিয়ে।
কার লেখা শ্যামল মনে করতে পারলো না, কিন্তু একটা কবিতার কটা ছেঁড়া লাইন শ্যামলের মনে পড়ল।
"ব্যথার সাথে ব্যথার দেখা সমুদ্দুরে নোনাজলের ঢেউ এসে ওই ভাসিয়ে দিল অনেক
দূরে। নেই সিমানা। ব্যাথার কথা অন্য ব্যাথার হয়নি
জানা।"
ডাঃ শ্যামল কৃষ্ণ রায় থ্যাসেমিয়া স্পেশালিস্ট। ফ্রান্সের
একটা হাসপাতালে তিনি কর্মরত। থ্যালাসেমিয়া একটা জিন বাহিত রোগ। মা কিংবা বাবা কেউ
এই রোগের বাহক হলে তবে ছেলে মেয়েরাও এই রোগের শিকার হয়। সেই জন্য উচিৎ প্রত্যেক
ছেলে বা মেয়ের বিয়ের আগে দুফোঁটা রক্ত পরিক্ষা করিয়ে নেওয়া। ডাক্তার রোগীদের সঙ্গে
মেশেন তাদের সব কথা শোনেন মন দিয়ে। একটা জিনিস ডাক্তার লক্ষ্য করেছেন যে,যখনই কোন ছেলে
বা মেয়ে জানতে পারে যেসে থ্যালাসেমিয়ার বাহক অমনি তার মন থেকে সব আলো উধাও হয়ে যায়,সে যেন বুঝে যায় যে এই পৃথিবীতে তার আর বেশী দিন থাকবার অধিকার নেই। কিংবা
কেউ যদি জানতে পারে সে বাহক তবে তার আর কোন বন্ধু বা বান্ধবী জোটে না। যারা থাকে
তারাও কেটে পড়ে। যারা বিবাহিত বা বিবাহিতা তারা নিজেদের ছেলে মেয়েদের পরীক্ষা
করিয়ে তাড়া সুস্থ কিনা সেটা জানতেই ব্যস্ত। অবশ্য করাও হয় তাই। যে কোন
থ্যালাসেমিয়ার পেশেন্ট এলেই তাদের পরিবারিক সবার খোঁজ খবর ও
রক্ত পরীক্ষা করা হয়। কি ভাবে রোগটা এল তার Case History করা হয়। অনেকসময়
বিবাহের আগে অজ্ঞতবশকঃ কিংবা আবেগজনিত কারণে কোন খোঁজখবর না নিয়ে যে সব
ক্যারিয়ার বা থ্যালাসেমিয়া রোগী জড়িত হয়ে পড়েন তাদের সন্তানদের মধ্যেই এই রোগ
সংক্রামিত হয়। কেউ বা শুধুমাত্র বাহক। ভাল খাওয়া দাওয়া ঔষধপত্র পেলে তার কোন
প্রকাশ ধরা পরে না। কোন সুস্থ ছেলে বা মেয়ের,যারা শুধুমাত্র
বাহক তাদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে কোন বাঁধা থাকে না। কখনো তাদের মধ্যে
সামান্য রক্তাল্পতা রোগ দেখা দেয় মাত্র। আলফা থ্যালাসেমিয়ার মেজর বেবী সাধারনতঃ
জন্মের পরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কিন্তু বর্তমানে থ্যালাসেমিয়া সচেতনতা অনেক
পরিমানে বেড়ে গেছে যার ফলে থ্যালাসেমিয়া রোগ প্রতিরোধেও আশাবাঞ্চক দিক দেখা
যাচ্ছে। এছাড়াও সাম্প্রতিককালে চিকিৎসার নানারকম উন্নতি হয়েছে । কেবলমাত্র বাহকরা
যত্নে থাকলে, নিয়মিত চিকিৎসকের সহায়তা নিলে অনেকদিনই
ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু যদি অপরজন অর্থাৎ জীবন সঙ্গী বা সঙ্গিনীও যদি
ক্যারিয়ার হয় তবে সন্তানের মধ্যে থ্যাসেমিয়া রোগ হতেই পারে। আবার এও ঠিক যারা
মডারেট অথবা সিভিয়ার থ্যালাসেমিয়া রোগী তারাও উপযুক্ত চিকিৎসার সাহায্য নিলে
যথেষ্ট বেশী দিন বাঁচতে পারেন এবং উন্নততর জীবনও পেতে পারেন।
ক্রমশ ………
২য় পর্ব পড়ুন আগামী মঙ্গলবার ।
লেখিকারঅন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখিকার পরিচিতি –
যুথিকা চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৪২-এ । মালদায় বেড়ে ওঠেন। সেখানে তার পড়াশোনা শুরু হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও বাংলায় স্নাতকোত্তর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে। ১৯৬২-তে মালদহ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পবিত্র কর্মযজ্ঞে প্রবেশ করে পরবর্তীতে ১৯৭১ থেকে ২০০২ পর্যন্ত সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার গুরুদায়িত্ব পালন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন। শুধু তাই নয়, লেখালেখিতেও তার সহজাত অধিকার। তিনি সেতার বাদন ও বই পড়তে ভালোবাসেন। বর্তমান ভ্রমণকাহিনীটি তার অন্যান্য পরিচয়কে সমুন্নত করে তুলেছে।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত বই একটি।